একটি শিশুর ব্রেইন ৫ বছর বয়সে এডাল্ট ব্রেইন সাইজের খুব কাছাকাছি চলে যায়। গবেষকরা এও বলে থাকেন যে মাত্র ৫ থেকে ৭ বছর বয়সে একটা বাচ্চা ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রবণতা দেখায়, এবং অনেকসময় ব্যক্তিত্বের অনেকটাই বিকশিত হয়ে যায়। ছোটকালের খারাপ অভ্যাস, কথাগুলো বড়বেলায় ছাড়া তাই খুব মুশকিল হয়ে যায়। বিদ্যালয় থেকে সুবিদ্যার আলোতে যেন আপনার সন্তান বের হয়ে আসে সেটাই নিশ্চই চান। কিন্তু স্কুল থেকেই অনেকসময় গড়ে ওঠে কিছু খারাপ অভ্যাস। জেনে নিন সেসবের ব্যাপারে এবং সচেতন হোন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১) কারো দুর্দশায় হাসাহাসি!
আমাদের দেশে স্কুলে নানা ধরণের শাস্তি রয়েছে। বোর্ডের সামনে গিয়ে এক পায়ে দাড়িয়ে থাকা, কান ধরে বেঞ্চের ওপরে দাড়িয়ে থাকা পুরো ক্লাস, হাত সামনে পেতে বেতের মার, নানা সাইজের স্কেলে অপরাধ অনুযায়ী মার, ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি, কান মলে দেওয়া ইত্যাদি। অনেক শাস্তি শিক্ষকেরা ইচ্ছে করে লজ্জা দেবার জন্যে দেন। যেমন এক স্টুডেন্টকে দিয়ে অন্য স্টুডেন্টে কান মলে দেওয়া। আর কেউ শাস্তি পেলে পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির রোল বয়ে যায়। হাসাহাসির বিষয়টিতে শিক্ষকেরাও অনেকসময় কিছু বলেন না, নিজেও হাসিতে যোগ দেন।
শিক্ষকেরা এই কাজটি ভালো মনেই করেন। তারা ভাবেন আজ লজ্জা দিলে কাল বাচ্চাটি হোমওয়ার্ক করে আসবে। তবে শিশুর মনোজগৎ এত সহজ হিসেবে চলে না। প্রথমত শিক্ষকের শাস্তি দেবার ব্যাপার একদমই ভুল। এসব শিশুর মনে মারাত্মক বাজে প্রভাব ফেলে। সে হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। বড়দের এটা মনে রাখতেই হবে যে শিশুদেরও মান অপমান বোধ থাকে, এবং সেখান আঘাত করা অপরাধ। ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করে বলে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারেনা। সবমিলে একা একা স্কুলজীবন অনেক কষ্টের হয়ে যাওয়ায় স্কুল মিস দিতে থাকে। আর সেই টাইমটা পাড়ার বখাটে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশে বেড়ায়।
যার ওপরে হাসা হচ্ছে শুধু সেই নয়, যেসব বাচ্চারা হাসছে তারাও কিন্তু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ছোট থেকে তাদের মাথায় গেঁথে যাচ্ছে যে অন্যের শাস্তি ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সমব্যাথী না হয়ে হাসতে হয়!
অনেক ছোটকালে, তখন বোধহয় থ্রি তে পড়ি, আমাদের ক্লাসে একটি ছেলে ছিল, সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। টিচারের প্রশ্নের জবাবে কিসব বিড়বিড় করে বলত। তার বাবা মা স্কুলকে অনেক টাকা দিয়ে ভর্তি করিয়েছিল। সে যখনই আবোলতাবোল বকা শুরু করত, পুরো ক্লাস হাসত! কেউ একটু অন্যরকম হলেই হাসতে হয় সেটা আমি স্কুলের সবাইকে দেখে শিখে গেলাম।
একদিন বাড়িতে এসে খুব রসিয়ে মাকে গল্প করছি ছেলেটির ব্যাপারে। মা আমাকে বলল, "ছি মা! ওর জায়গায় তুমিও থাকতে পারতে। আল্লাহর কাছে শোকর কর যে তোমার তেমন পরীক্ষা তিনি নেননি। ছেলেটির বাপ মার ই না কত কষ্ট! আহারে! কখনো অসহায় কাউকে নিয়ে হাসবে না!"
