somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের পুতুল ও একাত্তরের এক পুতুলওয়ালা

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় পাশের বাসার একই ক্লাসের সহপাঠী রুনির কাছে দেখলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জুতোর বাক্সবাড়ি। মানে সে তার বাবার জুতোর ফেলে দেওয়া বাক্সের মধ্যে ছোট্ট এক ভেলভেটে মোড়ানো মায়ের গয়নার পুরোনো বাক্স দিয়ে বানিয়েছে আরও সুন্দর ছোট এক খেলনা বিছানা। বিছানাটার মাথার কাছে আবার এক রতি তুলো কাপড় দিয়ে চারকোনা করে পেঁচিয়ে সেটা দিয়ে বানিয়েছে বালিশও। শুধু কি তাই? সেই বিছানার ঠিক মধ্যিখানে পেতে রাখা আছে এক টুকরো রাবারক্লথ, ঠিক যেমনটির ওপর আমি কিছুদিন আগেই জন্ম নেওয়া আমার চাচীর সদ্যজাত বাচ্চাটাকে শুইয়ে রাখতে দেখেছি। অবাক হয়ে শুনলাম রুনির বড় বোন তাকে কাপড় দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে এই অপরুপ আশ্চর্য্য এক মা পুতুল সাথে ছোট্ট সেই বাবু পুতুলটিও। মা পুতুলটার কি অপরুপ লম্বা কালো সুতোর চুল। টানা টানা চোখ, লাল টুকটুক ঠোঁট! তাকে আবার ছোট্ট জরিপাড় লেসের শাড়িও পরানো হয়েছে! গলায় আবার দুই পুঁতি দিয়ে বানানো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য সুন্দর এক মালাও ঝোলানো রয়েছে!!!পুতুল আর তার ছোট্ট বাবু পুতুলটার রুপে আমি তো মহা মুগ্ধ!!!

বাসায় ফিরলাম মন খারাপ করে। আমার তো ওর মত কোনো পুতুল নেই, ওর মতো কোনো বোনও নেই আমার যে বানিয়ে দেবে ওমন একটা পুতুল। আমার মহা রাগী এবং ব্যাস্ত মায়ের কি সময় হবে আমার জন্য সেই রকম একটা পুতুল বানিয়ে দেবার? কিন্তু সব শুনে এক গাল হেসে মা বললেন দেখো আমি ওরটার চাইতেও ভালো পুতুল বানাতে পারি। আর তারপর সেদিন দুপুরেই ভাত খাবার পর মা বসলেন সুই সুতা আর টুকরা কাপড় নিয়ে। আর সত্যি সত্যি বানিয়ে ফেললেন আশ্চর্য্য সুন্দরএক বউ পুতুল। তাকে পরিয়ে দিলেন লাল টুকটুক শাড়ি। চুলে বেধে দিলেন খোঁপা সেই খোঁপায় কি অপরূপ এক ছোট্ট কাপড়ের ফুল। আমি মায়ের উপর কৃতজ্ঞতায় আর মুগ্ধতায় বিমোহিত হলাম। আর তারপর বসলাম আমার পুতুলের ঘরবাড়ি সাজাতে।


সব মেয়েরাই পুতুল ভালোবাসে। এখন তো মেয়ে বাবুরা সব বারবি ডল, পাপেট ডল আরও কত রকমের ডল নিয়ে খেলে। তাদের জন্য রয়েছে কত রকম বেডরুম সেট, কিচেন সেট বা সাজুগুজু সেট । আমার সেসব ছিলো না। আমি নিজেই আমার সৃষ্টিশীল প্রতিভার যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়ে বানিয়ে ফেলতাম আমার কাপড়ের পুতুলদের জন্য ম্যাচবক্সে তুলো আর কাপড় সেলাই করে ছোট্ট ছোট্ট সোফাসেট, ছোট্ট কাগজে ফুলপাতা একে তাতে রঙ চড়িয়ে দিয়াশলাই কাঁঠির ফ্রেম দিয়ে বাঁধাই করা ওয়াল পেইন্টিং আরও কত কি!!!! কাপড়ের পুতুলের উপর সেই আমার বিষম ভালোবাসার শুরু। বলতে গেলে মোহ। কিছুদিনের মাঝেই জমে উঠলো আমাদের আশেপাশের বন্ধুদের সাথে পুতুলখেলা। আমার অপরুপা কনে পুতুলের সাথে বিয়ে হলো একদিন পাশের বাড়ির বন্ধু সীমার ছেলে পুতুলটার।হই হই করে বরযাত্রী আসলো। মা রেঁধে দিলেন পোলাও আর কোর্মা। বরদের আনা আলাউদ্দিন সুইটমিটের মিষ্টিও খানাপিনা হলো। যদিও সীমা ধর্মে ছিলো হিন্দু তবে আমাদের সেসব পুতুলের বিয়েতে বা আত্মীয়তায় ধর্ম,বর্ণ, জাঁতি বিভেদের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। সে যাইহোক ...


