somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিটাগাইংয়্যা চে

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম ছেলেটির সাথে দেখা।দূর থেকে দেখলে চে গুয়েভারার মতো মনে হয়,চুলগুলো লম্বা হবার পথে ধাবমান কিন্তু ঠিক লম্বা নয়, গালে স্টিকারের মতো লেগে আছে খোচা খোচা দাড়ি।আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ে অথচ কথা বলি বলি করেও বলা হয়ে উঠে না।

একদিন দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আরেক ছেলের সাথে অদ্ভূত এক ভাষায় কথা বলছে।নিজের স্বল্পবুদ্ধি দিয়ে আন্দাজ করলাম এটা সম্ভবত চাইনিজ ভাষা।এরা হয়তো ভাষা ইন্সটিটিউটে চাইনিজ ভাষার কোর্স করছে আর এখন অবসরে নিজেদের মাঝে প্র্যাকটিস করে নিচ্ছে।আমার পাশে বসতেই বললাম “তুমি তো দেখি ভালোই চাইনিজ শিখেছো”? ছেলেটি যেন আকাশ থেকে চাইনিজ যন্ত্রপাতির মতো ভেঙ্গে গেলো। “কোথায় চাইনিজ, ওটা চিটাগাইংয়্যা ভাষা ছিলো,
আমাদের বাড়ি চিটাগাং!” এইভাবে আলাপ শুরু তারপর বন্ধুত্ব।ছেলেটির আসল নাম একটা আছে তবে তাকে চেতাবার জন্য আমি ডাকতে শুরু করি ‘চে’ বলে।

আমার ব্যার্থতা হোক আর চে-এর ড্যাম কেয়ার ভাবই হোক, চে-কে কখনোই চেতাতে পারি না। ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছেন লাতিন আমেরিকার কথা।আমার পাশে বসে চে ঘুমে ঢলে পড়ছে।কনুইয়ের খোচা সহযোগে তাকে বলি, “ঐ শোন, লাতিন আমেরিকার কথা বলছে।তোমার এলাকা”, চে ঘুম ঘুম চোখে উত্তর দেয় “লাতিন আমেরিকা! ঘুমের ভেতর শুনছি নাতিন আমেরিকা।আমি ভাবলাম স্যারের নাতি নাতনীরা আমেরিকায় থাকে, স্যার তাদের গল্প বলছে, এই ফাকে একটু ঘুমিয়ে নেই”।

চে-কে চেতিয়ে কোন রেজাল্টই পাচ্ছিলাম না ঠিক একই সময়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়ে কোন রেজাল্ট পাচ্ছিলো না।চেয়ারম্যান-এর রুমের সামনে ছাত্র-ছাত্রীরা জড়ো হয়েছে রেজাল্টের দাবিতে,আমি আর চেও আছি তাদের মাঝে।চে-কে চেতাবার আরেকটি চেষ্টা নিলাম, “বুঝলে চে, এই তো সময়, বিপ্লব চাই, বিপ্লব! হ্যা, তুমিই পারবে, তুমি আমাদের হয়ে বিপ্লব ডাক দাও”। চে নিরুত্তাপ কন্ঠে কিছুটা সামনে দাঁড়ানো আমাদের ক্লাসের বিপ্লব নামের ছেলেটিকে ডাকে, “ঐ বিপ্লব, শালা, এদিকে আ্‌য়, তোরে ডাকে”।

