somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনী (বেতিয়ারায় স্মৃতিসৌধ)- মৃণাল কান্তি মজুমদার

০৩ রা অক্টোবর, ২০১০ রাত ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পাক-বাহিনীর ব্রাশফায়ারে নিহত নয় সহযোদ্ধার লাশ দাফন করতে হয়েছিলো আমাকেই..



নভেম্বর ১৯৭১ইং সনের প্রথম সপ্তাহ। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবস্থান করছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত “আর্টস্ এন্ড ক্রাফটস্” কলেজের হোস্টেলে। আগরতলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিপনী মোড় “কামান চৌমুহনী” থেকে পূর্ব দিকে পাঁচ শত (৫০০) গজ দূরে মালতি নগরের জেল খানার পাশে দোতলা এই বিশাল ভবনটি ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দ্রিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার মে’ ১৯৭১ ইং সালে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র নেতাদের অবস্থানের জন্য বরাদ্ধ দেন। হোস্টেলটি মূলতঃ প্রশিক্ষণ প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক জ্ঞান, দেশপ্রেমে উৎসাহিত করা, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ছাত্র নেতৃবৃন্দকে সংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার “ট্রান্জিট ক্যাম্প” হিসেবে পরিচালিত হয়।

আগরতলার এই “ট্রান্জিট ক্যাম্পটির” সমন্বয়কারী ও সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন, নোয়াখালীর বিশিষ্ট প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নোয়াখালী জেলা ন্যাপ (মো.) এর সেক্রেটারী প্রয়াত শেখ্ মোহাম্মদ আবদুল হাই এডভোকেট। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের নামকরা রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ ক্যাম্পটিতে সাময়িক অবস্থান করতেন। এদের মধ্যে যাদের কথা মনে পড়ছে, জাতীয় পর্যায়ের ন্যাপ (মো.) নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ, মাওলানা আহ্মেদুর রহমান আজমী, ছাত্র নেতা শাহ্ আলম, সাইফুদ্দিন আহ্মেদ মানিক, নোয়াখালীর ন্যাপ (মো.) নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ্জাহান, ট্রেডইউনিয়ন কেন্দ্রের ফেনীর নেতা জয়নাল আবদিন। ছাত্র নেতাদের মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষের মেধাবী ছাত্র এম.এম. আকাশ ভাইয়ের কথা (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ)। আকাশ ভাই হাইপাওয়ার চশমা পরতেন। হোস্টেল এর নিচ তলায় রিলিফের দেওয়া কম্বলের বান্ডিলের উপর শুয়ে পড়ে প্রচুর লেখা পড়া করতেন। স্বল্প সময়ের জন্য দেখা পেয়েছিলাম প্রখ্যাত কমিউনিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাবু অনিল মুখার্জির।