এরপর নানুবাড়ির এক চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বড় মামা এনে দিয়েছিলেন মাটির পুতুল। আরও পরে একজন বিশেষ মানুষ আমার পুতুল প্রীতি বা আসক্তি জেনে আড়ং থেকে উপহার দিয়েছিলো আমাকে এক অপূর্ব সুন্দর নৃত্যরতা কাপড়ের পুতুল!!! সেই পুতুলটা আমার পুতুলের আলমারীতে এখনও সযতনে রক্ষিত রয়েছে।


একদিন রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালে দেখলাম এক পাতার পুতুল।কাঁঠির মাথায় লাগানো সে পুতুলটা কি অপরিসীম দক্ষতায় হাত পা নেড়ে তলোয়ার চালাচ্ছিলো। পুতুলওয়ালাকে কাছে ডাকতেই সে চিৎকার করে বললো, এ আমার তালপাতার সেপাই। ওর নাম নিধিরাম সর্দার!! আমি তো আবারও মুগ্ধ!!! মনে পড়ে গেলো সেই ছড়া, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। তার পাতার সেপাই এর ঢাল ছিলোনা বটে তবে তলোয়ার ছিলো দুই হাতে দুইটা। পুতুলওয়ালা একটু নাড়া দিতেই বাতাসের বেগে সাই সাই করে তলোয়ার চালাচ্ছিলো সে। যাইহোক পৃথিবীর নানা দেশেই আছে তাদের ঐতিহ্যবাহী পুতুল। বাংলাদেশের এসব পুতুলও কোনো অংশেই কম নয় তাদের কাছে। আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির সাথে অতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের এসব পুতুল।


বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও লোকজ শিল্পে পুতুল-
বাংলার আদিযুগ থেকেই দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও খেলনা হিসেবে পুতুল এদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে রয়েছে মাটি, কাঠ, শোলা, কাপড়, গাছের পাতা, পাট ও কাগজের পুতুল।হিন্দুধর্মের নানারকম পূজোর সময় কুমাররা মাটি দিয়ে গড়ে দেবদেবীর মূর্তি ।সাথে বিভিন্ন ধরনের খেলনা পুতুলও বানায় তারা। তাছাড়া বাচ্চাদের খেলনা হিসাবেও গ্রামে গঞ্জে অনেকেই বানায় বাঁশ, পাতা, মাটি, খড়, কাগজ বা শোলার পুতুল।
ধর্ম,বর্ণ,জাঁত,পাত নির্বিশেষে সব শিশুদেরই তা সমান প্রিয়।


যত রকমের পুতুল-
মাটির পুতুল দুইভাবে বানানো হয়- হাতে টিপে টেপা পুতুল আরেক রকম বানানো হয় ছাঁচে ঢেলে ছাঁচ পুতুল। কাজেই মাটির পুতুল দু'রকমের। যদিও আড়ং বা দেশী্য সংস্কৃতির ধারক বিভিন্ন দোকানগুলোতে নানারকম মাটি, কাঠ,শোলা বা কাগজ ও পাটের পুতুল পাওয়া যায়।


পুতুল তৈরীর প্রক্রিয়া-
কাঁচামাটি দিয়ে তৈরি ছাঁচের পুতুল প্রথমে রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। তারপর তাতে বিভিন্ন রঙ চড়িয়ে পুতুলের পোশাক ও চোখ মুখ আঁকা হয়।হাজার বছর ধরে বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে আসছে এই পুতুলের চল। অনেক কষ্ট করে, অনেক সংগ্রাম করে এখনো টিকে আছে বাংলার আদি এক সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা পেশায় পাল।মাটি দিয়ে বানায় তারা নানারকম জিনিস ও মাটির পুতুল।
কাঠের পুতুল তৈরিতে কদম, আমড়া, জিওল, শ্যাওড়া, ছাতিম, শিমুল প্রভৃতি কাঠ ব্যবহৃত হয়। শোলার খেলনা পুতুল ফরিদপুর ও রাজশাহী অঞ্চল এবং ঢাকার শাঁখারি বাজারে তৈরি হয়। কাপড়ের পুতুল তৈরি হয় হাতে। বাঁশপাতা বা খেঁজুর পাতা বা তালপাতা দিয়েও বানানো হয় তালপাতার সেপাই এর মত নানা রকম হাত পা নড়া (ম্যুভিং) মজাদার পুতুল।