ধীরে ধীরে ক্লাসের বেশকিছু ছেলে চে-এর সাঙ্গপাঙ্গ হিসেবে জুটে যায়।একটা দিক দিয়ে তারা সবাই কমন।সেটা হলো প্রত্যেকেই লুলের লুল।তারা একজোট হয়ে ক্যাম্পাসে সুন্দরী রমণী পর্যবেক্ষন করে বেড়ায় এবং পর্যবেক্ষন শেষে কোথাও একসাথে বসে কে কি দেখলো তা পরস্পরের সাথে তত্তীয় বিশ্লেষন সাপেক্ষে আলোচনা করে নেয়।একদিন দেখি চে তার দলবল নিয়ে লাইব্রেরীর সামনে দলবদ্ধ হয়ে বসে আছে।হয় তাদের পর্যবেক্ষন শেষ হয়ে যাবার পর আলোচনা সভা চলছে নতুবা পর্যবেক্ষনের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে।আমি সেখানে গিয়ে চে-কে চেতবারা চক্রান্ত করি, “এই তো চে, শাব্বাশ, বন্ধুদের নিয়ে তুমি একজোট হয়েছো।এখন পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করো, অস্ত্র হাতে বিপ্লব করো”। চে নিষ্প্রান কন্ঠে জানায় যে তারা পুলিশের অস্ত্রাগার নয়, বরং নারীর বস্ত্রাগার লুট করতে বেশী আগ্রহী।পাশে দাড়ানো চে-এর এক সঙ্গী বিড়ি টানতে টানতে আমায় বলে, “তুমি আমগো হাভানা চুরুট আইনা দাও।বিপ্লব-টিপ্লব যা করন লাগে,কইরা দেখামু।শালার এই আকিজ বিড়ি টাইনা কি বিপ্লব করন যায়”? আমি কিছুটা কনফিউজড হই,“হাভানা চুরুট তো চেগুয়েভারা খেতো না, তার বন্ধু এবং সহযোদ্ধা ফিদেল ক্যাস্ত্রো খেতো”।উত্তর আসে, “আরে বন্ধু কি আরেক বন্ধুরে ভাগে না দিয়া কোনদিন একা কিছু টানে?” এটা শুনে চে তার সঙ্গীর উপর খেপে যায়।“শালা তুই কোনদিন আমাকে কিছু দিয়ে খেয়েছিস?এই যে ললিপপের মতো করে বিড়ি চুষছিস, একবার সাধলিও তো না”।আলোচনার প্রসংগ বিপ্লব থেকে ঘুরে চলে যায় খাওয়া-খাওয়ির দিকে।কে কাকে কোথায় কি খাইয়েছিলো তা নিয়ে তুমুল তর্ক জমে উঠে।এমন সময়েই চে-এর সেই সঙ্গীর টি শার্ট-এর দিকে আমার নজর যায়।টি শার্টে-এর ছবির ভেতর থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে সত্যিকারের চে।তাকে বলি, “কি মিয়া, তুমি দেখি নিজেই চে-গুয়েভারার টিশার্ট পড়ে আছো।উত্তর আসে, “হ, চে-এর টিশার্ট পড়লে একটু কুল লাগে।মাইয়ারা ফিরা তাকায়”।আবার চে প্রতিবাদ করে।চে–এর মতে অমুক অমুক ধরণের পোশাক পড়লে মেয়েরা (চে-এর ভাষায় ছেমড়িরা) ফিরে তাকায়।চে-এর বাদবাকী বন্ধুরাও আলোচনায় অংশ নেয়ে।তাদের মতে তমুক ধরণের পোশাক পড়লে মেয়েরা (তাদের ভাষায়ও ছেমড়িরা)ফিরে তাকায়।আমি ভাবি কি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, আর আলোচনা কোথায় গিয়েছে।বিপ্লব নিয়ে কথা শুরু হয়েছিলো, এখন সেই বিপ্লব ‘বিড়ি প্রসংগ” হয়ে চাপা পড়েছে ছেমড়ি আর পোশাকের তলায়।কি আর করার, তর্করত লুলদেরকে সংগ্রামী লুল সালাম জানিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নেই।

পাশার দান উল্টে যায় শীঘ্রই।যেখানে চে-কে চেতাতাম আমি সেখানে চে-ই আমায় চেতাতে শুরু করে।একদিনচে তাকিয়ে ছিলো কোন এক সুন্দরী রমণীর দিকে।আমি পাশে এসে বলি, “এমন করে চেয়ো না গো চে”।চে বলে উঠে “এমন করে গেয়ো না গো গে”।তারপর থেকেই শুরু।দেখা হলে আমি চি চি করে “কি খবর হে চে”, বলার আগেই চে চিতকার করে বলে “কী খবর হে গে”।চে প্রতিস্থাপিত হয় গে-তে।বিষয়টা থেকে বাচার জন্যই আমি আস্তে আস্তে চে-কে চে বলা কমিয়ে দেই।

