somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৫৭৫, ইন্দিরানগর, মধ্যরাতের ক্যাফেইন......।।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
৫৭৫, ইন্দিরানগর,
মধ্যরাতের ক্যাফেইন......।।



ধ্রাঘিমাংশের একটু বেশি কাছে হওয়ায় এমনিতেই এখানে শিত বা গরম দুটোই কম। মাঝে মাঝে ফিফত মেইনের ঠিক এই যায়গায় বিকেলের দিকে ছাদে না উঠলে উত্তর দক্ষিণ বোঝার উপায় নেই। বিকেলে টু মেরেছিলাম, মিক্সড পিজি হবার কারনে বিকেলের দিকে উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে একটু ভিড় বেশি। ভারতের সবচেয়ে সুবজ শহরের একটা হওয়াতে গাছে গাছে পাখির সাথে বানরেরও দেখা মেলে। শহরটা আসলে এই শহুরেদের নেই, পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে মানুষ এসে গোঁজামিলে ভরে গেছে। তবে আশার ব্যাপার হলো, শহর এই বহুবর্ণের মানুষগুলোকে মুহুর্তেই আপন করে নেওয়ায় কাউকেই ফিরে যেতে হয় না।

সাথে সাথে প্রযুক্তি এতটাই আঁকড়ে ধরেছে যে মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্বও ভুলতে বসেছে। ছাদের অংশে অংশে দাঁড়ানো জনাত্রিশেক মানুষের ভীড় কতটাই প্রাণবন্ত হত যদি সবার হাতে হাতে মোবাইল বা ট্যাব না থাকতো, কানে লাগানো হেডফোনটা না থাকলে পাখীর ডাকগুলো সুমধুর মনে হত অথবা বানরের ডাক। এখানের বানরগুলোও ইদানিন কর্পোরেট হয়ে গেছে, ওরা কি পারে না কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে ভোঁ-দৌড় দিতে ! বড্ড বেশি ভদ্রমানুষের শহরের বানর বলেই হয়ত এই দুষ্টমি তাদের কাম্য নয়। মাঝে মাঝে একটু উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারগুলো দেখে যায় মনুষ্বসৃষ্টি বিবর্ন বিকেলটা। রোমান্টিসিজম এখন প্রকৃতি থেকে সরে দিনদিন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে । চারপাশে তাকিয়ে ঘুরে ঘুরে সবার দিকে দেখছিলাম, সুনীলের ভাষায় বলতে হয় “কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি”

বাড়ীর এই ছাদ আমাকে আমাকে বিবর্ণ বিকেল উপহার দেওয়ায়, মুহুর্তেই বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। মাল্টিকালচারাল এই শহর সত্যি আমাকে কতটা আপন করে নেবে জানি না। অচেনা শহরে একা একা ঘোরা বোকামি, যদিও প্রযুক্তি এখানে কিছুটা আপন হয়ে পাশে দাড়িয়েছে, ম্যাপ ! কিন্তু গন্তব্যই যেহেতু নেই সেখানে এটাও গৌণ। নীরস একাকীত্ব আপনার সমস্ত আনন্দকে বিলীন করে দেবে, তবুওযে মেনে নিতে হয়। চারপাশে ছড়ানো ছেটানো বৃক্ষকূলে ভরা পার্কগুলো কিছুটা হলেও একাকীত্বকে দূরে ঠেলে দিলো।
“নিউ হেয়ার ?”
“ইয়াপ”
“হুম”।
কি ভদ্রাচরন !! এটুকুওই ? কথা কম বলা ভালো তাইবলে এমন, আধুনিকতা আর পাওংচুয়ালিটির ভিড়ে মানুষগুলো দিন দিন মনুষ্যত্বকে বিক্রি করে দিচ্ছে। আবারও নিজেকে বড্ডবেশি একা লাগতে শুরু করে। এতক্ষনে ৪/৫ লুপ নিয়ে ফেললাম, আমি হাটছি আর পাশের মানুষগুলো দৌড়োয়। বড্ডবেশি বিবর্ণ বিকেলটাকে ফেস করতে করতে হাপিয়ে উঠেছি, নিরুদ্দেশ গন্তব্যে হাটতে গিয়ে ঠাই হলো ইন্দিরানগরের এস্পেলেন্ড রেস্টুরেন্ট। এই প্রথম নিজেকে আত্মার বন্ধনে খুজে পেলাম, আশাপাশের একমাত্র বাঙালী রেস্টুরেন্ট। সময়ের বিবর্তনে বাঙ্গালী সেপ, ওয়েটার হারিয়ে গেলেও বাঙ্গালী স্বাদটা ঠিকই রয়ে গেছে। দই মিষ্টির অভর্থনার সাথে শুরু হলেও আজকের দিনে এখানের চিংড়ী কোর্মা আর সাদাভাত ছিলো জিভে লেগে থাকার মত। বেশ আধুনিকতার অক্টোপাসে বাঁধা এই শহরে একটুকরো আপন স্বাদ আমার সারাদিনের ভগ্নহৃদয়কে বেশ উৎফুল্ল করে তুলল। সন্ধার পরপরেই এই ক্ষুদার্থ পেটে আঙুল চেটে খাওয়ার অভ্যাসতো একজন বাঙালীরই হয়।