পুতুল ও পুতুলনাচ বা পুতুলনাট্য-
পুতুলনাট্য বা পুতুলনাচ।পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রয়েছে পুতুলনাট্য বা পুতুলনাচ। তবে বর্তমানযুগে শুধু বিনোদনের জন্য নয় বরং শিশু-শিক্ষা, তথ্য-প্রচার, গণ-সচেতনতা, বিজ্ঞাপন, পরিবেশ-উন্নয়ন, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, মনোচিকিৎসা, প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশ, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এসব মাধ্যমে পরিবেশনের জন্যও পুতুলনাট্য বা পাপেট্রি এক শক্তিশালী গণমাধ্যম। পুতুলের নৃত্যাভিনয়ের বিশিষ্ট শিল্পাঙ্গিকটি লোক সমাজে ‘পুতুলনাচ’ নামেই সুপরিচিত হলেও এটি প্রকৃত পক্ষে একটি বিশিষ্ট লোকনাট্য।’


পুতুলনাচ বা পুতুলনাট্যে সব পুতুলেরই বিশেষ চরিত্র থাকে।তারা এমনি এমনি নাচে না, কাহিনী অনুযায়ী নাচে।সাধারণত চার ধরনের পুতুল দিয়ে নাচ হয়, তারের পুতুল, লাঠিপুতুল, বেনীপুতুল ও ছায়াপুতুল। সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে বানানো হয় তারের পুতুল। লম্বা সরু লাঠি দিয়ে নাচানো হয় লাঠি-পুতুল। দুই কিংবা তার চেয়ে বেশি পুতুল একসঙ্গে আঙুল দিয়ে নাচানো হলে তাকে বলা হয় বেণিপুতুল। বাংলাদেশে এই তিন ধরনের পুতুলের চলই রয়েছে। ছায়াপুতুল বা স্যাডো পাপেট বাইরের দেশেই বেশী জনপ্রিয়। মাছ, পাখি, গাছ, মানুষ, পশু ইত্যাদি সব ধরনের পুতুলই মঞ্চে দেখা যায়।

বাংলাদেশে তারের পুতুলনাচই বেশি দেখা যায়। এর জন্য থ্রি ডাইমেনশনাল সেইপে একদিক খোলা স্টেজ তৈরি করতে হয়। পুতুলনাচে পরিবেশনায় ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয় কালো পর্দা। এতে যেসব কালো সুতা দিয়ে পুতুলগুলোকে নাচানো হয়, সেগুলো চোখে পড়ে না। মঞ্চে থাকে আলোর ব্যাবহার। কথক বা কন্ঠ দেওয়া হয় ব্যাকগ্রাউন্ডে।প্রতিটি দলেই থাকে একটি বাদকগোষ্ঠী, তবু একটি বাঁশি সব সময় বাজানো হয়।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর মুসলিম পুতুল নাচিয়ের আবির্ভাব হয়। শুরুতে এ অঞ্চলের পুতুলনাচের বিষয় ছিল রামায়ণ, মহাভারত, রাধা-কৃষ্ণ, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি কাহিনীভিত্তিক। পরে যুগের পরিবর্তনে পুতুলনাচের কাহিনীতেও পরিবর্তন এসেছে।