নোয়াখালীর জেলা ন্যাপ (মো) নেতা শেখ্ মোহাম্মদ আবদুল হাই এড্ভোকেট সাহেব আমার প্রিয়ভাজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বৃহত্তর নোয়াখালীর জেলা পর্যায়ের তুখোড় ছাত্র নেতা হিসেবে (ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)) ষাটের দশকে আইয়ুব-ইয়াহিয়া বিরোধী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকার কারণে, হাই সাহেব আমার উপর অগাধ রাজনৈতিক বিশ্বাস/ আস্থা রাখতেন। গোপনে ডেকে নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধাদের “পলিটিক্যাল মটিভেট” করার জন্য কিছুদিন আগরতলার ক্যাম্পে থাকার নির্দেশ দেন। এর আগে আমার সহযোদ্ধা নোয়াখালী অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার এড্ভোকেট সারওয়ার-ই-দীন এর নেতৃত্বে ২৪ সদস্যের একটি গ্রুপ ও আরও বেশকিছু সহযোদ্ধা ভারতের তেজপুর থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র লড়াই শুরু করে।
সীমান্ত এলাকায় তখন চলছিল পাক-বাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়মিত গোলাবিনিময়। সময় গড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা আরো বেড়ে চল্ল। এমনি অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (নরসিংদি জেলার কয়েজনসহ) একদল শিক্ষিত তরুণ ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত যৌথ বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ট্রেনিং শেষে আসামের তেজপুর থেকে আগরতলার ক্যাম্পে এসে হাজির হল। ঢাকা অভিমুখী আখাউড়া ও কসবা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার সব পথ যুদ্ধের তীব্রতার কারণে বন্ধ হয়ে গেল। আমার উপর গোপন নির্দেশ এল, ছাত্র নেতা ইয়াফেস্ ওসমানের কমান্ডে বিশেষ গেরিলাবাহিনীর ঢাকা জেলার একটি গ্রুপ আগরতলা থেকে বাংলাদেশের সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, রামগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর হয়ে ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষিণ ত্রিপুরার উদয়পুর, বিলোনিয়া, রাজনগর, চোত্তাখোলা ও একিনপুর এলাকায় এর আগে দু’বার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসা যাওয়ার কারণে সকল ক্যাম্প ও পথ ঘাট সবই আমার চেনা-জানা ছিল। দক্ষিণ ত্রিপুরায় আসা-যাওয়ার পথে যোগাযোগ হয়েছিল, রাজনগর “ইয়ূথ ক্যাম্পের” ক্যাম্প চীফ অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ (এম.এন.এ) ও ক্যাম্পটির প্রধান সমন্বয়কারী এড্ভোকেট জয়নাল আবেদিন সাহেবের সাথে। বিলোনিয়া শহরের ক্যাম্পে যোগাযোগ হয়েছিল ফেনীর বিশিষ্ট ছাত্র নেতা আবু তাহের ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের শ্রমিক নেতা জয়নাল আবদিন ও সাহাবুদ্দিনের সাথে। উদয়পুরে যোগাযোগ হল নোয়াখালীর খোলামনের রাজনীতিবিদ আওয়ামীলীগ নেতা সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার (কচি ভাই) এর সাথে। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্বে সবসময় তৎপর ছিলেন।

যুদ্ধের ভয়াবহতায় আগরতলা শহরের লাখো মানুষ কম্পমান-ভীত সন্ত্রস্ত। কখন জানি আগরতলায় পাক-বাহিনীর কামানের গোলা এসে পড়ে? দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়ার পথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর “কনভয়” চলা চলও বেড়ে চলছিলো। নানা গুঞ্জন-নানা কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি আগরতলা শহর আক্রমন করে? এমনি এক ভীতিকর অবস্থায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঢাকার সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য আমাকে শেষবারের মত আগরতলা ত্যাগ করতে হল। আগরতলায় অবস্থানরত নোয়াখালী পৌরসভার তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার জনাব আবদুল গোফরান সাহেব বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য আমাদের সাথে যোগ দিলেন। আগরতলা থেকে ইয়াফেস্ ওসমানের কমান্ডে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর গ্রুপটি নিয়ে বাস ও জীপ গাড়ী যোগে ৯ই নভেম্বর ১৯৭১ইং সন্ধ্যা বেলা চোত্তাখোলা এসে পৌঁছাই। মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেওয়ার একমাত্র বিশ্বস্ত “গাইড” আবদুল কাদের মিয়ার সাথে লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করলাম। পরদিন ১০ই নভেম্বর ১৯৭১ইং বিকেলে কাদের মিয়া এসে আমার সাথে কথা বলল্। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংকরোডে পাক-বাহিনীর চলাচল বেড়ে গেছে। চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দীঘিতে ওদের ক্যাম্প রয়েছে। আজকে এত লোক নিয়ে যাওয়া যাবে না। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি খোঁজ খবর নিয়ে শীঘ্রই আবার আসব।

