মনে পড়ে জীবনে প্রথম ছবি একেছিলাম মায়ের হিসাবের খাতায়। মায়ের ছিলো খুব অদ্ভুত রকমের সুন্দর একটা জাপানীজ কলম। এক জাপানী মেম কলমটা মাকে দিয়েছিলেন। দেখতে একদম খাপ খোলা একটা লিপস্টিক। গোলাপী লিপস্টিকটা মাথা বের করে আছে। এই কলমটার উপর আমার যে কি পরিমান দূর্বার ঝোঁক ছিলো, তা বলে বুঝাতে পারবোনা। সুযোগ পেলেই মা যখন রান্নাঘরে বা পাশের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন, আমি থাকতাম তক্কে তক্কে। কলমটা খুলেই আঁকিবুকি শুরু করতাম। সেটা ছিলো ঝর্না কলম । অমন কলম আজকাল আর দেখিনা। তবে কি যে ভালো লাগে কলমটার কথা ভাবতেই। তবে মা আমার শখটার মোটেই মূল্য দিতেন না। আমি তার কলম ধরলেই কি করে যেন তিনি বুঝে যেতেন । আর তারপর পিঠের উপর দুমদাম আর আমার ত্রাহী চিৎকারে দাদু, ফুপু, চাচা, চাচীরা কেউ এসে বাঁচাতেন আর বলতেন "আহা এমন করো কেনো? ও বড় হয়ে পাবলো পিকাসো হবে। "
মায়ের খোপকাটা কুমকুমের বাক্সটা, সে যে কি সুন্দর আরেক ভালো লাগা। আজকাল তো সেটাও আর দেখিনা। একটা গোল বক্সে ঠিক ওয়াটার কালারের মত থরে থরে সাজানো গোল গোল নানান সব লাল নীল, হলুদ কমলা মনোহরনকারী রঙ। কুমকুমের বক্সটা খুলে একটা ছোট্ট সাদা প্লাস্টিকের কাঠি দিয়ে মা কপালে টিপ আঁকতেন। আমার কাছে এমন লোভনীয় জিনিস খুব কমই ছিলো। তবে তা নিজের কপালে টিপ আঁকবার জন্য নয় মোটেই। সে সব রঙে আমি চাইতাম আমার বর্ণহীন ছবিগুলো রাঙিয়ে দিতে। তাই দাদুর সাদা ধপধপে শাড়ীটা যখন ঝকঝক করে ধুয়ে মাড় দিয়ে টান টান করে রোদে শুকুতে দেওয়া হলো এক দুপুরে। আমি মা আর দাদুর দুপুরের ভাত ঘুমের সৌজন্যে সেই সাদা ধপধপে শাড়ী আর মায়ের কুমকুমের বাক্সটা বুকে করে নিয়ে সোজা চলে গেলাম কোনার ঘরটায়। তারপর আচ্ছা মতন মনের সাধ মিটিয়ে রাঙিয়ে দিলাম নানান রঙে সাদা ধপধপে শাড়ীটা। লাল নীল হলুদ কমলা বেগুনী নানান সব রঙে শাড়ীটা কি যে সুন্দর লাগছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম নিজের সৃষ্টির দিকে।
হঠাৎ গগণ বিদারী চিৎকারে সাড়া বাড়ী জেগে উঠলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমাদের বাসার নতুন বুয়াটার অতি ভয়ার্ত চেহারা আমার পিছে। আর তার চিল চেচানীতে পুরো ঘুমবাড়ী জেগে জড়ো হয়েছে আমার চার পাশে।
কিছুক্ষন সবার বিস্মিত দৃষ্টিবিদ্ধ হবার পর দেখলাম,দাদীমা হাসি মুখে এগিয়ে এলেন আমার সৃষ্টিশীল প্রতিভা মন্ডিত চিত্রকর্মের দিকে আর মা খুবি বেরসিকের মত এগিয়ে এলেন তার আগে আগে, আর এসেই সাড়াশীর মত চেপে ধরলেন আমার কান। আমি দাদীমার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আহা, দাদীমার রোজ রোজ সাদা শাড়ী পরতে ভালো লাগেনা তাই আমার চিত্র বিচিত্র নানা রঙে রঙিন শাড়ীটা দেখে তিনি বুঝি খুব খুশী হয়েছেন, তাই আমিও হাত তালি দিয়ে খুশীতে হেসে উঠতে যাচ্ছিলাম তবে মায়ের আবার ওমন মূর্তীর দিকে তাকিয়ে আমার হাসি মুখ মলিন হয়ে গেলো। তারপর আশপাশ থেকে ফুপু চাচী পাড়া প্রতিবেশীদের হাসাহাসি রোলের মাঝে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম।ঠিকই। তবে আমার পাবলো পিকাসো নাম একেবারেই চিরস্থায়ী হয়ে গেলো।
