আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলো
আলী ভাই আর তার বন্ধু খাওয়া দাওয়া করার জন্য হোটেলে ঢুকলেও আমি গেলাম না। আমার ততোটা খিদে লাগেনি। আর আল্লাহর রহমতে আমার এখনো পর্যন্ত কোন সমস্যাই হয়নি। না বমি লাগা, না মাথা যন্ত্রণা,না দম বন্ধ হওয়া। কিচ্ছু না। আমি তো খুব অবাক। এমনকি আলী ভাই আর তার বন্ধু পর্যন্ত। তারা নাকি এখনো পর্যন্ত এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী কোন সুস্থ পর্যটক দেখেনি। সবারই কোন না কোন সমস্যা হয়েছে। ব্যাপারটি শুনে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তবে কি অসুস্থ না হয়ে পড়াটা আমার কোন সমস্যা। কিন্তু একটু চিন্তা করতেই কার্যকরণটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম।
আলী ভাই আর তার বন্ধুর খাওয়া শেষ হলে তারা গাড়িতে এসে উঠলেন। ঠান্ডার কারণে আমি আর তানজিং আগেই গাড়ির ভিতরে বসে ছিলাম। আলী ভাই গাড়ি ছেড়ে দিলেন। কিলং থেকে লেহ এর পথে চলার সময় বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামাতে হলেও আলী ভাই কখনো গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেননি। কারণ বাইরে এতো ঠান্ডা আর অক্সিজেনের পরিমাণ এতো কম যে যে একবার স্টার্ট বন্ধ করলে পরবর্তীতে আবার গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নাও নিতে পারে।
প্যাং এর একটা পাহাড় পরের রাস্তাটা একেবারে সোজা আর সমতল। দুপাশে উঁচু পাহাড় আর মাঝখানে সমতল রাস্তা চলে গেছে। রাস্তাটার কোথাও কোন উঁচু- নিচু নেই। এটাকেই মোর প্লেনস বলে। আলী ভাই এর পুরোপুরি সুযোগটা নিলেন। তিনি একশো কিঃমিঃর উপরের গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। দুপাশের সুদৃশ্য পাহারগুলো সাঁ সাঁ করে পিছিয়ে চলেছে। পুরাই অস্থির জায়গা। এই এলাকাটায় নাকি বিভিন্ন বন্য জীব-জন্তুর আবাসস্থল। তারা নাকি একসাথে হাজারে হাজারে চরে বেড়ায়। কিন্ত সেগুলো চাক্ষুস দেখার মতো অতোটা সৌভাগ্য আমার হলো না। তবে গাটালুপে তো আমি একগাদা বুনো পাহাড়ী হরিণের পাল দেখতে পেরেছিলাম।
তবে আমি আশেপাশের অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যগুলো হা করে গিলে চলেছি। এই রাস্তাটা প্রায় ৭০ কিঃমিঃ লম্বা।
জায়গাটা এতো অপূর্ব সুন্দর যে বলার মতো না। দুপাশে বালুর পাহাড়, যেগুলোর মাথায় বরফের ছটা। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মরুভূমিতে ছুটে চলার আনন্দই অন্যরকম। সারাদিনের আস্তে চলার পথ এখন আমরা উড়ে চলেছি। কারণ লেহ এখনো অনেক দূরে। আমি সেই রহস্যময় শহরের প্রতি অন্যরকম একটা আবেগ অনুভব করছি। যে শহরের পৌছানোর রাস্তা এতো অদ্ভুত রকমের, সেই শহরটা না জানি কতো সুন্দর।
অবশেষে বেলা পাঁচটার দিকে এসে পৌছালাম তাগলাংলা পাসে। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম সড়ক পথ। অর্থাৎ এটি হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় উঁচু রাস্তা যেখানে ইঞ্জিন চালিত গাড়ি যেতে পারে। তাগলাংলা পাসের উচ্চতা হচ্ছে ১৭,৫৮২ ফিট। এটি আমার জীবনে এখনো পর্যন্ত ওঠা সবচেয়ে উঁচু জায়গা।
জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর। এটি মানালি থেকে লেহ যাত্রাপথের সবচেয়ে উঁচু জায়গা।
মাইলফলকে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের ছোট ছোট কাপড়ের পতাকা টাঙ্গানো রয়েছে।
এই পাহাড়ের রঙটা কেমন যেন লালচে বাদামী ধরনের। বরফে সুসজ্জ্বিত হয়ে জায়গাটা কেমন যেন ঝকমক করছে।
জায়গাটাতে এসে আলাদা একরকম ভালো লাগায় আক্রান্ত হলাম। সত্যিই অদ্ভুত।
আল্লাহর রহমতে কোন রকম শারীরিক সমস্যা ছাড়াই আমি যাত্রাপথের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা পার হতে পেরেছি।
আমি নিজেই নিজের প্রতি অভিভূত। তাগলাংলা পাসের ঝোড়ো বাতাস ভয়ঙ্কর ঠান্ডা।