“গাইড” আবদুল কাদের মিয়ার বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার “গুণবতী” এলাকায়। বাংলাদেশের “বেতিয়ারা” গ্রাম দিয়ে “ভৈরব টিলা” হয়ে ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় তাঁর অবাধ আসা যাওয়া। কাদের মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অতি কাছের মানুষ। একটি পরিচিত নাম। মুক্তিযোদ্ধা পারাপারের জন্য কাদের মিয়াকে মাথা পিছু ৫/- (পাঁচ) টাকা করে দিতে হত। পারাপারের সময় কাদের মিয়া “ভৈরব নগর গোয়েন্দা ক্যাম্পের” মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশেষ যোগাযোগ রক্ষা করত। ভৈরব নগর ক্যাম্পটি চোত্তাখোলা থেকে পশ্চিমে সীমান্তের কাছাকাছি তিন পাহাড়ের মাঝের পাদদেশে অবস্থিত। গোয়েন্দা ক্যাম্পের সদস্যরা সর্বদাই ভারতে ট্রেনিং সমাপ্তকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র-সস্ত্রসহ প্রবেশের সার্বিক সহযোগিতা করত। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্রীজ-কালভার্ট ধ্বংস করে পাক-বাহিনীর সহজ যোগাযোগ/ চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করার জন্য মূলতঃ “ভৈরব নগর সাব-ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্যাম্প-ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন সুশিক্ষিত, সুদর্শন, সাহসী যুবক জিয়াউল হোসেন জিবু। জিবু ভাই’র বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড সংলগ্ন চৌদ্দগ্রাম থানার “গাংরা” গ্রামে।

আমরা গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা “চোত্তাখোলা” বাজারে ছনের ছাউনিতে ঘেরা কাঁচাঘরে সাময়িক অবস্থান করছিলাম। ১১ই নভেম্বর ১৯৭১ ইং রাত ১০টা। গাইড আবদুল কাদের মিয়া হঠাৎ করেই চোত্তাখোলায় হাজির হল। কাদের মিয়া আমাকে দাদা বলে ডাকত। ডাক দিয়ে বলল, “দাদা ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড আমি “রেকি” (সামরিক ভাষা) করে আইছি। আইজ রাতে পাকিস্থানী আর্মির কোন টহল আইবোনা। আপনারা সবাই আস্তে আস্তে রেডি হইয়ালন। ভোর অহনের আগেই ট্রাংক রোড পার হই যামু ইনশা-আল্লাহ্”। একটানা কথা গুলো বলে শেষ করে কাদের মিয়া। কাদের মিয়ার কথায় আমরা সবাই খুশী পুলকিত।এমনি অবস্থায়, আমরা সকল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা যার যার পোশাক, জুতো, প্যান্ট, জাম্পার, কাপড়ের ব্যাগ, রাইফেল, ষ্টেনগান, এল.এম.জি. মর্টার ও হ্যান্ড গ্রেনেড সহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলাম। ছনের ছাউনির ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই বাজারের রাস্তায় দাঁড়ালাম। চোত্তাখোলা বাজারের পথের পাশেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি “আর্টিলারী সেক্শান” কয়েকদিন আগে এখানে এসে অবস্থান করছে। রাশিয়ার তৈরী দু’তিনটি কামান পাহাড়িয়া জঙ্গলের ভেতরে বাংলাদেশের দিকে তাক করে বসানো হয়েছে।

গাইড আবদুল কাদের মিয়ার ইশারায় আমরা হাঁটা শুরু করলাম। চোত্তখোলা থেকে পশ্চিমে পাহাড়িয়া উঁচু-নিচু সরুপথ বেয়ে “ভৈরব নগর ক্যাম্পে” এসে পৌঁছালাম। ক্যাম্পের সদস্যরা আমাদের সহযোগীতা করতে বেরিয়ে এলেন। এগিয়ে এসে জিয়াউল হোসেন জিবু ভাই চারজন সদস্য (১) নায়েক আবদুল মালেক, (২) আমিন উল্যা (কানু), (৩) ডাঃ আবদুস সবুর চৌধুরী, (৪) আবদুল মন্নানকে আমাদের গেরিলা গ্রুপটিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড পারহয়ে যাওয়ার পথে সাথে থেকে সহযোগীতা করার নির্দেশ দিলেন। “ভৈরব নগর ক্যাম্পে” আমরা কিছ ুসময়অবস্থানের পর “ভৈরবটিলাতে” এসে পৌঁছালাম রাত ৩-৩০ মিঃ। ঢাকার কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ বেশ কয়েকটি রাইফেল ও ষ্টেনগান ওপেন করে বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

