somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কম খরচে আবার ভারত, বিশেষ পর্ব-২ ( আমার দেখা ভারতীয় নারীরা )

২০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলো
সামুতে আমার ভারত ভ্রমণ নিয়ে একটা সিরিজ লিখছি। এই সিরিজটা লেখালেখির সুবাদে বেশ কয়েকজনের সাথে আমার ব্যাক্তিগত পরিচয় হয়েছে। যাদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি তাদের অধিকাংশই ভারতে ভ্রমণে ইচ্ছুক। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন সেখানে তাদের নারী আত্মিয়দের সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তারা সন্দিহান নারীরা ভারতে নিরাপদ কিনা। এটা খুবই প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়। কারণ প্রায়ই মিডিয়া মারফত আমরা ভারতে নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের খবর পাই। এমনকি এটাও জানতে পারি যে সেখানে বিদেশী নারী পর্যটক পর্যন্ত নির্যাতিত হচ্ছে।


আমার মনে হলো ভারতে গিয়ে আমি নারীদের কিভাবে দেখেছি সে সম্পর্কেই কিছু একটা লিখে ফেলতে পারি। তবে এই লেখাটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ব্যাক্তিগত মতামত। আমি কাউকে আঘাত দিতে চায়নি এবং আমার মন্তব্যের সাথে কারো হয়তো মনের মিল নাও হতে পারে। এটা শুধু আমার একান্ত অবলোকন। আমি কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছি না।


আমার নানী তার যৌবনের সবচেয়ে মধুর সময়টা কাটিয়েছে কলকাতা শহরে। আমার নানা সেখানে চাকরী করতেন। কিন্তু একটা সময় আমার নানা-নানীকে কলকাতা ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে হয়। দেশভাগের ফলশ্রুতিতে অনেকগুলো মুসলমানের যে দীর্ঘশ্বাস আছে, তা সবসময় চাপা পড়ে যায় হিন্দুদের রক্তের নীচে। আর এই যন্ত্রণার জের বয়ে চলেছিলো অনেকগুলো বছর। যায় হোক, সেসময় কলকাতায় যখন দাঙ্গা বাধতো তখন আমার নানীকে খুবই তটস্থ থাকতে হতো। খুব বেশি সুন্দরী না হলেও ষোল-সতের বছরের সুশ্রী এক মুসলমান তরুনী। একগাদা হিন্দু লোক যদি তার বাড়িতে হামলে আসে তার তখন কিই বা করার আছে? তবে আমার নানীর এই বিপদ থেকে রক্ষা করে নানীর এক সই, যে ছিলো এক হিন্দু নারী।


একটা সময় বাঙ্গালি নারীদের মধ্যে সই পাতানোর একটা ট্রাডিশন ছিলো। এবং এই সই পাতানোর কিছু আনুষ্ঠানিকতাও ছিলো। কিছু বিষয় এবং দ্রব্য আদান-প্রদান করতে হতো এবং কিছু বিষয়কে সাক্ষী রাখতে হতো। এক সই অন্য সইয়ের নিকট খুবই মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ রুপে অভিহিত হতেন। তো আমার নানীর সাথে সই পাতিয়েছিলো হিন্দু এক নারী। যার সাথে আমার নানীর অনেক বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল ছিলো যে তারা দুজনেই কালো এবং তাদের দুজনেরই একটা করে কন্যা সন্তান।


দাঙ্গার সময় নানীর সই তার নিজের হাতের একটা শাঁখা খুলে পড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার নানীকে। আর দিয়েছিলেন এক কৌটা সিঁদুর। ষাট-সত্তর বছর আগে একজন সাধারন হিন্দু সধবা বাঙ্গালি নারী তার নিজের হাতের শাঁখা খুলে দিচ্ছে তাও আবার একজন মুসলমান নারীকে এটা খুব সহজ ব্যাপার ছিলোনা। সামাজিক এবং ধর্মীয় বাঁধা প্রতিরোধের জন্য খুব মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়েছিলো নিশ্চয়। আর এটা তিনি করেছিলেন তার সইকে বাচানোর জন্য।


আমার নানী এখনো আক্ষেপ করেন যে, মরার আগে তার সইয়ের মুখটা যদি আরেকবার দেখতে পেতেন। মাঝখানে এতোগুলো বছর কেটে গেল, আর কখনো কেউ কারো দেখা পাননি। আমার নানা নাকি কয়েকবার নানীর সইয়ের খবর জানার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি সফল হননি।


