প্রবাদ আছে-গোবরে পদ্মফুল।আজ সে কথাই যেন বাস্তবায়িত হয়েছে জনাব মোহাম্মদ তাহের আলীর ক্ষেত্রে ।1987-88 সালের কথা, একটি চরম দরিদ্র ঘরের সন্তান, দু-বেলা খাবার নিশ্চিত করতে মাঠে গোবর কুড়িয়ে সেটি দিয়ে ঘশি তৈরি করে তা বিক্রি করতেন।কে জানত, সেই ছেলেই একদিন নিজের কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবস্যয়ের মাধ্যমে একজন বিসিএস ক্যাডার হবে?
কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হবারই কথা।তবে আসুন বাকীটুকু শুনি তার নিজের মুখেই-

[আমি মোহাম্মদ তাহের আলী, প্রভাষক, 28তম বিসিএস, অথর্নীতি, সরকারী হরগংগা কলেজ,মুন্সিগন্জ । 1988 সালে আমি তখন ৩য় শ্রেণিতে পড়ি।বাবা অন্যের জমিতে দিন মজুরের কাজ করেন আর মা অন্যের বাসায় কাজের বুয়ার কাজ করেন।বড় ভাই, সে-ও পড়ালেখার ফাঁকে অন্যের জমিতে কাজ করতেন।আর আমি, পড়ালেখার ফাঁকে অন্যান্য চাচাতো ভাইদের সাথে মাঠে গরুর গোবর কুড়াতাম এবং সেই গোবর শুকিয়ে ঘশি তৈরি করে বিক্রি করে দু-মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা করতাম।এভাবেই চলতো আমাদের জীবন।
তখন আসলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাজ নয় বরং কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা করতাম।ক্লাশ ফোরএ একবার ধর্মে ফেল করলাম; কিন্তু বিষয়টি বাড়িতে জানতে দেইনি। কারণ বাবা মাকে প্রচন্ড ভয় পেতাম।পরীক্ষার ফলাফল ভাল না হ্ওয়ায় ক্লাশ ফাইভে আমাকে বৃত্তি পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হইনি।তবে ছাত্র ভাল ছিলাম না, এটি কখন্ও মনে হয়নি।আসলে পড়ালেখা করার মত তেমন সময় কিংবা সুযোগ ছিল না।যা-ই হোক, ক্লাশ সিক্স থেকে নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করলাম। যদি্ও বই খাতাসহ লেখাপড়ার অন্যান্য উপকরণ ছিল না বললেই চলে।তখন কাগজের বদলে বিভিন্ন নির্বাচনি পোস্টার কিংবা ক্যালেন্ডারের পিছনে লিখতাম।
এরমধ্যে ক্লাশ সিক্স থেকে ক্লাশ সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে একটি র্যা ডিক্যাল পর্রিবতন লক্ষ্য করি, আমার মেধাক্রম হয় ৮ম।এ ফলাফলে আমি খুবই খুশি হই এবং আমার লেখাপড়ার গতি অনেক বেড়ে যায়।ফলে ক্লাশ সেভেন থেকে ক্লাশ এইটের বার্ষিক ফলাফলে আমার মেধাক্রম হয় ৫ম এবং আমি প্রচন্ড রকমের সুখ অনুভব করি।এই ফলাফলের পর আমার লেখাপড়ার গতি আরও বেড়ে যায়।যদিও বাবা মাকে সাহায্য করার জন্য কাজ করতিই হত।কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল হ্ওয়ায় পরবর্তীতে তারা কাজের ক্ষেত্রে আমাকে বেশ ছাড় দিতেন।তবে স্কুলে যা্ওয়ার আগে ও স্কুল থেকে আসার পর গরুর ঘাস কাটা ছিল বাধ্যতামূলক।
টাকার অভাবে স্কুলে টিফিন করতে পারিনি কখন্ও । টিফিনের সময় শুধু এক গ্লাস পানি পান করতাম এবং বাকী সময় লেখাপড়া করে বাড়ীর কাজ অগ্রীম শেষ করে রাখতাম।একবার এক বান্ববী প্রশ্ন করেছিল, কী ব্যাপার, তুমি টিফিনের সময় কিছু খা্ও না? তখন আমার উত্তর দেওয়ার ভাষা ছিল না, আমি শুধু বলেছিলাম টিফিনের সময় আমার কিছু খেতে ভাল লাগে না। কিন্তু সত্যি কথা হল-টিফিন খা্ওয়ার মত কোন উপায় আমার ছিল না।একবার আমার স্কুল ড্রেসের র্শাট বানানো হয়েছিল কাফনের কাপড় দিয়ে।র্শাটটি পড়লে খুব খারাপ লাগতো; বিশেষ করে ধো্ওয়ার পর খুব বিশ্রী দেখাতো।এ নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছি কিন্তু নতুন ড্রেস বানানোর আর সাধ্য ছিল না।