আমার মাথায় মায়ের সেই শিক্ষা যে একবার ঢুকল আর বের হয়নি। টিচারেরাও অবাক হয়ে যেতেন, এই একটা মেয়ে কারো ওপরে হাসিঠাট্টা করেনা! অন্যরকম স্নেহ করতেন আমাকে সেজন্যে সবাই।
আমার মাকে আমি স্কুলে হওয়া প্রতিটি ঘটনা বলতাম। মা শুনতেন, উপদেশ দিতেন। এই কালচারটি প্রতি ঘরে ঘরে তৈরি করতে হবে। অফিস, ব্যাবসা, সংসার, টিভি, বিনোদন যতো যাই প্ল্যান থাকুক না কেন, প্রতিদিন নিজের বাচ্চার সাথে গল্প করুন। তার বন্ধুরা কেমন, টিচারেরা কেমন ব্যবহার করছে কৌশলে গল্পের ছলে জেনে নিন। শিক্ষকের সাথে সাথে পরিবারকেও মারধোরের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। যদি শোনেন আপনার বাচ্চাকে মারধোর করা হয় ক্লাসে তবে সেই টিচার এবং হেডমাস্টার/হেডমিস্ট্রেসের সাথে কথা বলুন। আপনি সচেতন হলে আপনার বাচ্চার প্রতিও সচেতন হবে সবাই। আর সন্তানকে ঠিক ভুল শেখান। তাহলে বড় হয়ে সে কারো কষ্টে হাসবে না, বরং পাশে দাড়ানোর মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠবে।
২) হোমওয়ার্ক, এক্সামে বন্ধুদের কাছ থেকে কপি করা!
আজকাল শুনি বাবা মা নিজেরাই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন! বিশ্বাস হয়না! সন্তানের ভালো মার্ক, ও ক্যারিয়ারের জন্যে তাদের মূল্যবোধের বিষয়টি দেখেনই না! আর অনেকে প্রত্যক্ষভাবে কিছু না করলেও, এ বিষয়ে তেমন সচেতনতা দেখান না।
পরীক্ষার সময়ে বাচ্চাকে সাধারণত যে কথাগুলো বলা হয়:
১) ভালো করে পরীক্ষা দিস।
২) সহজ প্রশ্ন আগে করে মার্ক তুলে নিয়ে কঠিন গুলোতে হাত দিস।
৩) ঠান্ডা মাথায় লিখিস।
৪) সময়ের মধ্যে সব শেষ করিস।
৫) হাতের লেখা, বানানের দিকে নজর দিস।
৬) যদি পরীক্ষা খারাপ হয় তো দেখিস তোকে কি করি!
ওপরের কথাগুলোতে ভুল কিছু নেই, বলা উচিৎ। কিন্তু পাশাপাশি পরীক্ষা যেমনই হোক কারোটা দেখে লিখিস না এমনটা আমি ছোটবেলায় কোন আংকেল আন্টিকে বলতে শুনিনি। সবাই ব্যাস ভালো পরীক্ষার ব্যাপারে জোর দিত। অনেক আন্টি আবার আমাকে বলত যে, "মা, ও না পারলে একটু দেখিয়ো!" ভাবতে পারেন?
আপনি ভাবছেন এভাবে আপনার সন্তান জীবনে উন্নতি করবে। আর ছোট বয়সে দু একটা প্রশ্ন কারো থেকে দেখে লিখলে কি হবে? কিন্তু সত্যি হল সাময়িকভাবে সে ভালো করলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাবে। তার মনে হবে চিটিং করা খারাপ কিছু নয়। অন্যের ঘাড়ে করে খাওয়ার নামই জীবন। সাফল্য যেভাবে আসুক কোন ব্যাপার না। নীতি আদর্শ জরুরি না। এভাবে জীবন চালাতে চালাতে বয়স বাড়বে, এবং আপনার সন্তানের ভুল গুলো বড় হতে থাকবে। জীবনের কোন এক পর্যায়ে সে ঠোকর খাবে, বিপদে পড়বে। তাই নিজের সন্তানকে অন্যের পরিশ্রমের ওপরে ভর দিয়ে নয়, কঠোর পরিশ্রম করে ভালো মার্ক অর্জন করতে বলুন। এতে করে সে জীবনে সার্বিকভাবে উন্নতি লাভ করবে।
৩) অপোজিট সেক্সের ব্যাপারে!
