somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ~ নায়িকা

২৭ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এককালের ডাকসাইটের অভিনেত্রী পারমিতার উপরে বেশ চটেছেন 'তুমি আমার স্বপ্ন ' ছবির পরিচালক এফ মানিক। একি হাল পারমিতার! বুড়িয়ে যাওয়া মানেই তো মুড়িয়ে যাওয়া নয়! কিন্তু অবস্থা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, বয়সের অবাঞ্চিত ফ্যাট ওর শরীরেরই জমেনি শুধু, প্রতিভাটাতেও কিছুটা জমে গেছে!
- নাহ, এক্সপ্রেশনটা ঠিক হচ্ছে না ম্যাডাম! এবার শালীনতার ধার না ধেরে নগ্নভাবে বিরক্তি প্রকাশ করেন মানিক। এই নিয়ে তিনবারেও শট ওকে হলো না। চাইলে একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে পারেন, আমরা না হয় নায়িকার শটটা নিয়ে নেই ততক্ষনে।

শুনে বেশ অনেকটা বিব্রত বোধ করে পারমিতা। ইউনিট শুদ্ধ মানুষের সামনে এভাবে অপমানিত হয় নি সে অনেক দিন, তাও ছোকরা পরিচালকের কাছে। বানাচ্ছে কি এক অনুদানের ছবি আর শুটিঙে অভিনয় শেখাচ্ছে তাকে ! পারমিতা হয়তো চেঁচিয়ে উত্তর দিতে পারতো, এক যুগ ধরে পেট মুখ দিয়ে এক্সপ্রেশন বমি করেই তো ইন্ড্রাস্টিতে সিনিয়র হয়েছে, তাকে রাখা এওয়ার্ডগুলোর গা থেকে ধুলো মুছবার সামান্যক্ষনটা এককালে ছিলো না। সময় তার ছিল, এইতো বেশীদিন আগের কথা নয়! আসলে, সময় পারমিতার ছিল নাকি পারমিতা সময়ের ছিল তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। টানা দশ বছর বানিজ্যিক ছবির নায়িকা হিসেবে অটোমেটিক চয়েজ ছিল পারমিতা। একদিক দিয়ে পারমিতার ছিল সময়টা। আবার আজ প্রায় চল্লিশ বসন্ত পার করে যখন অনুদানের ছবিতে নায়িকার বড় বোন বা অার্টফ্লিমগুলোতে খোলামেলা দৃশ্যের উপর ভর করে ইন্ডাস্ট্রিতে নি:শ্বাস নিতে হয়, আর তখন যদি কেউ দ্বিমত জানায় আর বলে, পারমিতা ছিল সময়ের, তবে বক্তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

আগে এই সত্য মানতে চাইতো না পারমিতা। বা বলা যায়, ভবিষ্যতকে সে সময়ের আয়নায় নিয়ে এসে কখনো দেখে নি সে। কোন অভিনেত্রীই দেখে না। যেমন দেখে নি বিপাশা, পারমিতার যখন উঠতি ক্যারিয়ার, বিপাশা থেকে ইন্ডাস্ট্রি তখন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এই সেই বিপাশা যার প্রথম তিনটি ছবিই ছিলো গোল্ডেন জুবলি। পারমিতা গা করে নি। করার কথাও না। সেই বয়সে ডিরেক্টরদের স্কিন টেস্ট আর প্রোডিউসারদের বেডটেস্টের চড়াই উতরাই পেরিয়ে নিজেকে কাল্পনিক এক রাজ্যের রানী হিসেবে আবিষ্কার করেছিল সে। যেখানে দম্ভ আর রুপ ছিল উজির নাজির। অথচ এখন চেহারায় বয়সের ছাপ মেকআপ দিয়ে খুব বেশী উঠানো না গেলেও এদেশের বানিজ্যিক সিনেমা দর্শকদের শিস পারমিতার ছবি থেকে উঠে গেছে, কয়েক বছর আগেই।

-শর্টটা নিয়ে নেই? লাঞ্চ ব্রেকের পর পারমিতা জিজ্ঞেস করে ডিরেক্টরকে।
-অবশ্যই ম্যাডাম।
- আমি রেডি। হাসিমুখে জানায় পারমিতা।
- ওকে। এবার যেন এক টেকেই পেয়ে যাই। ঠিক আছে?
- আচ্ছা হয়ে যাবে। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা কোথায়? আরেকবার চুলগুলোতে হাত চালিয়ে নেয় পারমিতা।
ডাক পড়ে প্রোডাকশন বয়ের। ডিরেক্টর মানিকের রাগ ক্রমে ফুটফরমাশ খাটা সুযোগ সন্ধানী ছেলেটির কাছ থেকে এক পর্যায়ে গিয়ে পড়ে তার সহকারীর উপর। সবার হাতে স্ক্রিপ্টের একটা করে কপি থাকার কথা, কিন্তু এরা করেছে কি?
এনে দেওয়া স্ক্রিপ্টে চোখ বুলোয় পারমিতা। দৃশ্যটা এমন যে, গুন্ডা পান্ডার বিরাট একটা দল এসেছে নায়িকাকে অপহরন করতে, নায়িকার সাথে গুন্ডা দলের সর্দারের একটা ছোটখাট ধস্তাধস্তি হবে, পাশে থাকা নায়িকার বড় বোন মানে পারমিতা চেঁচিয়ে উঠবে। সাথে দুটি সংলাপ।
খবরদার!
ওকে ছেড়ে দে শয়তান।

