ঢাকায় আসার পর বেশ কয়েক মাস স্বপ্নের আদলে কাজ খুঁজতে খুঁজতে সফলভাবে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা দেশের স্বনামধন্য মার্কেট বসুন্ধরা সিটিতে একটা রেফারেন্সের ভিত্তিতে কাজ নিলাম সেলসম্যান হিসেবে সেভেন লেভেলে দেশী দশের গ্যালারী- ‘অনঞ্জন্স’ এর শো রুমে। শুনেছে ঢাকাতে নাকি রেফারেন্সে ছাড়া একটা কুত্তা খ্যাদানোর কাজও পাওয়া যায় না। নিজের জীবনে সেটি ঘটাতে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। আগে যে ধারণা ছিল বসুন্ধরা সিটি মানেই তো হাইফাই একটা কিছু। নিশ্চয়ই এখানে সেলসম্যানের বেতনও ভালোই হবে কাজের সুযোগ সুবিধাও বেশি হবে। কিন্তু একি অভিজ্ঞতা হলো আমার যা কোনদিন কোন মুহুর্তে ভোলা সম্ভব না। পৃথিবী উল্টে গেলেও সকাল ১০ টার মধ্যে শো রুমে উপস্থিত হতে হবে। ১০ টার ৫ মিনিট পরে আসলে সেদিনের মজুরি কর্তন হবে। সকাল ১০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ( কাগজে কলমে রাত ৮ টা পর্যন্ত) টানা দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের কাছে পোশাক বিক্রি করা সত্যিই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মাঝখানে দুপুরে শুধু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ১০ মিনিটের লাঞ্চব্রেক যা বাধ্যতামূলকভাবে স্টোর রুমেই সারতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলে শো রুম ম্যানেজারের ঝাড়ি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তুলে বটে কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেয়ার দু:সাহস হয় না বৈকি।
আমার জীবনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শুধু একটা কথাই বারবার মনে পড়ে ,“আমি এখন টানা ১১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারি।” ক্ষেত্র বিশেষে ১৩/১৪ ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পহেলা বৈশাখের আগের তিনদিন শো রুম বন্ধ হয়েছে রাত এগারোটার দিকে। আর রমজানের সময় বন্ধ হয় রাত ১২ টা ১ টার দিকে। অনার্স শেষ করে এমন দাঁড়িয়ে থেকে কুত্তার জীবন লিড করতে হবে তা কম্পিন কালেও ভাবিনি। শুধু আমি না আমার মত অসংখ্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী দিনপ্রতি ২০০ টাকার বিনিময়ে এমন মানবেতর জীবন-যাপন করছে ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে। ১১ দিন কাজ শেষে (একদিন ১০ টার কয়েক মিনিট পরে যাওয়ায়) যখন ২ হাজার টাকা হাতে পেলাম তখন আমি অনুভব করলাম আমার চোখে জল ছলছল করছে। কিছু বলতে গেলেই তা গড়িয়ে পড়বে। তাই সসম্মানে মাথা নিচু করে নিশ্চুপে শো রুম থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোন উপায় থাকে নি। অথচ আমার হাতেই বিক্রি হয়েছে লক্ষ-লক্ষ টাকা।
প্রতিদিন দেশী-দশের ‘অনঞ্জন্স’ শো রুম থেকে বিক্রি হয় ৫ লক্ষ থেকে শুরু করে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এতো বেচা-বিক্রি সত্ত্বেও সেখানে নিয়োজিত কর্মীদের সাথে যে আচরণ করা হয় তা সত্যিই দু:খজনক। কথায় কথায় বলা হয়..‘ চাকরি ভালো না লাগলে ছেড়ে দেন..’। একদিন বিক্রি কম হলে অন্যদিন বিক্রি বৃদ্ধির জন্য মানসিক প্রেসার ক্রিয়েট করা হয়। হরতালের দিনে মুখ ভেংচি দিয়ে বলা হয়,‘ ব্যাটারা আজকে তো খুব মজা নিলা, বিনা পরিশ্রমে টাকা নিলা।’ একমাত্র কাঙ্খিত বিক্রি হলেই তাদের কাছে আমাদের ১১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা সাথর্ক অন্যথায় কোন মূল্য নেই বরং পুরস্কার স্বরুপ অপমানসূচক বাণী। বিক্রি বেশি হলে অথবা টার্গেট সেলস ছাড়িয়ে গেলে কর্মীদের চাংঙ্গা রাখার জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্তা তো করাই হয় না বরং বেহায়ার মত ধন্যবাদ দিতেও তারা মাঝে-মাঝে ভুলে যায়।
অপরদিকে বিশেষ দিনগুলিতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল শো রুমে এসে হুমড়ি খায়- লাইভ প্রোগ্রাম করে। মালিক-স্বত্বাধিকারীর সাক্ষাৎকার-- গত বছরের তুলনায় এ বছরে বিক্রি কেমন হচ্ছে..? হরতাল কোন প্রভাব ফেলছে কি’না...? সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আপনারা সন্তুষ্ট কি’না...? ইত্যাদি-ইত্যাতি আলোচনা করে সাংবাদিক জাতির কাছে তথ্য তুলে ধরতে পেরে আনন্দ অনুভব করেন। একটা বারোও তারা সেলসম্যানদের জীবনের গহীনের খবর তুলে ধরতে চেষ্টা করেন না। দেশের এতো ফ্যাশন হাউজের মালিকেরা লক্ষ-লক্ষ টাকা বিজ্ঞাপন বাবদ পত্রিকা- টেলিভিশনে খরচ করছে। কিন্তু সেলারদের অসহনীয় মন:কষ্ট আর বিপুল পরিশ্রমের কথা ভ্রুক্ষেপ করছেন না।
একই স্থানে এতো প্রাচুর্য-বিলাসীতা আর মানবেতর জীবনের দু:সহ গল্প সত্যিই অবাক করে দেয় আমার স্বপ্ন ভঙ্গুর মনকে। এজন্যই হয়তো বা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, ”এমন প্রাচুর্য আর দারিদ্র্যের দেশ আমি দেখি নি...।” আরো অনেক কিছু দেখা হয় নি, শেখা হয় নি। দেখতে হবে/ শিখতে হবে/ চাকরির পিছনে ছুটতে হবে/ রেফারেন্স খুঁজতে হবে। কোটা পদ্ধতির অত্যাচারে/ সরকারী চাকরি বুঝি নাইবা হয়রে। মেধার তো জোর কম/ মামা খালুর খুঁটি নরম। রাজনীতি করি নাই/ রেফারেন্সের জোর নাই। অর্থকরী নাই রে/ চাকরির বাজার হায় হায় রে...। এতো কিছুর পরেও বলতে চাই, এইদিন একদিন থকবে না। একদিন শুভদিন আসবে...
সজিব তৌহিদ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:৪১