আপনার সন্তান স্কুলে অন্য জেন্ডারের মানুষের সাথে মিশবে, খেলবে, পড়বে। তাই কিছু ব্যাপার তাকে শেখাতে হবে কম বয়সেই।
ছেলেদেরকে মেয়েদের দিকে ঠিকভাবে তাকানোর, ভদ্রভাবে কথা বলার ব্যাপারে উপদেশ দিন কৈশোরে পা রাখা মাত্রই। একজন নারী যে মানুষ, তারও আত্মসম্মানবোধ, ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে সেটা ছোট থেকেই ছেলেদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। একজন মা কে বিশেষ করে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। নারীদের খারাপ লাগা ভালো লাগা তিনিই সবচেয়ে ভালো বোঝাতে পারবেন। আর বাবাকেও খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন তিনি সন্তানের মায়ের সাথে সম্মানজনক আচরণ করেন।
পরিবারে ছেলেকে বেশি খাবার দেওয়া, ছেলে রাত করে ফিরবে মেয়ে বিকেলেই, এমন সব নিয়ম রাখা যাবেনা। স্কুলে শিক্ষকেরা "মেয়ে হয়ে এত দুষ্টু!" এমন কিছু বলতে পারবেন না। ছেলেরা ভাববে দুষ্টুমি ও শয়তানির স্বাধীনতার শুধু তাদেরই আছে। মেয়েদের কাজই বেশি মানিয়ে গুছিয়ে চলা এবং তারা মেয়েদের চেয়ে সুপিরিওর একটি প্রাণী। এমন সব ভুল ভাবনা যেন ছেলেদের মাথায় প্রবেশ না করে। যা নিয়ম হবে সমান হবে। আপনার ছোট ছোট কথা, আচরণ কিন্তু সে পিক করছে আপনারই মনের অজান্তে। তাই খবরদার দেরী করবেন না। কোন বাচ্চা ধর্ষক হয়ে জন্মায় না, অল্পবয়সেই একজন ছেলেকে যদি নারীর সম্মান নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে পুরুষ হবার পরে তারা ধর্ষন, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপের মতো অপরাধ করবে না।
মেয়ে শিশুদেরও সাবধানে থাকার ব্যাপারে বলুন। কোন শিক্ষক, সহপাঠী, পাড়ার ভাই, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে যেন নির্জন জায়গায় না যায় সেটা জানিয়ে দিন। কেউ বিরক্ত করলে সাথে সাথে যেন বাড়িতে জানায়। যে জামানায় তিন বছরের বাচ্চাও ধর্ষিত হয় সেখানে সাবধান থাকা ছাড়া পথ নেই।
যে বিষয়গুলো নিয়ে বললাম সেগুলো নিয়ে সন্তানের সাথে কথা বলা অস্বস্তির হতে পারে, তবে তার ও সমাজের সুস্থ ভবিষ্যৎ এর জন্যে বলতেই হবে। আর একেবারে নিজে না পারলে তার কোন চাচা/মামা/ফুপি/খালা যার সাথে ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক, তাকে দায়িত্বটা দিয়ে দিন। আগেকার দিনে যৌথ পরিবারে থাকার দরুণ একটি বাচ্চাকে গাইড করার অনেকেই থাকত। আজকাল সেটা নেই, সব দায়িত্ব চাকুরিজীবি বাবা মায়ের ওপরে। সারাদিন অফিস সংসার সামলে তারাও শিশুকে সময় দিতে পারছেন না। ব্যাপারটি আমাদেরকে কোথায় যে নিয়ে যাবে সেটা ভেবেই আমি ভয় পাই!