প্রথমবারে এত লম্বা পথে ট্রেন ভ্রমনের ঘুম না আসা অন্যরকম ক্লান্তি নিয়ে ছাদে উঠে এলাম, মধ্যরাতে ফাকা ছাদটা বেশ লাগে। দোতলা বাড়ীর উপরাংশে রোডলাইটের নিয়ন আলো যেন আছড়ে পড়ে, মনে হলো রাতের এই সময়টায় এখানে কেউ আশে না। পিজির বেশীরভাগই ছাত্র হওয়ায় সবাই সবার রুটিন মেপেই চলে, কোলাহলময় এই ছাঁদটা আমার কাছে এখনই সবচেয়ে নিরাপদ। আশেপাশের সব বাড়িগুলো দোতলা/তিনতলার বেশি না হওয়ায় খুব বিস্তৃত ভাবেই রাতের আকাশ দেখা যায়। নিস্তব্ধ রাতে নিয়নের আলোতে আশেপাশের সব কিছুই যেন একই রকম দেখতে, অনেকটা ভিনেগারে ভেজানো সালাদ ! ছাঁদের দরজাটা ধুম করে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেলো, ওদিকে আমার খেয়াল নেই। হোকনা বন্ধ, নাহয় সকালেই নিচে যাবো! বন্ধুবিহীন এই শহরে আমার দিন বা রাত যে একই রকম।
আবার দরজাটা খুলে গেলো, দু-হাতে বেশ বড়ো সাইজের দুটো মগ নিয়ে এদিকেই দিকেই হেটে আসছে কেউ। ওই যে বললাম, নিয়নের আলোতে সব কিছু একই রকম দেখায় ! মানুষকে মানুষ দেখায়, মেয়েকে মেয়ে মাত্র। কোন কিছু না বলে এক হাতে মগটি এগিয়ে দিল, আমিও কোন কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম, ততক্ষনে চারপাশে ক্যাফেইনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। ক্যাফেইনের মাতাল গন্ধযুক্ত কালো কফিমগে চুমুক দিয়ে এক সুমধুর বন্ধুত্বপূর্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