আবছা অন্ধকার আর কিছু জোনাকীর মিট্ মিট্ আলো। চারিদিকে নিঃস্তব্ধতা। ভৈরব টিলা থেকে পশ্চিমে নেমে ঢুকে পড়লাম “নো-ম্যানস্ ল্যান্ডে” বাংলাদেশের সীমানায়। হঠাৎ নিজেকে হাল্কা বোধ করলাম। অনুভব- অনুভূতির দোলা খেলায় হৃদয়ে মাতৃভূমি স্পর্শের আনন্দ জেগে উঠল। যুদ্ধ- মৃত্যু- ভয়- শংকার মাঝে থেকেও মনে পড়ে গেল সংস্কৃত ভাষার প্রচলিত শ্লোকটির কথা। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী” অর্থাৎ “মা এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও উৎকৃষ্ট” গাইড আবদুল কাদের মিয়ার গাইডে গ্রুপ কমান্ডার ইয়াফেস ওসমানের নেতৃত্বে এগিয়ে চলল ৬০ (ষাট) জনের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রুপ। ঢুকে পড়লাম বাংলাদেশের ভেতরে, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামে। ছোট্টগ্রাম। মাত্র কয়েকটি বাড়ি। পূর্ব দিক থেকে পাকা মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে পশ্চিমে সোজা সরু পথ দক্ষিনে বাঁক খেয়ে ১৫০ থেকে ২০০ গজ দূরত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের সাথে মিলিত হয়ে, সোজা পশ্চিমে “গুনবতী” রেলওয়ে ষ্টেশানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে নোয়াখালীর “কানকির হাট” হয়ে সেনবাগ থানার অভ্যন্তরে গিয়ে শেষ হয়েছে।

সামরিক নির্দেশনা মোতাবেক ১০ গজ দূরত্ব বজায় রেখে একলাইনে আমরা এগিয়ে চললাম। সবার আগে “গাইড” আবদুল কাদের মিয়া। পেছনে রাস্তার বাঁকের মাঝামাঝি আমি। আমার পেছনে ইঞ্জিনিয়ার গোফরান সাহেব। চোখ রাখলাম সামনের ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের দিকে। রাস্তার বাঁকের পশ্চিমে দু’একটি খেজুরের গাছ। পথের দু’পাশে ধানের ক্ষেতে সামান্য চির চিরে জল। হেমন্তের শেষ রাতের আকাশ কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন। হঠাৎ মেশিনগানের গুলির শব্দ ! ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের পশ্চিম পাশ থেকে পাকিস্থান সেনাবাহিনীর ব্রাশফায়ার !! লাল অগ্নিচ্ছটা। কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল সম্মুখ ভাগ। আমরা পথের বাঁকে ও পেছনের লম্বা লাইনে যারা ছিলাম, দাঁড়ানো থেকে পথের পাশের নিচে শুয়ে পড়লাম। লাইনের সামনে আক্রান্ত গুলিবিদ্ধ কয়েকজনের আর্তনাদ! সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে কয়েকটা রাইফেল/ষ্টেনগানের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

কাউন্টার এ্যাটাক? সাথে সাথে বিমর্ষ আতংকিত অবস্থায় একটু সাহস ফিরে পেয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড লক্ষ্য করে ডান হাতের কবজির সব জোর খাটিয়ে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলাম। গ্রেনেড ব্রাষ্টের বিকট আওয়াজের সাথে সাথে ধোঁয়ায় ভরে গেল পশ্চিমদিক। পাক-হানাদার বাহিনীর ফায়ার চলতে থাকল। পরিকল্পিত আক্রমনের মুখে আমাদের বেশীক্ষন লড়াই করে টিকে থাকা সম্ভব হলো না। “শত্রুকে আঘাত করো নিজেকে বাঁচাও” প্রশিক্ষণের কথাটা মনে রেখে রাস্তার নিচু পাশ ঘেষে শুয়ে পড়ে “ক্রোলিং” করে পূর্ব দিকে এগুতে থাকলাম। সূর্য্য উঠার অনেক আগেই আমরা যারা বেঁচে ছিলাম, সবাই ভারতের “ভৈরবটিলাতে” গিয়ে পৌঁছালাম।

