somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষম পরিণাম (ফরহাদ মজহারকে এতদিন ‘শিক্ষিত’ লোক বলিয়াই জানিতাম) ।। সলিমুল্লাহ খান

১০ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতকাল (সোমবার ৪ মার্চ, ২০১৩) রাত্রে বেগম খালেদা জিয়ার একটি বিবৃতি প্রচার হইয়াছে। তিনি দাবি জানাইয়াছেন গত কয়েকদিনে -বিশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি হইতে শুরু করিয়া- দেশের স্থানে স্থানে হিন্দু জনগণের বাড়িঘর ও মন্দিরে মণ্ডপে যাহারা হামলা করিয়াছে তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। তিনি স্বীকার করিয়াছেন, এই কয়দিনে “বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা” তিনি জানিতে পারিয়াছেন। এই অপতৎরতা কঠোর হাতে দমনের জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাক দিয়াছেন।

কে বা কাহারা এই সকল ঘটনা ঘটাইতেছে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না। তিনি শুদ্ধমাত্র দোষ দিয়াছেন “গণবিচ্ছিন্ন” শাসকদের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করিবার চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে গণবিচ্ছিন্ন শাসকরা করিয়া আসিয়াছেন- এ সত্যে কাহারও সন্দেহ নাই। তাহা হইলে তিনি কি বলিতে চাহিতেছেন এই মুহূর্তে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের অপকর্মগুলিও বর্তমান ‘গণবিচ্ছিন্ন’ শাসক অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকার করিয়াছেন? ঘটনা সত্য হইলে তিনি বলিবেন না কেন, একশত বার বলিবেন। বলা তাঁহার অধিকার মাত্র নহে, কর্তব্যও।

প্রশ্ন হইতেছে, আমরা কেন তাঁহার কথায় কান দিব? কেন তাঁহাকে বিশ্বাস করিব? হামলায় যাহারা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন তাহারা কি বলিতেছেন তাহা কেন শুনিব না? বেগম জিয়ার সহিত তাহারাও কি একমত হইবেন যে সরকারই এই হামলার পিছনে? আমাদের মনে হয় বেগম জিয়া কিছু একটা আড়াল করিতেছেন। যাহাকে তিনি আড়াল করিতেছেন সেই বস্তুর নামই ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’। রাজনীতিতে যাহারা সাম্প্রদায়িক পরিচয়টা বড় করিয়া তুলিতে চাহেন, যাহারা সংখ্যাগুরুত্বের বখরাটা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করিবার লোভে তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার হরণ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন তাহারাই যে এই হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের পিছনে এই সত্যটাই কি বেগম জিয়া গোপন করিতে চাহিতেছেন? তাঁহার বিবৃতি পড়িয়া আমাদের ইহাই মনে হইয়াছে। কেন বলিতেছি।

বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন সারাদেশে হিন্দুদের বাড়িঘর মন্দির মণ্ডপে যাহারাই হামলা করিয়া থাকুক না কেন, তাহাদের কারণে এ দেশের সকল মুসলমানকে দোষ দেওয়া যাইবে না। কিন্তু যাহারা মুসলমান পরিচয়কে বড় করিয়া হিন্দুদের বাড়িতে হামলা চালায় তাহারাই ‘সাম্প্রদায়িক মুসলমান’। তাহারা কেন হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করে? কারণ কি এই যে হিন্দুরা এই দেশে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কায়েম করিতে চাহেন? কি চাহেন তাহারা? তাহারা চাহেন ( অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে) ধর্মনিরপেক্ষতা, তাহারা চাহেন ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ। এই তো তাহাদের অপরাধ?