হটাত যেন যেন একপশলা বৃষ্টি নেমে এলো ! ধুয়ে পবিত্র করে দিয়ে গেলো আমার চারপাশ। বৃষ্টি না হোক, হতে পারে সেটা ক্যাফেইনের গন্ধ। এখানে আসার পর থেকে নিজেকে গুমোট অন্ধকারে আটকা কোন অদ্ভুত দোপেয়ো জীব মনে হলেও এই প্রথম মানুষ মনে হতে লাগলো। আমি চারিদিকের নিয়নের অস্পষ্ট আলোকে ভেদ করে আকাশের দিকে তাকাই।
“হ্যালো, কথা বলছেন না যে !”
“না মানে আপনি বাঙ্গালী?”
হতে পারে না ? আকাশ থেকে পড়লেন বুঝি ! এটাতো বাঙালীদেরও দেশ, নাকি”
নিজেকে একটু লজ্জিত মনে হলো, এই প্রথম আমি ভালো করে তাকালাম তার দিকে ! আহা, এতো পার্কের সেই মেয়েটা।
“আসলে এখানে আসার পরে চারিদিকের যান্ত্রিক জীবনে মানুষের রোবটময় চালচলন আমাকে গুমোট অন্ধকারের পানিবিহীন গভীর কুপে নিক্ষেপ করেছিলো”।
“তাই ? তা কূপের অন্ধকারে অক্সিজেনের সমস্যা হয়নি?” আলতো হাসে মেয়েটি। বোঝা গেলো বেশ মজা করতে পারে,
নিজের বাঙালীত্ব কাটিয়ে কফির মগে চুমুক দিলাম, কালো কফির ক্যাফেইন আমাকে বেশ টানে। চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশে অন্যরকম স্বস্তি ফেরানো বাঙালী মেয়ের হাতে এই ভিনদেশি গরম পানিয় আমাকে অস্তিত্বে ফেরাতে সাহায্য করে।
“আসলে আজভোরেই এলাম ! একটু একা লাগছে আর কি...।
“এটা ভালো শহর, মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না”
“আচ্ছা কি করে বুঝলেন আমি বাঙালী?”
“বিকেলে ছাদে দেখলাম, পরে একাকি পার্কে ! সাথে কেউ নেই... পরে এস্পেলেন্ড!”
“ওহ, অনেকটা এমন নয়কি যে নতুন কেউ হারিয়ে না যায় তাই তাকে ফলো করা !”
“হা হা, মোটেও তা নয়। এগুলো আমার রুটিন ওয়ার্ক ছিল। দুপুরে আর বিকেলে আমি ওখানটায় খাই, অনেকটা ঘরোয়া খাবার পাওয়া যায়।”
“তাহলে কি ধরে নেবো, কাল লাঞ্চ ও ডিনারে আমার সামনের চেয়ারটি খালি পড়ে থাকবে না”
“হতে পারে, আবার নাও পারে ! দেখা যাক”
আবার চুপ থাকে মেয়েটি, বোঝা গেলো হাতের মগের কফি শেষ, বেশ রাত বেড়েছে ! “ আচ্ছা, আমাকে যেতে হয় যে ! মগটা শেষ?”
“হ্যা, তবে একটু আবদার রয়ে গেলো যে, বলতে পারেন অনধিকার চর্চা।”
অবাক চোকে চোখের উপরে ঘুরে আসা গুচ্ছ চুল সরায় মেয়েটি, “ বলুনতো।”
“আরেককাপ কফি হবে? ঘুমতে পারবো না যে আজ !”

হ্যা সূচক জবাব দিয়ে একটু হাসে মেয়েটি, হাত থেকে মগটি নিয়ে যায় আসছি বলে ! বাঙালীময় পৌরষত্ব জাগিয়ে সটান বুকে আকাশের দিকে তাকাই, নিজেকে আর একা লাগে না। বর্ণহীন ভাবনাগুলো কোন দৃশ্যমান মানবী ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়ে গেলো।
কখনো কখনো আমাদের ভালোলাগাগুলো কাল বিকেলের জন্য জমা করে রাখি। কারন এর কোন আবিধানিক ব্যাখ্যা থাকে না অথবা শেষরাতে ব্যাখ্যাগুলো খুজে না পেয়ে নির্দয় ঘুম ভর করে ফেলে। হয়ত তা কাল বিকেলে মানুষের ভিড়ে খুজে পাবোনা।
ভালোলাগার গতি শ্লথ হয়ে যাক, কিন্তু কালের গহ্বরে মিলিয়ে না যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:১১
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×