ক্লাশ ফাইভে বৃত্তির অনুমতি না পেলেও ক্লাশ এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পেলাম।বিষয়টি আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হল এবং আমি খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম।৮ম শ্রেণিী থেকে ৯ম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে আমার মেধাক্রম হল ৩য় এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি ক্লাশ এইটে বৃত্তি পেলাম।এরমধ্যে আমার মেধাক্রম ৩য় হ্ওয়ার সুবাদে, ইউনিক গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব নূর আলী সাহেবের অনুদানে আমাকে ক্লাশ নাইনের একসেট বই উপহার পেলাম।আমি জনাব নূর আলী সাহেবের প্রতি কৃতগ্গতা প্রকাশ করছি।
৮ম শ্রেণীর বৃত্তি এবং মেধাক্রম ৩য় আমাকে প্রবল আশান্বিত করে তুলে এবং আমার ধ্যান, খেয়াল সবই লেখাপড়ার মধ্যে চলে আসে।এমন্ও হয়েছে, ঈদের দিন, আমার বন্ধুরা আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে কিন্তু ওরা এসে দেখছে আমি তখন্ও কোন এক কোণে কিংবা গাছের নিচে বসে পড়ছি।
এরই মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে, দশম শ্রেণীর প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় বিগ্ঘান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখার মধ্যে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম স্হান লাভ করি।বিষয়টি সমগ্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল।এরপর 1996 এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি।দারিদ্রতার কারনে কেন্দ্রের আশে পাশে বাসা ভাড়া নেয়ার মত সুযোগ ছিল না।প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার পায়ে হেটে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি এবং স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবিক বিভাগ থেকে সবোর্চ্চ নম্বর 795 ( পাচটি লেটার সহ ) পেয়ে এসএসসি পাস করি।এটি আমাদের বিদ্যালয়ের জন্য একটি অনণ্য র্রেকড । কেননা ১৯৪৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেউ আমার এই রেকর্ড ভাংতে পারেনি।আমার অবস্হান ছিল মেধা তালিকায় ঢাকা জেলায় ১ম এবং ঢাকা বিভাগে প্রায় 30তম।শুধু তা-ই নয়, আমার চেয়ে কম নম্বর পেয়ে রাজশাহী এবং কুমিল্লা বিভাগে স্ট্যান্ড করেছে।
এরপর ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। সে এক নতুন যোদ্ব।মাত্র 6’শ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসি।তখন পায়ে পরনে ছিল স্পন্জের স্যান্ডেল এবং হাতে ছিল একটি ক্লিন ফাইল।ঢাকায় বলার মত কোন আত্বীয় ছিল না।দূর সম্পর্কের কিছু আত্বীয় ছিল, কিন্তু তারা বললেন, দু-বেলা খাবার ব্যবম্হা করতে পারবো কিন্তু রাতে থাকার ব্যবস্হা করতে পারবো না।তাই অনেক কষ্টে সাভার থেকে ক্লাশ করতে গিয়ে সকাল বিকেল মিলে মোট চারটি ক্লাশ দৈনিক মিস হত।