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটা অনেক অপব্যাখ্যা হইয়াছে। অপব্যবহারও কম হয় নাই। ‘জাতীয়তাবাদ’ কথাটারও ঢের অপপ্রয়োগ হইয়াছে। এখনও কম হইতেছে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা চিহ্ন আছে যাহা হইতে এই দুইটা কথার অর্থপ্রকার নির্ণয় করা সম্ভব। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাণ্ডারীগণ তাহা করিতে চাহেন না। তাহারা বুঝিতেই চাহেন না এ দেশে একাধিক ধর্মের মানুষ আছে। কিন্তু রাষ্ট্র আছে মাত্র একটি। তাই রাষ্ট্রের ক্ষেত্র হইতে ধর্ম নিরপেক্ষ। সহজ কথা।

ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাকালের নেতা মুজফ্ফর আহমদ ১৯২৬ সালে লিখিয়াছেন, ‘একটি ধর্মের নিয়ম-কানুনের সহিত আর একটি ধর্মের নিয়ম-কানুনের প্রায়ই মিশ খায় না। অধিকাংশ স্থলে এ নিয়ম-কানুনগুলি পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ধর্ম জিনিসটা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর পক্ষে ব্যক্তিগত সাধনার বস্তু হলে তা সহ্য করতে পারা যায়। কিন্তু তা না করে যখনি আমরা আমাদের ধর্মকে অপর ধর্মাবলম্বীর সহিত বোঝাপড়ার ব্যাপারে পরিণত করি তখনি ধর্ম সাধারণভাবে সমগ্র দেশের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠে।’

যে ধর্মের সংকীর্ণতা সে ধর্মের মধ্যে থাকিয়াই উদার হইতে পারে। আবার সংকীর্ণও হইতে পারে। কিন্তু দেশের নানান ধর্মাবলম্বী লোকের একটা সাধারণ মিলনক্ষেত্রও দরকার। এই রকম একটা মিলনক্ষেত্র এমনিতেই তৈরি হইয়াছে। দুনিয়াদারি বা অর্থনীতি বলিয়া তাহার পরিচয়। হিন্দু আর মুসলমানে একত্রে ব্যবসায় বাণিজ্য করিতে অসুবিধাটা কোথায়? কিংবা বৌদ্ধে আর খ্রিস্টানে? অর্থনৈতিক জীবন গড়িয়া ভরিয়া উঠিতে হইলে ইহার অন্যথাও নাই। অর্থনীতির মতো সমস্বার্থে যে যে ক্ষেত্রে মানুষ মিলিত হয় সে সে ক্ষেত্রের ন্যায় রাষ্ট্রীয় জীবনও আরেকটা ক্ষেত্র বিশেষ বৈ কি। একদা এয়ুরোপে অর্থনীতি ও রাষ্ট্র দুইটাকেই ‘সিভিল সোসাইটি’ বা ‘জাতীয় সমাজ’ বলিয়া ডাকিত। আজিকালি প্রথম ক্ষেত্রকে ‘জাতীয়’ বলে আর দুই নম্বরকে বলে ‘রাষ্ট্রীয়’। এই দুইটার বাহিরের ক্ষেত্রে ধর্মের ক্ষেত্র থাকিবে। ব্যক্তি জীবন ও পরিবার যে ক্ষেত্রে সেখানে ধর্মক্ষেত্র অবস্থিত হইবে। মুজফ্ফর আহমদ দুঃখ করিয়া লিখিয়াছিলেন, আমাদের দেশে সেই ১৯২০ সালের পরেও তেমন ( ধর্মনিরপেক্ষ) রাষ্ট্রীয় জীবন গড়িয়া উঠে নাই। তাই ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র হইয়া পড়িয়াছে।