১১ই নভেম্বর ১৯৭১ ইং ভোর রাতেই পাকহানাদার বাহিনী “বেতিয়ারা” গ্রামে ঢুকে অত্যাচার চালায়। গ্রামছাড়া সব মানুষ। পরদিন অনেক গ্রাম বাসীকে ভারতের সীমানায় চলে আসতে দেখলাম। অনেকে প্রাণ ভয়ে পরিবার- পরিজন নিয়ে বেতিয়ারার পশ্চিমে নিকটবর্তী গ্রামে চলে যায়। সেদিন ভোরে বেতিয়ারার মসজিদে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ফজরের নামাজের আযানের ধ্বনি শোনা যায়নি, হয়তোবা কোন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাওয়া হয়নি।

সংগ্রামী যোদ্ধাদের দুঃখ বেদনার এ-এক নিদারুন বাস্তব চিত্র। ফিরে দেখা হলোনা আর আত্মত্যাগী রনাঙ্গনের সাথী যোদ্ধাদের সাথে। গাইড আবদুল কাদের মিয়া, কাইয়ূম, জহিরুল হক (দুদু), আওলাদ হোসেন, সিরাজুল মুনির, শফিউল্ল্যা, মোঃ শহীদ উল্ল্যা, বশির আহাম্মদ, নিজামুদ্দিন আজাদ সহ মোট ৯ (নয়জন) বেতিয়ারার ওই যুদ্ধে শহীদ হন।

“ভৈরবটিলাতে” থাকা খাওয়ার কোন সুযোগ নেই। একমাত্র “মন্টুবাবুর” চা-এর দোকানই ভরসা। আমরা হত বিহ্বল অবস্থায় প্রথমে ভৈরব নগর ক্যাম্পের সকল মুক্তিযোদ্ধা ও পরে চোত্তাখোলায় গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দূর্ঘটনার এখবর জানালাম। ভৈরব নগর ক্যাম্পে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও জিয়াউল হোসেন জিবু ভাইয়ের সদস্যদের সাথে মিটিংশেষে সিদ্ধান্ত ক্রমে তারা “আর্টিলারী কভারেজ” দিয়ে আমাদেরকে ১৩ই নভেম্বর ১৯৭১ ইং সকালে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

মানুষ শূন্য বেতিয়ারা গ্রাম। ধানের ক্ষেতে রোদের ঝিলিক। হিমেল বাতাস। দেখা মিললোনা কোন গ্রামবাসীর। দ্রুতলয়ে এগিয়ে চললাম। পূর্বদিক থেকে আসা সরু কাঁচা পথের দক্ষিনে বাঁক পেরিয়ে সামনে এগুতেই রাস্তার দু’পাশে ধান ক্ষেতে কাদা মাটি দিয়ে লাশ গুলোকে সামান্য পুঁতে রাখা অবস্থায় দেখে চমকে উঠলাম। কয়েকজন মৃত সহযোদ্ধার হাত পা কাদা মাটি ভেদ করে দেখা যাচ্ছিল। আবেগ অনুভূতির মর্মবেদনায় নিজেকে সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছিল। বেশীক্ষণ দাঁড়াবার সাহস পেলাম না। শহীদের লাশ গুলোকে কবর দেওয়ার জন্য হয়তোবা কোন হৃদয়বান গ্রামবাসী এখানে আসতে সাহস করেনি। সহযোদ্ধাদের নীরব কান্নায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। পাক-হানাদার বাহিনীর এই নিষ্ঠুর বর্বরতা আমাকে আজও শিহরিত করে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড পার হয়ে পশ্চিমে “গাংরা” গ্রামের নিরাপদ স্থানে এসে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম। সীমান্তে অবস্থানরত জিয়াউল হোসেন জিবু ভাইকে লোকমারফত শহীদের খবরটা জানালাম। খবর শুনে দ্রুত সিদ্ধান্ত জালালেন, এখনই চৌদ্দগ্রাম- জগন্নাথদীঘি অঞ্চলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট লোক মারফত “চরমপত্র” পাঠাবেন। শহীদের লাশ গুলো সন্ধ্যার আগেই যেন কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। না হয় চেয়ারম্যানের জন্য “কাফনের কাপড়” পাঠানো হবে। চরমপত্রে কাজ হয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই শহীদের লাশ গুলোকে তুলেনিয়ে ট্রাংক রোডের পূর্ব দিকে গর্তকরে গণকবর দেয়া হয়।