তাই ভেবে ছিলাম গ্রামের কোন কলেজে গিয়ে ভর্তি হব।কিন্তু ভাগ্য সু-প্রসন্ন, হোস্টেলে মাত্র ২৭ জনকে সিট দিল এবং এর মধ্যে আমার অবস্হান ২৭তম।ভাগ্য আমাকে রেখে দিল ঢাকা কলেজে।হোস্টেলে সকালে নাস্তা করলে দুপুরে কী খাব, টাকা পাব কই এই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেত।অনেক কস্টে একটি টিউশনি জোগাড় করে তা দিয়ে খুব কস্টে দিন কাটাতাম। আমার এসএসসির ফলাফলে সন্তুস্ট হয়ে দূর সম্পর্কের এক নানা নিয়মিত কিছু আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। তবে সেটা পর্যাপ্ত ছিল না।
ইতিমধ্যে হোস্টেল সুপারের ছেলেকে প্রাইভেট পড়ানোর অনুমতি পেলাম এবং এতে দু-বেলা খাবারের নিশ্চয়তা হলো।হোস্টেলে উঠে, প্রবল আগ্রহ নিয়ে স্ট্যান্ড করার প্রত্যাশায় লেখাপড়া করলাম। যদিও ফলাফল খুব ভাল হল না।মানবিক বিভাগ থেকে প্রায় 700 নম্বর নিয়ে 1998 সালে এইচএসসি পাস করি।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলাম।এখানেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।প্রতিদিন ৪টি টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালাতাম, পাশাপাশি বাবা মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতাম।
বেশি টিউশনি করার কারনে একাডেমিক ফলাফল খুব ভাল হয়নি।তবে ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তির শুরু থেকেই বিসিএসের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল।তাই সেই ভাবে প্রস্তুতিও নিতে থাকি।মাস্টার্স শেষ হ্ওয়ার পূর্বেই 27তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হই; কিন্তু ভাগ্যের র্নিমম পরিহাস, সেটি বাতিল করা হয়।এরপর ২৮তম বিসিএসে অংশ গ্রহণ করি এবং সেখানে উর্ত্তীণ হয়ে বতর্মানে শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত আছি]।
সুপ্রিয় পাঠক, আমার জানা এই বাস্তব কাহিনীটি শেয়ার করার একটি উদ্দেশ্য আছে।আমি ইউটউবে কিছু সফল লোকের আত্বকাহিনী পড়ে অনেক প্রেরণা পেয়েছি।আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার শেয়ার করা এই কাহিনীও কাউকে না কাউকে অনু্প্রাণিত করতে পারে।আসলে জীবন পু্ষ্পসজ্জা নয়। এখানে প্রতিটি মুহূতেই কোন না কোন বাধা, বিপত্তি কিংবা প্রতিকুলতা আসতে পারে।এই বাধা, বিপত্তি অতিক্রম করার নামই সফলতা।তাই যারা মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, আমি পারব না, আমার টাকা পয়সা নেই, আমার মামা খালু , ধুলা ভাই নেই, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি-উনার কোন আপন মামা, ধুলা ভাই নেই, তার পিতার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করলেও ৩ লাখ টাকা হবে না কিন্ত তিনি ৫টি চাকুরী পেয়েছে এবং প্রতিটি চাকুরীই ভাল মানের-যেমন: 27তম বিসিএস, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, স্ট্যার্ন্ডাড ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার, সোনালি ব্যাংকের সিনিযর অফিসার, 28তম বিসিএস।
আপনারা যারা আমার লেখাটি কষ্ট করে পড়েছেন, তাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, আপনারা দয়া করে আপনাদের ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে এই লেখাটি শেয়ার করবেন।হয়ত এই কাহিনীই বদলে দিতে পারে আপনার ছেলে মেয়ে কিংবা ছোট ভাই বোনের জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ২:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