কেন রাষ্ট্রীয় মিলনক্ষেত্র গড়িয়া উঠিল না? কেন সাম্প্রদায়িক গণ্ডিগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িল না? মুজফ্ফর আহমদ এই প্রসঙ্গে লিখিলেন, ‘কিন্তু এমন একটা প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। কংগ্রেসের ভিতর দিয়ে এরূপ রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে উঠা উচিত ছিল বটে, কিন্তু তা হয়নি।’ কেন হয় নাই তাহা জানিতে তিনি দুইটা কথা যোগ করিলেন: ‘ প্রথম কথা, কংগ্রেসের সহিত কখনো দেশের সর্বসাধারণের জীবনের যোগ সাধিত হয়নি। ভদ্র ও অভিজাত লোকেরাই কংগ্রেসের সর্বেসর্বা, জনসাধারণ তার কেউ নয়। দ্বিতীয়ত, মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসকে একটা ধর্মচর্চার ক্ষেত্র করে তুলেছিলেন।এই অসম জিনিসের একত্র সমাবেশ করার চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী বিষময় ফল এখন দেশে ফলেছে।’

মুজাফ্ফর আহমদ যে বিষময় ফলের কথা লিখিয়াছিলেন সেই ফল এখন পাকিয়াছে। শুদ্ধমাত্র পাকে নাই ফাটিয়াও গিয়াছে। পাকিস্তান হইয়াছে। আবার এদিক বাংলাদেশও হইয়াছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষম পরিণতি আরও পরিণত হইয়াছে।

কবি ফরহাদ মজহারকে আমি এতদিন মোটামুটি ‘শিক্ষিত’ লোক বলিয়াই জানিতাম। কথাটা এমন ফলাও করিয়া বলিবার বিষয় হইত না। ( পাছে কেহ অপরাধ লইবেন বলিয়া ভয়েই বলিতেছি আমি নিজে কিন্তু বড় শিক্ষিত ব্যক্তি নই)। তিনি সম্প্রতি এক বক্তৃতায় দাবি তুলিয়াছেন রাজনীতির ক্ষেত্রেও ( তাঁহার ভাষায় ‘রাজনৈতিকতা ও রাষ্ট্রের স্তরে’) এসলামকে স্বীকার করিতে হইবে। কেন করিতে হইবে? কারণ- দেশের মানুষ ‘ধর্মপ্রাণ’। মানুষ মানে কি তাহা হইলে মাত্র মুসলমান? এই প্রশ্নের কোন উত্তর নাই।

মুজফ্ফর আহমদ যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়াছিলেন ( আজ হইতে মাত্র ৮৭ বছর পূর্বে) সরাসরি তাহার বিপরীত কোটিতে দাঁড়াইয়া কবি গাহিয়াছেন,‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ’ আর তাহাদের ‘আত্ম-পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান’। ‘আত্ম-পরিচয়’ বলিতে কি বুঝাইতেছেন তিনি? পরের বাক্যেই তাহা পরিষ্কার হইয়াছে। এই পরিচয় তাঁহার মতে রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রসারিত হইবে। ফরহাদ মজহার বলিয়াছেন: ‘সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র অতিক্রম করে ভাষা ও সংস্কৃতিকে যদি রাজনৈতিকতা ও রাষ্ট্রের স্তরে উন্নীত করে আপনি দাবি করেন, এই স্তরে- অর্থাৎ আপনার রাজনৈতিক পরিচয়ে শুধু ‘বাঙালিত্বই’ স্বীকার করা হবে ইসলামকে স্বীকার করবেন না। তখন আপনি যেমন ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক ঝাণ্ডা বানিয়ে সামনে দাঁড়ান, তখন আপনি চান বা না-চান, প্রতিপক্ষ হিসাবে ইসলামও তার ধর্মের ঝাণ্ডা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় । দাঁড়াতে বাধ্য। দাঁড়াবার শর্ত তৈরি হয়ে যায়।’

‘শিক্ষিত ‘লোক হইয়াও ফরহাদ মজহার সারা পৃথিবীকে কি করিয়া এহেন নির্বোধ ভাবিলেন ভাবিয়া অবাক হইতে হয়। একমুখে বলিতেছেন ‘বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ’ ‘অবশ্যই ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালি’; আবার একই নিঃশ্বাসে দাবি করিতেছেন ‘একই সঙ্গে ধর্ম ও তাদের সংস্কৃতির অংশ’ বা ‘ধর্ম তাদের আত্ম-পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান’। ইংরেজি জবানে এই ধরনের তর্ককেই বলে সোফিস্ট্রি বা কুতর্ক। সমস্যাটা কোথায় ছিল আর সেটাকে কোথায় লইয়া আসিলেন?

