১
বুয়ানি আতো, আতোনা ....
আসি মা, এই যে আর এট্টুখানি মামনি, আর এট্টুখানি সবুর করো, অক্ষনি আইতাছি।
না না না তুমি আগে আমাল কথা সুনে যাও। তোমার জন্য তা বানিয়েতি তো।
ওরে আমার সোনাপাখী, যাদুমনি। তুমি আমার জন্য চা বানাইছো। ওরে মা খুব মজা হইসে সোনা যাদু। খুব ভালো হইছে।
রান্না ঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এসে বসে মর্জিনা ছোট্ট সোহার কাছে। কিচেনের সাথেই লাগোয়া লিভিং স্পেসটায় একগাদা ছোট ছোট গোলাপী নীল বারবি কিচেনসেট নিয়ে খেলছিলো সোহামনি।
মদা? আমাল তা মডা? বিক্কিত খাও। চক্কেত খাও। মর্জিনাকে আপ্যায়নে ব্যাস্ত হয়ে ওঠে সোহা তার লাল নীল গোলাপী বারবি কিচেন সংসারে।
মর্জিনা হাপুস হুপুস ফুস ফাস শব্দে , বিভিন্ন ঢং এ, পাকা অভিনেত্রীর মত সুস্বাদু মুখভঙ্গিতে খেতে থাকে সেসব খাদ্য সমাগ্রী পরম আগ্রহে।
খিলখিল করে হাসতে থাকে সোহামনি। এক মুহুর্ত,তার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে মর্জিনা। চোখ চলে যায় বারান্দার গ্রিলটা গলে ঐ দূর আকাশে। মেঘের ভাঁজে কি খোঁজে তার চোখ ? কে জানে?
সোহামনির ডাকে সম্বিত ফেরে তার।
এ্যাই বুয়ানি ই ই ই ই । কতা বলোনা কেনো? তুপ কেনো?
এই তো আম্মু। আমি আরো চা খাবো। আরো বিক্কিত খাবো। মুহুর্তেই ফিরে আসে মর্জিনা কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে।পুনরায় মেতে ওঠে খেলায়। হাসতে থাকে কলকল করে।যেন অসমবয়সী দুটি শিশু।
মাছের ঝোলটা চুলায় চাপিয়ে দিয়ে এসেছে সে। সোহামনির জন্য আলাদা রান্না খিচুড়ী আর মুরগীর কারিটা সোহামনি ঘুম থেকে উঠার আগেই রেডী করে ফেলেছে সে। এখন চুলা থেকে মাছটা নামানো পর্যন্ত অপেক্ষা।
২ বছরের সোহাকে মর্জিনার দায়িত্বে রেখে যান শায়লা আফরোজ রোজ সকালে। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে তার সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। মর্জিনা আসে সেই ভোর সকালে। তখন সোহা ঘুমের ঘোরে। ওর কি খাবার হবে , কখন গোসল, কখন ঘুম এসব নিয়ে আর ভাবতে হয়না শায়লা আফরোজেরর । মর্জিনা তার নিজস্ব মমতা আর সততায় এক পরম স্থান দখল করে নিয়েছেন শায়লা-ফরহাদের সংসারে আর ছোট্ট সোহামনির হৃদয়ে।
দুপুর ২টা। এখন সোহামনির ঘুমের সময়। সোহামনিকে খাইয়ে দাইয়ে,গোসল সারিয়ে, কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়াচ্ছে মর্জিনা। গুন গুন করে কি একটা গান গাইছিলো সে।
ঐ তা গাও বুয়ানি। ঘুম ঘুম ঘুম , মেঘেল দেতে তোহামনি.....সোহামনির আধো আধো বলে আপ্লুত হয় মর্জিনা।
আইচ্ছা তুমি চোখ বুজো সোহামনি। আমি তোমারে ঐ গানই শুনাইতেছি।
সোহার প্রিয় গান ধরে মর্জিনা। ঘুম ঘুম ঘুম , মেঘের দেশে সোহামনি যায়রে পাল্কী চড়ে।
সোহামনির চোখে ঘুম পরী নেমে আসে ধীরে ধীরে। ওকে ওর ছোট্ট বেবি কটটায় পরম যত্নে শুইয়ে দেয় মর্জিনা।
এই সময়টা বেশ কিছুক্ষন কাঁটে ওর অখন্ড অবসরে।
জানালার ধারে এসে দাড়ায় সে। ১০ তলা সুউচ্চ ভবনটা থেকে চোখ নামিয়ে দেয় চলমান রাজপথে। হাজার মানুষের মিছিল,গাড়িঘোড়া,আকাশ বাতাস ভেদ করে মনের চোখে দেখতে পায় সে শুস্ক মলিন বিছানার এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে অযত্নে অবহেলায় শুয়ে থাকা হাসুর মুখখানি। প্রতারক বেঈমান হাসেমের নামের সাথে মিলিয়েই নাম রেখেছিলো সে মেয়েটার। মেয়েটার সাথে সোহামনির নামেরও বেশ খানিকটা মিল খুঁজে পায় সে।কথাটা ভাবতেই নিজের বোকামীতে নিজেই লজ্জা পায় যেন একটু। হায়রে কোথায় সোহা আর কোথায় হাসু?