ব্যস এটুকুই।

খবরদার ! চিতকার করে উঠে পারমিতা। সাথে সাথে স্টপ ইট বলে উঠে মানিক। আরেকটু জোরে বলুন প্লিজ। দর্শক যেন এই জায়গাটায় থ্রিল পায়। এরপরেই নায়কের এন্ট্রি আর ক্লাইমেক্স। কাজেই...
আবার চেঁচায় পারমিতা। খবরদার, ওকে ছেড়ে দে শয়তান। ক্যামেরার রোলে দৃশ্যগুলো প্যাঁচাতে থাকে, যেমন প্যাঁচিয়েছে পারমিতা দত্তকে, এককালের ডাকসাইটে নায়িকাকে, ওর উত্থান থেকে আজ অবধি। হয়তোবা এক নক্ষত্রের পতনকাল পর্যস্ত।

হাততালির শব্দ শুনতে পায় সে। শব্দটা পরিচিত ঠেকলো কি? নাকি অনেকদিন থেকে বুভুক্ষু সে, আর আজ খিদেটা আবার জেগে উঠেছে কিছু মিয়ম্রান স্মৃতির ডুবোচরে ভেসে? সেই প্রথম দিকটার কথা মনে পড়ে যায় পারমিতার।' তুমি আমার ' সুপার হিট হওয়ার পর কোএক্টর সুব্রত এক জলসায় বলেছিলো, এই সিনেমা পাড়ায় খিদেটা একটু অন্যরকম।ইভেনিং শো আর নাইট শোতে যার ঝুড়িতে যত তালি পড়তে থাকবে, ধরে নাও তার খিদেও বাড়তে থাকবে। এই খিদে মেটাতে প্রযোজকদের এবাড়ি ওবাড়ি, পরিচালকদের তোড়জোড়, কি নেই?

- অবশেষে! দারুন হয়েছে। তবে, সিনটাকে আরো একটু রিয়েলেস্টিক করা যায়। মানিকের চোখ তখনো স্ক্রিনে। আর মানিকের কথায় সংবিত ফিরে পায় পারমিতা।
- কীভাবে? মানিকের দিকে তাকায় সাবেক নায়িকা। হাত নেড়ে কি যেন বুঝাচ্ছে মানিক। পারমিতার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মোটেও। খুঁতখুঁতে এক ডিরেক্টরের পাল্লায় পড়ে এমনিতে কম হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে না তারউপর শরীরটাও তার বিশেষ ভালো নেই। কেমন এক ক্ষুধার্ত অনূভুতি যেন তলপেট থেকে সোজা শিরদাঁড়া হয়ে মাথার তালুতে বয়ে যাচ্ছে। আর প্রতিক্রিয়া ও অতিপ্রতিক্রিয়ার পার্থক্য ভুলে সমস্ত সত্তা যেন আজ একত্রে মঞ্চে উঠতে চাইছে!
- ম্যাডাম! হাত নাড়িয়ে ডাকে মানিক। শুনতে পাচ্ছেন?
- হু, মাথা দুলিয়ে সায় দেয় পারমিতা।
-তা হলে যা বলছিলাম, বুঝতে পেরেছেন?
-আরেকবার বলো।
সহকারী পরিচালক এবার এগিয়ে এলো। মানে, ডায়লগ আগের মতো থাকবে। শুধু মাঝখানে নতুন ম্যাটারিয়াল হিসেবে নিচে পড়ে থাকা পাথরটা এড হবে।
- হু।
- সিনটা শুরু হবে আপনাকে ফোকাস করে। ক্লোজ শট।
- আমার কি এই শেষ সিন?
-হু, আপনার তিনটা সিনের মধ্যে এটাই শেষটা।
-তারপর?
- তারপর কিছু না, আপনি আপনার বোনকে বাঁচাতে চেষ্টা করবেন। হাতে পাথর নিয়ে তেড়ে আসবেন গুন্ডার দিকে। চাইলে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারেন।
- বুঝেছি।

একশ্যান। বলতেই পেন্ডুলামের মতোন দুলে দুলে গুন্ডার দল ছুটে যায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নায়িকার দিকে। হাততালি পড়তে থাকে, শিস বাজতে থাকে, দৃশ্যে নায়িকা ছুটে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। এবার পারমিতার পালা, কিন্তু পারমিতা কোথায়?

পারমিতা আছে। এক পারমিতা খানিকক্ষন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয় ঠিকই কিন্তু ভিতরে লুকানো অন্য পারমিতা অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত ঘটনাপ্রবাহে মিশিয়ে একাকার করে ফেলে। এক পারমিতা স্ক্রিপ্টের সংলাপ ঝাড়তে ঝাড়তে কুড়িয়ে পাওয়া চোখা পাথর তুলে নিয়ে সিনেমায় পাতানো বোনকে বাঁচাতে এগিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু অন্য পারমিতা সমস্ত সচেতনতা আর অসচেতনতাকে সেলুলয়েডের পাতায় বন্দি করার নেশায় মেতে উঠে।

হঠাৎ গ্যাঁক করে একটা শব্দ হয়।
একটা তৃপ্তি আর একটা অস্ফুট অার্তনাদের করুণ রাগিনী বেজে উঠে কোথায় যেন! চমকে গোটা শুটিং ইউনিট তাকায় পারমিতার দিকে, আর পারমিতা ফিরে তাকায় নিজের হাতের চোখা পাথরের দিকে, এইমাত্র যেটা সে বড়সড় এক গুন্ডা বা জুনিয়র আর্টিস্টের চোখে গেঁথে দিয়েছে। একদম ভিতরে।

কান পাতে পারমিতা। হাততালি পড়বে না?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৫:৪৩
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×