‘ইসলাম’ যদি ঝাণ্ডা লইয়া দাঁড়ায়, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম বা খ্রিস্টধর্ম কেন দাঁড়াইবে না?

সমস্যাটা ছিল একটা সাধারণ সূত্র পাওযার। কিভাবে সকল ধর্মাবলম্বী লোকের উপযোগী ‘একটা সাধারণ মিলনক্ষেত্র’ সৃষ্টি করা যায়? এই সাধারণ মিলনক্ষেত্রের নামই রাখা হইয়াছে রাষ্ট্রীয় জীবন। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্ম-পরিচয় কি, শুদ্ধমাত্র মুসলমান? খ্রিস্টান কি বৌদ্ধ কি কম ধর্মপ্রাণ? কিংবা হিন্দু জনগণ কি ধর্মপ্রাণ শব্দটার অর্থ বোঝেন না? অহংকারটা কি এখানে সংখ্যার নহে?

আপনি যদি ক্ষমাহীন সাম্প্রদায়িক না হইয়া থাকেন তাহা হইলে কি করিয়া বলিতে পারেন ‘বাঙালি’কে এইভাবে দুইভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। যাহার ‘একদিকে [থাকিবে] বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা আর অন্যদিকে ইসলাম ও ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ’? বাঙালি জাতীয়তাবাদী হইলেই কি মানুষ অমুসলমান হইয়া যাইবে?

আপনার বাক্য যদি সত্য হয তো কবুল করিতে হইবে ‘বাঙালি’ শব্দের অর্থও ‘অমুসলমান’ হইয়া গিয়াছে। আপনি লিখিয়াছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষকে ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ - এই দুই ভাগে ভাগ করে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষের ধর্মানুভূতিকে আহত করা হয়েছে।” আশ্চর্য আপনার সাম্প্রদায়িকতা। ইহার পরিণাম শুদ্ধমাত্র দাঙ্গা নহে, সত্য সত্য গৃহযুদ্ধ। মুসলমান মুসলমানে।

মনে রাখিতে হইবে ‘বাঙালি’ শব্দটিও প্রাকৃতিক কিংবা স্বাভাবিক শব্দ নহে। শব্দটি ঐতিহাসিক। বাংলাভাষায় কথাবার্তা যাহারা বলেন তাহারাই ‘বাঙালি’। এই রকম একটা ধারণা হইতে ইহার শুরু। কিন্তু ইহার একটা বিকাশও ঘটিয়াছে। একদা বাঙালি বলিতে কেবল বাংলাদেশের (বর্ণ) হিন্দুজাতি বুঝাইত। অন্তত ১৯৪৭ সালের পর বা তাহারও কিছু আগে হইতে বাংলাদেশের ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানরাও নিজেদের পরিচয়ের অংশ হিসাবে ‘বাঙালি’ কথাটা এস্তেমাল করিতে শুরু করিয়াছিল। ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণে এই আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান শুরু হইয়াছিল তাহার চাপে বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমান আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে ছড়াইয়া পড়ে। পূর্ব বাংলার ‘বাঙালি‘ একসময় পাকিস্তানের ‘ইসলামী’ রাষ্ট্রকে বলিয়া দিল ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’। মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষও আছেন। তাহারা পাকিস্তান যুগের জাতীয় সংগ্রামে ধর্মীয় সংকীণ গণ্ডি ছাড়াইয়া হইয়া উঠিয়াছিলেন ‘বাঙালি’। তাই ‘বাঙালি’ পরিচয়টা ছিল যতটা না ধর্মীয় বা নৃবর্গীয়, তাহার অধিক রাষ্ট্রীয়। ফরহাদ মজহার ইতিহাসে অন্ধ ব্যক্তি। এই অন্ধকার ঘোর কলির অন্ধকার।

বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইবার পর বিশেষ করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এবং দেশের উত্তর আর উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে যে সকল জাতি নিজেদের অধিকারের জন্য লড়িয়াছেন তাহাদের লড়াই ন্যায়সংগত। তাহারা ধর্মে যেমন মুসলমান নহেন, বর্ণে ও তেমনি বাঙালি নহেন। তাই রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাহাদের পরিচয় হইল ‘বাংলাদেশি’। তাহাদের কল্যাণেই ‘বাঙালি’ বলিয়া কথিত সংখ্যাগুরু বর্ণটিও ( জাতিও বলিতে পারেন) এতদিনে হইয়াছে বাংলাদেশ। কাগজে কলমে এই তো। বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই কি ১৯৭২ সন হইতে ‘বাংলাদেশি’ নহেন? আপনার পাসপোর্টে পরিচয় কি লেখা থাকে?

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। ‘বাঙালি’ পরিচয়টা জন্মাইয়াছিল হিন্দু ও মুসলমানের। অমুসলমান ও মুসলমান স্ব স্ব সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়াইয়া উঠিয়া একটা বড় ‘জাতীয়’ বা ‘রাষ্ট্রীয়’ পরিমণ্ডল সৃষ্টি করিবার লক্ষে। তাহার পরিণতিতেই এক পর্যায়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক বর্তমান রাষ্ট্রটি জন্মলাভ করিয়াছে। এসলামের ঝাণ্ডা হাতে লইয়া কি নাঙা তলোয়ার উচাঁইয়া আজ আপনার মতন যে বা যাঁহারা লড়াইতে নামিয়াছেন তাঁহারা এই প্রজাতন্ত্রের গোড়ায় - ধর্মনিরপেক্ষতায় - আঘাত করিতেছেন। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে হিন্দু জনসাধারণের গতরে গায়ে যাহারা হাত তুলিতেছে তাহারা প্রজাতন্ত্রের এই ধর্মনিরপেক্ষ গণ্ডিটির গলার ছুরি জোরে জোরে চালাইতেছেন। ভাবিতেছে ইহাতেই ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ ধুলায় মিশিয়া যাইতেছে। বড়ই আপসোসের কথা।

বেগম খালেদা জিয়া যাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিবার আহ্বান জানাইয়াছেন তাহাদের এই আঘাতদাতাদের মধ্যেই পাওয়া যাইবে। এসলামের ঝাণ্ডা উড়াইয়াও এই হীন অপরাধ ঢাকা যাইবে না। সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম বিষম।

মার্জার বলিয়া একটা প্রাণী কবিদের মধ্যে বড়ই প্রিয়। এই প্রাণীর অপর নাম বিড়াল। সে আপনার কাটা জিহবার রক্ত আপনি চাটিয়া সুখ পাইয়া থাকে। সাম্প্রদায়িকতাবাদীর আত্মপ্রসাদ সেই মার্জারের রক্তসুখের মতন। তাহাতে রক্তের পিপাসা মিটিবে কিন্তু জিহবাও খসিয়া পড়িবে।

দোহাই
১. মুজফ্ফর আহমদ, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষম পরিণাম’, নির্বাচিত প্রবন্ধ ( কলকাতা : ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০১১), পৃ: ৪৪-৪৮।
২. ফরহাদ মজহার, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিণতি’, চিন্তা ( মোহাম্মদপুর, ঢাকা) ২ মার্চ ২০১৩।

ডঃ সলিমুল্লাহ খান: লেখক ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:২৪
২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন-হাদিস অনুযায়ী তারা পাকিস্তান এবং অন্যরা অন্যদেশ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২১



সূরাঃ ৮ আনফাল, ৬০ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬০। তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে, এছাড়া অন্যদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×