এরপর মায়ের কলম, কুমকুমের বাক্স লিপস্টিক এসব চলে গেলো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন কি কাপড় শুকুতে দেবার দড়িটাও অনেক উপরে উঠিয়ে দেওয়া হলো আমার নাগালের বাইরে। তাই বলে কি (আমি পাবলো পিকাসোর ) চিত্রকর্ম বা সৃষ্টিশীল প্রতিভা ঠেকে থাকতে পারে? আমি আবিষ্কার করে নিলাম নতুন অন্কন সরন্জাম।
ছাদে খেলতে গিয়ে একটুকরো ইট পেয়ে গেলাম মনের মত। যে ইট দিয়ে অনায়াসে ছবি আঁকা যায়। তারপর থেকেই আমি হয়ে উঠলাম ইটতুলি বিশারদ। কোনো কোনো ইট খুবি শক্ত টাইপ মোটেই ভালো ছবি হয়না তা দিয়ে আবার কোনো কোনো ইটের টুকরো মোলায়েম যেন মাখন । তা দিয়ে ছবি উঠে আসে অনায়াসেই। আমার চাচাতো ভাই তখন মনে হয় নাইন টেনে পড়তো। তার সাইন্স প্রাকটিক্যাল খাতায় সে জবাফুল এঁকেছিলো । আমাকে আদর করে আবার সে তার খাতাখানা খুলে দেখিয়েছিলো, কি করে জবাফুল এঁকেছে সে। আমার প্রতি বোধ করি তার অনেক দয়া ও মায়া হয়েছিলো আমার চিত্রকর্মের প্রতি অতিশয় আগ্রহ মনোভাব দেখে। তাই দেখে আমিও শুরু করলাম ইটের টুকরোয় জবাফুল অন্কন প্রাকটিস। আমাদের বাসার ছাদে। এর পর আবিষ্কার করলাম ইটের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে নিলেও সে হয় আরেক মহা আবিষ্কার।
যাই হোক আবিষ্কারক আমি একদিন মহা আবিষ্কারের সুযোগ পেয়ে গেলাম আবারও। চাচাত ভাইয়া ঈমনের প্রাকটিক্যাল খাতাটা তার পড়ার টেবিলে খোলা পড়ে ছিলো । হয়তো পরীক্ষা আসন্ন হওয়ায় কিছুক্ষণ আগেই সে পড়া ছেড়ে উঠেছিলো। আমি মহা সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। সেটা নিয়ে উঠে এলাম চুপিচুপি বাসার ছাদে। এক এক পাতা উল্টাই আর মুগ্ধ অপার বিস্ময়ে দেখি, জবাফুল, ব্যাঙ , কেঁচো আরো কত কি? আহা কোন বুদ্ধিতে, কোন যাদুর ছোঁয়ায় মানুষ এঁকে ফেলতে পারে অনায়াসে এসব?
মুগ্ধতার পর মুগ্ধতা। হঠাৎ নীচ থেকে হাউকাউ চিল্লাচিল্লি। উঁকি দিয়ে দেখি ঈমন ভাইয়া উঠানের মাঝে তূর্কী নাচ নাচছেন আর বাড়ীর সবাই কার যেন নাম ধরে খুঁজাখুঁজি করছেন। ভালো করে কান পেতে শুনলাম সে আর কারো নাম নয়, সে আমারই সুমধুর নাম।( একেবারে কানের ভেতর দিয়া মরমে পশিলো গো! )
কিন্তু ভয়ে তো ছাদ থেকে নামবার কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। এখন খাতা নিয়ে নামলেই তো বিপদ। ভাবলাম একটা কাজ করা যাক, উপর থেকেই ইশ্বর প্রদত্ত কোনো বস্তুর মত ফেলে দেইনা খাতাটা। যেই ভাবা সেই কাজ।
তবে বদমাস খাতাটা নিউটনের সূত্রর যথার্থতা পালন করতে গিয়ে, আমার মত ছোট্ট অবুজ শিশুকে মাধ্যাকর্ষন শক্তির ক্রিয়াকলাপ হাতে নাতে বুঝাতে, সোজা গিয়ে পড়লো উঠানের একধারে খোলা ড্রেইনের মাঝে!
আর তারপর......
আমার বলার কিছু ছিলোনা.. চেয়ে চেয়ে (চোখ বড় বড় করে) দেখলাম ...
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:১৮