চে-কে চেতাবার কোন রেজল্ট এলো না, তবে আমাদের ক্লাসের পরীক্ষাগুলোর রেজাল্ট দেরিটে হলেও আসতে লাগলো।আমরাও অনার্স প্রায় শেষ করে ফেললাম।এমন সময়েই একদিন সত্যি সত্যি বিপ্লব ঘটে যায়;সমাজে নয়, চে-এর মাঝে।চে-কে দেখি চুল কেটে ছোট করে ফেলেছে, স্টীকার দাড়ি তুলে ফেলে ক্লীন শেভড হয়েছে।আমি চে-এর আসল নাম সম্বোধন করে বললাম, “কী খবর হে, চুল কেটে ফেললে যে”?
চে উত্তর দেয়, “প্রতিদিন লম্বা চুল ধুতে অনেক সময় চলে যায়?”
আমি অবাক হই, “তোমার তো সময়ের কোনদিন অভাব ছিলো না, ছিলো কি?
চে বেশ কাব্যিকভাবে উত্তর দেয়, “সময়ের অভাব নেই এমন সময় এক সময় ছিলো বটে, কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই, কারণ এখন অনেক কিছুই নেই, অলিভিয়াও নেই”।
আমি আবার পুরনো সময়ের মতো বলে উঠি, “তুমি বলিভিয়ার কথা বললে চে?সেই বলিভিয়া যেখানে তুমি বিপ্লব করতে গিয়েছিলে?তা সেখানে কি হলো?”
চে বিরক্ত, “আরে বলিভিয়া নয়, অলিভিয়া।তোমাকে ওর কথা বলা হয় নাই।বলেই বা কী লাভ, সে আমার জীবনে এখন তো নেই”।
“নেই কেন?”
চে আবারো কবি হয়, “সে নেই, কারণ সে যা চায় তা আমার কাছে নেই”।
“সে কি চায় চে?” আমি আবারো আগের মতোই তাকে চে সম্বোধন করে চলি।
সেও আগের মতোই প্রসংগ উল্টায়, “ভবঘুরে জীবন তো অনেক হলো, সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে ধুমসে লেখাপড়া করবো,সামনেই বিসিএস।বিসিএস না হলে প্রাইভেট জব।ভালো দেখে একটা চাকুরী হয়ে গেলেই হয়, জীবনে বাদ বাকি যা দরকার এমনিতেই আসবে।বাড়ি গাড়ি এমনকি নারী,কোন কিছুরই অভাব হবে না”।

চে বিদায় নেয়, তাকে লাইব্রেরীতে যেতে হবে, অস্থায়ি ক্যাম্প বসাতে নয়, বিসিএস-এর পড়া পড়তে।আমি চে-এর পেছন দিকে চেয়ে থাকি।সত্যি সত্যি তার মাঝে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।আমিযে বিপ্লবের কথা বলে চেতাতাম সেই বিপ্লব অবশ্য নয়।বিপ্লব মানেই কি শুধু কমিউনিস্ট বিপ্লব? বিপ্লব হতে পারে, প্রসুক্ততে, শিক্ষায়, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে, সর্বপরি চেতনায়।কিন্তু এসব ঘটাবার কার দায় পড়েছে, আমাদের কারই বা সময় আছে।ছুটছি শুধু ব্যাক্তিগত অর্জনের দিকে।বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠা চে-গুয়েভারা বন্দী আছে পোস্টারের কারাগারে কিংবা টি শার্টের ভেতর নির্বাসনে।ওদিকে চাহিদামাফিক গতিতে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি অনেক কিছু।এই যেমন আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমদের ক্লাসের সেই বিপ্লবকে।সে অনেকদিন ক্লাস করি না, শূনেছি রাতে কল সেন্টারে কি এক চাকুরী করে, দিনে বাসায় পড়ে পড়ে ঘুমায়।আগে বেশ মোটাসোটা ছিলো, এখন আকি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।একদিন ফোন দিয়ে বসলাম খোজ নিতে।অনেকবার রিং বাজলেও ওপাশ থেকে বিপ্লব সাড়া দিলো না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:০৮
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×