মুস্তাফা মনোয়ার ও তার পুতুলনাচ বা পাপেট শো-
বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলা ও লোকজ উৎসব-অনুষ্ঠানে পুতুল নাচের আসর বসে। এটি আজও গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষ ও এমনকি শহরেও বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুলনাচ বা পাপেট শিল্পকলার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভৃমিকা পালন করছেন চিত্রশিল্পী ও নন্দনতাত্ত্বিক মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পাপেট থিয়েটার নিযে় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রদর্শনী করছেন। তাঁর নেতৃত্বে এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ই.পি.ডি.সি) পাপেটশিল্পী সৃষ্টি, কুশলীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দান, পাপেটের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশাত্ববোধ জাগ্রতকরণ, দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচিতিকরণ ইত্যাদি কার্য্যক্রম চলছে। দেশের লোকগাথা, রৃপকথা ও লোকসঙ্গীত থেকে উপাদান নিয়ে ই.পি.ডি.সি আনন্দঘন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও প্রদর্শন করে আসছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অনুষ্ঠান হচ্ছে: পণ্ডিত ও মাঝি, বহৃরৃপী, প্রবাদ বাক্য, আগাছা, লোভ, লিচুচোর, ছোট মেয়ে ও প্রজাপতি, খুকি ও কাঠবেড়ালি, মোমের পুতুল, শান্তির পায়রা, বকের কান্না, গাধা ও কচুরিপানা এসব। বাংলাদেশের পাপেট মিডিয়া আজ আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে নরওয়েতে আন্তর্জাতিক পাপেট থিয়েটার ফেস্টিভাল এবং ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও সম্মেলনে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।


এবার বলি এই একাত্তরের পুতুলওয়ালার গল্পকথা
সবুজ একটা ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে এক কৃষকের সঙ্গে জোর তর্ক চলছে একজন রাজাকার আর খোদ ইয়াহিয়া খানের।
রাজাকার: কইয়া দাও, মুক্তি কোথায়?
ইয়াহিয়া: কিধার মুক্তি হায়?
কৃষকটি একটু এগিয়ে এসে নিজের বুক চাপড়ে বলল, ‘এইখানে, এইখানে থাকে মুক্তি। বুকের মধ্যেই মুক্তি থাকে।’
এসব কোনো সত্যিকারের মানুষের মাঝে তর্ক নয়। ইয়াহিয়া, রাজাকার ও কৃষকরূপী পুতুলদের তর্ক। পুতুলদের এই কান্ড হাসি ফোটায় রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুখে, ক্যাম্পের শরণার্থীদের মুখে। আর সেই হাসি দেখে পুতুলের পেছনে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেন একজন পুতুলওয়ালা। তিনি জয় করে ফেলেন অন্যরকম এক যুদ্ধ, হাসি জয়ের যুদ্ধ।
এই যুদ্ধজেতা মানুষটি আমাদের মুস্তাফা মনোয়ার। অনেক গৌরবময় পরিচয়ের মধ্যে বিরাট এক পরিচয়—একাত্তরের রণাঙ্গনে পাপেট শো দেখিয়ে মানুষ হাসানো মুস্তাফা মনোয়ার।


অন্যরকম যুদ্ধ
মুস্তাফা মনোয়ারের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের রিপাবলিক দিবস। পাকিস্তান টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক হিসেবে এদিন বিশেষ কিছু আয়োজন করার কথা মুস্তাফা মনোয়ারের। কিন্তু এই দিন উদ্যাপন করতে মন সায় দিল না তাঁর। সারা দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বিশেষ দিবস পালন!:(
টেলিভিশন স্টেশনে ঢুকে মুস্তাফা মনোয়ার ভাবতে থাকলেন, কী করা যায়। পরিকল্পনা করলেন, অনুষ্ঠান শেষে এই বিশেষ দিনে পাকিস্তানের পতাকাই উড়ানো হবে না। যেই ভাবা, সেই কাজ। তখন ১০টার মধ্যে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যেত। এদিন অনুষ্ঠান আরও দুই ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
ওদিকে ১৫ দিন আগ থেকেই ৬০-৭০ জন পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প করেছে স্টেশনের ভেতর। অধৈর্য মেজর জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রোগ্রাম খতম নেহি হোতা কাহে?’ মুস্তাফা মনোয়ার বললেন, ‘আপকো মালুম নেহি আজ স্পেশাল ডে? প্রোগ্রাম অর ভি চ্যালে গা।’ ১১টার দিকে সব কলাকুশলী পেছনের গেট দিয়ে চলে গেলেন। মুস্তাফা মনোয়ার, উপস্থাপিকা মাসুমা খাতুন সব, আরও কজন আছেন শুধু। ১২টা এক-দুই মিনিটে মাসুমা বললেন, আজ ২৪ তারিখ। আমাদের অনুষ্ঠানমালা শেষ। এই বলে সবাই মিলে ভোঁ-দৌড়।