গেরিলা গ্রুপটি নিয়ে প্রথমে বেগমগঞ্জের কাজীর হাট হয়ে বিশেষ গেরিলা গ্রুপের হেডকোর্য়াটার চাটখিলের মুক্তগ্রাম দৌলতপুরের ট্রানজিট ক্যাম্পে পোঁছাই। গেরিলা কমান্ডার এড্ভোকেট সারওয়ার ভাই (ছাত্তার কমান্ডার) এর সহযোগীতায় ফরিদগঞ্জ চাঁদপুর হয়ে ঢাকা অভিমুখে গ্রুপটি চলে যায়। গেরিলা গ্রুপটির সদস্য হিসাবে যাদের কথা মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন; গ্রুপ কমান্ডার ইয়াফেস ওসমান, (বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য) মঞ্জুরুল আহ্সান খান, (সি.পি.বি’র সভাপতি) নুর আলী, (ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী) ও আবদুল হামিদ, (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল)। আমি নোয়াখালী অঞ্চলের যুদ্ধকালীন গেরিলা বাহিনীর জেলা কমান্ডার এড্ভোকেট সারওয়ার-ই-দীনের কমান্ডে নোয়াখালীর বিভিন্ন রনাঙ্গনে সক্রীয়ভাবে অংশ গ্রহণ করি। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ইং নোয়াখালী শহর মুক্ত হবার পর আমরা মাইজদী পি.টি.আই-তে ক্যাম্প স্থাপন করি।

এই “বেতিয়ারা” গ্রামেই ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডের পশ্চিম পাশে নির্মিত হয়েছে শহীদদের উদ্দেশ্যে স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর ১১ই নভেম্বর এই স্মৃতিসৌধের পাদদেশে সমাবেশ/আলোচনার মাধ্যমে জাতীয়ভাবে “বেতিয়ারা দিবস” নামে দিবসটি পালিত হচ্ছে। শহীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত বেতিয়ারা গ্রাম আজ বাংলাদেশের জনগণের কাছে অতি পরিচিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম গামী বাস যাত্রীদের প্রতি দিনই চোখে পড়ছে বেতিয়ারা শহীদ মিনার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে, মুক্তিযুদ্ধের এ এক অনন্য নিদর্শন। স্মৃতিসৌধের পাশেই শহীদদের দ্বিতীয় পাকা কবর।

স্বাধীনতার পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হোসেন জিবুর উদ্যোগে ডাঃ সবুর চৌধুরী, মাষ্টার মুজিব, মাষ্টার আলী আকবর ফরাজী, মালেক, মতি ও আতাখানের সার্বিক সহযোগীতায় চাঁদা তুলে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক মাওলানা আবেদ আলী সাহেবের মাধ্যমে জানাযা দিয়ে শহীদদের স্মৃতিসৌধের পাশে দাফন করা হয়।

কাল পরিক্রমায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও বেঁচে আছি মুক্ত স্বদেশে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা। হে আমার বাংলাদেশ তোমাকে লাল সালাম।
লেখক পরিচিতি : মৃণাল কান্তি মজুমদার
বেতিয়ারা শহীদদের সহযোদ্ধা।
অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (বি.এ.ডি.সি)
সহকারী কমান্ডার (দপ্তর)
নোয়াখালী সদর উপজেলা কমান্ড।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
নোয়াখালী।
মোবাইলঃ- ০১৮১৯৮৫৫০৮৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×