একটি দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে নেমে আসে ওর। মেয়েটার কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। দিন দিন কেমন যেন বাসী ফুলের মত মলিন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বিধাতার কাছে জবাব চাইতেই হয়তো আবারো দৃষ্টি ফেরায় সে দূর আকাশের ঐ সাদা মেঘের ফাকে । বিধাতা কি ওখানে থাকেন? সেখান থেকে কি তিনি ধনী গরীব সকলেই সমান চোখে দেখেন? অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার আছে ওর বিধাতার কাছে। যদি জানতে পারতো বিধাতার অবস্থান কোথায়, যেমন করে হোক,যেভাবেই হোক ঠিক চলে যেত সে সেখানে। বিধাতার কাছে অনেক কিছু জানবার ছিলো ওর।
২
আজ ছুটির দিন। বেশ খানিকটা বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছেন শায়লা আফরোজ । এমনিতেই ছুটির দিন গুলোয় ঘর সংসারের বেশ কিছু কাজের তদারকি করেন তিনি। কিন্তু আজ তিনি সারা বাড়ী মাথায় তুলেছেন গত পরশু সোহামনির বার্থডেতে পাওয়া রিমোর্ট কন্ট্রোল বেবি পুতুলটার জন্য। এই দুদিন দিনরাত ২৪ ঘন্টা পুতুলটা সঙ্গে ধরে নিয়ে ছিলো মেয়েটা। আজ সকাল হতেই কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা পুতুলটা। কাল বাসায় উনার অফিসের দুজন কলিগ তাদের বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে বেড়াতে আসার পর হতেই বেমালুম গায়েব সোহামনির সবচাইতে প্রিয় নতুন পুতুলটা।
মর্জিনা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। শায়লা আফরোজের রনচন্ডী মুখের দিকে চাইবার সাহসটুকু নেই যেন তার। শায়লা অবশ্য তাকে কিছুই বলেননি। এতদিন যাবৎ সোহামনির এক বাড়ী খেলনা, কাপড়, মূল্যবান জিনিসপত্র হতে কুটোটুকু খোয়া যায়নি তার। মনের কোনাতেও ও আনতে পারেন না তিনি যে মর্জিনা এমন কিছু করতে পারে, নিতে পারে সোহামনির সবচেয়ে প্রিয় নতুন পুতুলটি চুরি করে। বরং প্রাণ দিয়ে এবাড়ির প্রতিটি জিনিস পরম যত্নে আগলে রেখেছে সে। সোহামনি পুতুলটার জন্য বারবার ঘেনঘেন করায় সপাটে চড় বসিয়ে দিলেন তিনি ছোট্ট মেয়েটার গালে। গালমন্দ করতে থাকেন মেয়েটাকে,গজ গজ করতে থাকেন যাকে তাকে পেলেই মেয়েটার সবকিছু নিয়ে খেলতে মেতে যাবার স্বভাব নিয়ে। তাড়াতাড়ি ওকে টেনে নিয়ে যায় মর্জিনা। আদর করে , খাইয়ে ধুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সে পরম মমতায়।
পুতুলটা শায়লার এক মামা কানাডা থেকে এনে দিয়েছিলেন , এ পুতুল এখানে লাখ টাকা দিলেও পাওয়া যাবেনা হেন তেন হাজারটা গজ গজ করতে করতে থেমে যান তিনি এক সময়।
৩
রাত্রী বেশ গভীর হয়েছে। মর্জিনাদের বস্তি বাড়ীর প্রায় সারারাত মেতে থাকা কোলাহলটাও স্তিমিত হতে হতে একেবারেই থেমে গেছে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা আর। কিছুক্ষণ রওশন বুড়ির দরজার সামনে জেগে থাকা কুকুরটা কেঁদে কেঁদে ডেকে ডেকে সেও থেমে গেলো একসময়।
জেগে আছে মর্জিনা। নির্ঘুম, স্থির চোখের পাতা। বুকের কাছে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে হাসু। দুখি মেয়েটার ঠোটের কোনায় লেগে রয়েছে তৃপ্তি ও আনন্দের একচিলতে হাসি। অনেকদিন এমন স্মিত হাস্য মুখে ঘুমাতে দেখেনি সে মেয়েটাকে। কুপির আলোয় মেয়েটাকে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অপার্থীব জগতের সবচাইতে সুখী একজন দেবশিশু। ঘুমের মধ্যেও বুকে চেপে রেখেছে পুতুলটি সে। ঠিক যেভাবে দুদিন যাবৎ পুতুলটি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলো সোহামনি।
কেঁপে উঠলো মর্জিনা। হুহু করে কেঁদে উঠলো এতক্ষন পর সে। বিধাতা ওকে এ জগতে সুখী হবার মত কিছুই দেননি । শুধু অকৃপন ভাবে, উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন ওর হৃদয়ে মায়ের মমতাটুকু। সে হৃদয় শুধুই একজন মায়ের ।সেখানে হাসু ও সোহা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নামের মিল অমিল অবস্থানগত প্রভেদ কিছুই নেই সেই স্বর্গীয় স্থানটিতে।
বার বার মনে পড়ে তার, , প্রিয় পুতুলটি না পেয়ে সারাদিন কেঁদে কেঁদে সার হয়েছে আজ সোহামনি। একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকায়, পরক্ষণেই চোখ বুজে দেখতে পায় সোহামনির দিনভর কেঁদে কেঁদে, ইষৎ ফুলে থাকা ঠোটের সেই আদরের মুখখানি।
বুক ফেটে যেতে চায় যেনো।
সারারাত নির্ঘুম, ক্রন্দনরত জননীর আদি অকৃত্রিম, অপ্রভেদ্য সেই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে ওর ছোট্ট মলিন বস্তিঘরের নির্বাক কুপির আলোটি। ক্রন্দন ও অসহায় চাপা হাহাকারের প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে সাথে কেঁপে কেঁপে উঠে তাকে সঙ্গ দিয়ে চলে তারই মত নিসঙ্গ কুপিটির ম্লান ক্ষীণ শিখাটি।।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১০ রাত ১০:৫০