এর পর পাকিস্তান টেলিভিশন স্টেশনেও আর পা রাখেননি তিনি।২৬ মার্চে চললেন কলকাতার পথে। পথে পথে হৃদয় ভেঙে দেওয়া দৃশ্য। হাজার হাজার মানুষ পথ চলছে। নেই কোনো মুখের ভাষা। তারা জানে না কোথায় চলছে।
কলকাতায় গিয়ে উঠলেন পার্ক সার্কাস এলাকার একটি বাসায়। নানা কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে বারাকপুরের শিবিরগুলোতে যেতেন। সেখানে কারও মুখে হাসি নেই। বাচ্চাগুলোও গম্ভীর। বেঁচে থাকার ইচ্ছাও যেন নেই মানুষগুলোর। তখনই হঠাত্ মনে পড়ে গেল পাপেটের কথা। পাপেট বা পুতুল দিয়েই এই মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর পরিকল্পনা করলেন মুস্তাফা মনোয়ার।


পুতুলের যুদ্ধ
মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সেই পাপেটকেই অস্ত্র বানাতে চাইলেন। কিন্তু পাপেট যে বানাবেন, সঙ্গে তো কিছুই নেই। এরই মধ্যে তার বাসায় হাজির হলেন তারেক আলী, সাইদুল আনাম টুটুলসহ অনেকে। পাপেটের কথা শুনে তাঁদের উত্তেজনার শেষ নেই। আঠা, কাঠের গুঁড়ো, সুতা, কাপড়, লেইস, রডসহ পুতুল বানানোর সব সরঞ্জামই জোগাড় হলো।কাগজ কেটে পুতুল আর তার জামার মাপ হয়ে গেল।
পুতুলের জামা-কাপড় বানানোর জন্য এক দর্জির দোকানে হাজির হলেন মুস্তাফা মনোয়ার। ছয়-সাতটি ছোট ছোট জামা বানিয়ে দিতে হবে, আজই। দর্জি তো খুবই অবাক, ‘এত ছোট জামা? এ দিয়ে কী হবে। এখন পারব না।’
কিন্তু নাছোড়বান্দা মুস্তাফা মনোয়াররা, ‘কিন্তু জামাগুলো তো আমাদের ভীষণ দরকার।’ শেষমেশ কথায় কথায় বের হয়ে গেল মুস্তাফা মনোয়াররা বাংলাদেশের লোক। শরণার্থী শিবিরে পুতুলনাচ দেখানোর জন্য এই জামা-কাপড়গুলো চাই। এটুকু শুনেই দর্জি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে। পারলে মাথার ওপরে তুলে ধরে পুতুলওয়ালাকে!
‘আপনারা মুক্তিযোদ্ধা’—দর্জি বলল। মুস্তাফা মনোয়ার হাসলেন। দর্জিমশাই এত অভিভূত হয়ে গেলেন যে, পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সব কাজ শেষ করে দিলেন। শুধু কাজ শেষ করে দিলেন না। কিছুতেই আর মজুরি নেবেন না। বললেন, ‘লজ্জা দেবেন না, আমি সারা জীবন বলতে পারব, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করেছি।’
পুতুল তৈরি হলো, জামা-কাপড় হলো। এবার শুরু খেলা দেখানো। বারাকপুরের কাছে একটি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে হাজির হলেন মুস্তাফা মনোয়ার ও তাঁর পাপেট শোর দল। কালো পর্দা দিয়ে কোনোরকমে মঞ্চ বানানো হলো। প্রথম দিন ওই দলের উপস্থিতিতে শরণার্থী শিবিরের লোকজন অবাক। কী হচ্ছে এখানে!


রাজাকার এসে কৃষককে ভয় দেখাল। রাজাকারের পক্ষ নিয়ে খোদ ইয়াহিয়া চলে এল। তাকে তাড়া করতে মুক্তিযোদ্ধা এল। মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে ইয়াহিয়া আর তার রাজাকার সঙ্গী ভয়ে জড়সড়। শেষে সবাই মিলে ইয়াহিয়া আর রাজাকারকে ধরে পিটুনি।