আমার অনুরোধ থাকবে যে যদি মনে করেন একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনার পরে তাকে যথাযথ যত্ন ও সময় দিতে পারবেন না, তবে শুধু মাত্র পরিবার ও সমাজকে খুশি করার জন্যে মা বাবার টাইটেলটা নিয়ে বসবেন না। যারা "বাচ্চা নাও, বাচ্চা নাও" বলে চিল্লাচ্ছে তারা এক বেলা আপনার বাচ্চার খেয়াল রাখতে আসবে না। শিশুর জন্যে ক্যারিয়ারের ব্যাপারে বাবা মা কাউকে একটু স্যাকরিফাইস করতেই হবে। দুজনেই যদি সকালে বেড়িয়ে রাতে ফেরে তবে সমস্যা। হয় যৌথ পরিবারে নানা নানী, দাদা দাদীর সাথে থাকুন বাচ্চা মানুষে সাহায্য পেতে। অথবা দুজনের একজন চাকরি না করে বা পার্ট টাইম জব করে শিশুকে সময় দিন।
মনে রাখবেন, আপনি যদি একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনেন তবে তার সুস্থ ও সুন্দর জীবন, উন্নত মূল্যবোধের বিষয়টি আপনার দায়িত্ব।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখিকার শেষ কিছু কথা: ছয়টির সবগুলো দেওয়া গেল না, কেননা পোস্টটি বেশি বড় হয়ে যাচ্ছিল। পরের পর্বটি জলদি দেবার চেষ্টা থাকবে, সবাই পড়বেন দয়া করে। কিছু জরুরি পয়েন্ট সেখানে ডিসকাস করব।
ওহ, লেখার আইডিয়াটি আসে একটি ঘটনা থেকে। বেশ কিছু বছর আগে আমার এক কাজিন সে টু তে পড়ত বোধহয় তখন, তার টিচার হোমওয়ার্কের লেখায় মিল খুঁজে পায় অন্য দুটি বাচ্চার সাথে। একই জায়গায় কাটাকাটি, একই বানান ভুল করেছে তিনজনই। প্যারেন্ট কল হয়, আমার চাচী রেগে আগুন।
বাচ্চাকে বকে খুব। আমার কাজিনটি তখন খুব ইন্নোসেন্ট গলায় বলে, "সবাই তো করে, কেউ তো বলেনি এটা ব্যাড!"
ঘটনাটি ঘটার টাইমে আমি ছিলাম না, শুনেছি ফোনে যে এমন হয়েছিল। প্রথমে হেসে ফেললেও পরে ব্যাপারটি খুব নাড়া দিয়েছিল আমাকে। আসলেই তো, বাচ্চাদেরকে ফার্স্ট হতেই হবে এই শিক্ষা তো পরিবারের সবাই দিয়ে দেয়। কিন্তু চরিত্রগত দিকগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা কজন করে? তিনজনই খুব সরল মনে কপি করেছিল, ওরা বোঝেইনি এটা অন্যায়! এজন্যেই তো কাটাকাটি গুলো পর্যন্ত এক ছিল! সেটা ছোট ব্যাপার ছিল। একবার আমাদের দেশে একটি ধর্ষনকান্ড হয়, বড়লোকের সেই ছেলেগুলো বলে তারা নাকি জানতই না ধর্ষন শাস্তিযোগ্য অপরাধ! পার্টিতে অহরহ তারা এসব করেছে! শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে!
পেপারে, ক্রাইম শোতে শিশু, কিশোরদের অধ:পতন দেখছি। ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রেম, ব্রেকআপ, ড্রাগস, গ্যাং, বিপদজনক বাইক স্ট্যান্টস কতকিছু করছে ছোট ছোট বাচ্চারা! অবাক হয়ে যাই। পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। বাচ্চারা কাদামাটির মতো। একবার একটা শেপে আসার পরে তাদেরকে আর পাল্টাতে পারবেন না। তাই এখন থেকেই সাবধান হোন!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১২:০৩