কয়েকটা ছবি তোলা শেষ হতেই আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। আসলে অনেক উঁচু পাহাড়ে রয়েছি বলে এখনো পর্যন্ত সূর্যের আলো পাচ্ছি, পাহাড়ের নীচের অংশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। লেহ এখনো অনেক দূর।
গাড়ি এবার নীচের দিকে নামা শুরু করেছে। কিছুদূর নামার পরে রাস্তাটা এমনভাবে হলো যে সূর্যের আলো সরাসরি আমার চোখে লাগা শুরু করলো। আর এর ফলেই আমার চোখ যন্ত্রণা শুরু হলো। এমনিতেই আমি সূর্যের আলো সহ্য করতে পারিনা, তারউপর বরফের উপর প্রতিফলিত হয়ে আসা শেষ বিকেলের আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে গেছে। আর এর ফলেই কিছুক্ষণ পর টুকটাক মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো।
চারিদিকে এতো বরফ তবুও আমার খুব গরম লাগছে। এমনকি আমার হাত-পা পর্যন্ত ঘেমে যাচ্ছে। ব্যাপার দেখে আলি ভাইতো অবাক। তিনি নাকি জীবনেও দেখেননি যে বরফের এলাকায় কারো ঘাম হচ্ছে। তাদের নাকি শীত করছে, আর আমার গরম লাগছে।
এখানকার পাহাড়গুলোতেও বরফ জমে আছে। পথের পাশের একটা পাহাড়ে দেখতে পেলাম যে কিভাবে প্রাকৃতিক বরফ জমাট বাধছে। এটা আমার কাছে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা ।
দুপুরে কিছু না খাওয়ার খেসারত দিতে লাগলো আমার শরীর। তবু আমি সামলাতে পারলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে শুধু চলেই যাচ্ছি। কিন্তু আমি তখন আমার জীবনের সেরা জায়গাটি পার হচ্ছি। রাস্তাটা এতো অসাধারণ সুন্দর যে কল্পনাতীত। ততোক্ষণে আমরা সমতল জায়গায় নেমে এসেছি। ব্যাটারিতে চার্জ নেই বলে একটাও ছবি তুলতে পারিনি। আর এই জায়গাটার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে পুরোপুরি অসম্ভব। ছোট একটা পাথুরে নদী। তাতে পানির চাইতে পাথরের সংখ্যা বেশি। পাশে খাড়া উঁচু পাহাড়। আর তাতে লাখ লাখ নয় কোটি কোটি ছোট আকারের পাথর। মনে হচ্ছে কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে। কিছু কিছু গাছপালা আর তার নীচে ঝরা পাতা পড়ে আছে। এই জায়গাটার দিকে তাকিয়েই শুধু মুগ্ধভাবে একটা জীবন কাটানো সম্ভব। আমি অপলক চোখে সবকিছু দেখছি।
অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে ছটার দিকে কারু পৌছালাম।
নদীটা তখনো সঙ্গে সঙ্গে আছে। ততোক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। এখানে আলী ভাই আর তার বন্ধু খাওয়ার জন্য থামলো। আমার তখন লেগেছে প্রচন্ড ভাতের খিদে। এইসব মোমো আর নুডুলসে আমার পোষাবে না। আমি শুধু পানি খেলাম। তানজিং দেখি ঝাল মোমো খেতে গিয়ে শিউরে উঠছে, তবু সেটা খাওয়া থামাচ্ছে না। ওর মুখটা এতো মিষ্টি দেখাচ্ছে।
কারু বেশ বড় একটা জনপদ। ছোট্ট একটা লোহার ব্রীজে নদী পার হয়ে এখানে পৌছাতে হয়। একপাশের রাস্তা লাদাখের রাজধানী লেহ এর দিকে চলে গেছে, আর অন্যটা চলে গেছে প্যাংগং লেকের দিকে। এখানে একটা পুলিশ চেক পোষ্ট আছে। সেখানে দেখলাম কড়া চেকিং হচ্ছে। আলী ভাই খাওয়া শেষ করে দৌড়ে চেক পোষ্ট থেকে ঘুরে এলেন। তারপর আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে জোরে টান। এখানেও পুলিশ আমাকে চেক করলো না। কারণ এখানেও তিনি আমাকে ইন্ডিয়ান আর তার আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে পার করেছিলেন।
এখানেই জানতে পেলাম এতোক্ষণ ধরে পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতধারাটি আসলে নদী নয়, এটি বিখ্যাত সিন্ধু নদ। শিহরিত হলাম। যার থেকে এই উপমহাদেশের নাম হয়েছে হিন্দুস্থান অথবা ইন্ডিয়া আর সনাতন ধর্মীয়রা পরিচিত হয়েছে ইন্ডুস বা হিন্দু নামে সেই বিখ্যাত সিন্ধু নদকে আমি পাশে নিয়ে চলেছি। শরীরে এক অপূর্ব শিহরন বয়ে গেল। খুবই সরু একটা পানির প্রবাহ। কিন্তু সে তার পূর্ণ গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেছে। পৃথিবীর সেরা প্রাচীন একটা সভ্যতার গর্বিত জনক সে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:১৮