শুরু হলো হাসি। মুস্তাফা মনোয়ার আর তাঁর দল অবাক হয়ে দেখলেন, হাসছে সবাই। কয়েক দিন আগে সন্তান হারানো মা হাসছেন, সর্বস্ব হারানো বাবা হাসছেন, পা হারানো মুক্তিযোদ্ধা হাসছেন।বুক ভরে তৃপ্তির শ্বাস নিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। এই তো চেয়েছিলেন তিনি। এমন দুঃসময়ে হাসির বড় প্রয়োজন।
মোট ছয়টি মজার চরিত্রের পাপেট বানানো হয়—কৃষক, ছোট ছেলে, ইয়াহিয়া, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা ও বাউল। একটি দৈত্যাকৃতির রাক্ষসও ছিল, যাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা হতো। সংলাপ লিখতে বসে দর্শকদের জন্য কিছু জায়গা রাখা হতো। এসব জায়গায় পাপেটের বিভিন্ন কথার জবাব দিত সাধারণ মানুষ।
লোকজনেরও ছিল দুর্দান্ত উত্সাহ। ইয়াহিয়া মার খাচ্ছে। ঘোষক তখন বলে উঠত, ‘আর কে কে মারতে চায়?’ উপস্থিত জনতা চিৎকার করে উঠত। শো শেষে অনেকে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ ঝাড়তে সরাসরি এই পুতুল ইয়াহিয়া আর রাজাকারকেই ধরে মারতে চাইত।

শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি পার্ক সার্কাসের স্থানীয় ক্লাবগুলোতেও আয়োজন করা হয় পাপেট শো। কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও এই পাপেট শো সাহস জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। সেসব জায়গায় কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাও পাপেট পরিচালনায় হাত লাগিয়েছেন। কখনো মুস্তাফা মনোয়ার একাই যেতেন কখনো যেতেন দল নিয়ে।
এভাবে শরণার্থীদের শিবিরে শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল আমেরিকার চিত্রগ্রাহক লেয়ার লেভিনের সঙ্গে। তিনি তো মহা অবাক। এত সুন্দর অভাবনীয় একটা মাধ্যম দেখে তিনি যারপরনাই অভিভূত। চিত্রায়ন করলেন তাঁর পাপেট শো।
এরই মধ্যে দিল্লিতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের দলনায়ক হবার ডাক পড়েছিলো তার।পাপেট শো বিরতি দিয়ে সেই দলের সঙ্গে কেটেছিলো বাকি একাত্তর।


তার পর কত দিন চলে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাপেট, ছবি, সংস্কৃতি আর টেলিভিশন নিয়ে দিন কাটে মুস্তাফা মনোয়ারের।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হঠাৎ এক দিন দেখা তারেক মাসুদের সঙ্গে। তিনি জোর করে নিয়ে গেলেন তাঁর এডিটিং স্টুডিওতে। সেখানে মুক্তির গান নামের একটা চলচ্চিত্রের কাজ চলছে। তারেক মাসুদ তাঁকে কিছু দৃশ্য দেখতে বললেন।
মুস্তাফা মনোয়ার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন, ফিরে এসেছে সেই একাত্তরের কৃষক, রাজাকার আর ইয়াহিয়ার পুতুলযুদ্ধ! কৃষক পুতুল ইয়াহিয়াকে বলছে, ‘তোমার হস্তরেখায় মরণরেখা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে।’ মুক্তিযোদ্ধা পুতুলটি বলছে, ‘বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা জন্ম নেয়। তাঁরা থাকেন বাঙালির বুকের মধ্যে।’
চোখের পানি মুছে তারেক মাসুদের দিকে ফিরে চাইলেন পুতুলওয়ালা। এক অজানা আনন্দে ভরে গেল তার বুক। ধুলোর আড়ালে হারিয়ে যায়নি তাঁর পুতুল যোদ্ধারা।


***ছোট্টবেলার আমার সেই কাপড়ের পুতুলগুলো আজ আর আমার কাছে নেই তবে আজও বেঁচে আছেন এই পুতুলওয়ালা।মুস্তাফা মনোয়ার আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ। বেঁচে থাকুক তিনি ও তার ভালোবাসার মাধ্যম চিরদিন বাংলার ঘরে ঘরে!!! হাসি ফোটাক সকলের মুখে সারাটাজীবন। বলুক তারা জীবনের কথা, জোগাক তারা বেঁচে থাকার লড়াই এর সাহস। ভালো থাকুক সবাই বিজয়ের মাসটিতে আজও এই আমার পরম চাওয়া।

***
জীবনি- পুতুলওয়ালা মুস্তাফা মনোয়ার

***
পুতুলওয়ালার অনুপ্রেরনায় অনুপ্রানিত হয়ে শিশুদের জন্য আমার পুতুলনাচ পরিচালনার প্রচেষ্টা

তথ্য ও ছবি- নেট ও জীবন থেকে....
Click This Link
Click This Link
http://dhakatimes24.com/2013/11/23/5350
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৫
১৫০টি মন্তব্য ১৫৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×