যায় হোক, আমার সাথে পুরানো দিনের এসব গল্প করার সময় আমার নানী একবার আমাকে বলেছিলেন যে ওখানকার মহিলারা নাকি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে। তারপর তিনি সেটার বর্ণনাও দিয়েছিলেন। আমি যদি এখানে সেটার বর্ণনা দিতে যায় তাহলে নির্ঘাত আমাকে অশ্লীলতার দায়ে পড়তে হবে। তবে এই ব্যাপারটা সত্যি কিনা আমি জানি না। কারণ আমি ভারতে ভ্রমণের সময় এরকম কোন ব্যাপার দেখিনি, আর আমার পক্ষে এরকম কোন ব্যাপার দেখা একেবারেই সম্ভব ছিলো না। উপরুক্ত প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ আমার নানীর মতামত।


বাংলাদেশ থেকে বাই রোডে বেনাপোল দিয়ে ভারতে যাবার সময় দেখা যায় নারী বিএসএফ সদস্যদের। পুরুষদের সাথে সমান তালে তারাও ডিউটি দিচ্ছে। বিএসএফ এর পোষাক পরা কাউকে দেখলেই আমার কেমন যেন ঘৃণা লাগে, সে পুরুষ হোক অথবা নারীই হোক। একবার বর্ডার পার হবার সময় এক নারী বিএসএফ সদস্য আমার ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে হাতড়ে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা করে ফেলেছিলো। হা হা এরপর থেকে বিএসএফ দেখলে আরো বিরক্ত লাগে।


তবে বর্ডার এলাকা পার হবার পর অনেকটা সস্তি লাগে। অটোতে করে স্টেশনে যাবার সময় আশেপাশে তাকালেই মনটা সিগ্ধ হয়ে আসে। রাস্তার দুধার ঘেষে খুবই পুরানো বিশাল মোটা মোটা গাছ, আর এই রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে ফুটফুটে মেয়েরা। বেনী দুলিয়ে শাড়ি অথবা ফ্রক পড়ে সাইকেল চালিয়ে তারা স্কুলে যাচ্ছে। এটাই তো স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মেয়েরা এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। কিশোর বয়সে নিজের সাইকেল চেপে স্কুলে যাওয়া ছাড়াও হঠাত হঠাত বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যাওয়ার যে আনন্দ, বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়ে সেই স্বর্গ সুখ থেকে বঞ্চিত।


আরেকটু এগোলেই চোখে পড়ে বয়স্ক মহিলারা পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন দিকে চলেছে। আসলে এইসব এলাকার নিজস্ব যানবাহন বলতে শুধু সাইকেল। নারী-পুরুষ সবাই সাইকেল চালায়।


স্টেশনে গেলে দেখা যায় অনেকগুলো টিকিট কাউন্টারে নারী টিকিট বিক্রেতা। আবার টিকিট কাটার জন্য দাঁড়ানো যাত্রীদের মধ্যে নারী-পুরুষ প্রায় সমান। স্টেশন জুড়ে যাত্রীদের জন্য আছে খুবই সুব্যাবস্থা। অনেকগুলি করে পানির কল। আমি একটা জিনিস দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। ইন্ডিয়ান হিন্দুদের ধারণা জল শব্দটা বাংলা, শুধুমাত্র বাঙ্গালীরাই জল শব্দটা ব্যাবহার করে। কিন্তু বাংলাদেশের লোকেরা যেহেতু তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক পুরোপুরি বাঙালি না, নিম্নশ্রেণির বাঙ্গাল এজন্য তারা পানি শব্দটা ব্যাবহার করে। হা হা । মজার ব্যাপার হচ্ছে ওয়েস্ট-বেঙ্গলের প্রতিটি রেল স্টেশনে খাবার পানির কলের পাশে লেখা রয়েছে,”পানিয় জল”।


ভারতের স্টেশনগুলোতে টয়লেটের খুব ভালো সুবিধা রয়েছে। নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যাবস্থা। টয়লেট নিয়ে ওখানে নারীদের কম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। প্রতিটি লোকাল স্টেশনের সব প্ল্যাটফর্মেই কিছুদুর পরপর টয়লেট। সেখানে প্রস্রাবের জন্য কোন খরচ নেই, কিন্তু বড়টার জন্য নামমাত্র মূল্য দিতে হয়।


স্বল্পপাল্লার দুরত্বে যাবার জন্য রয়েছে লোকাল ট্রেন। আর এই স্বল্প পাল্লা ১২০ কিঃমিঃ অবধি। নারী-পুরুষ উভয় যাত্রীই ভোরে ট্রেনে চেপে ১০০ কিঃমিঃ দুরের শহরে গিয়ে অফিস করে আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরত চলে আসে। রেল ভাড়াও খুব কম। এইসব লোকাল ট্রেনে নারী যাত্রীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। প্রতিটি ট্রেনের বগিগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা সীট সংরক্ষিত আছে, এছাড়া প্রতিটি ট্রেনের নির্দিষ্ট কিছু বগি পুরোটাই নারীদের জন্য। এছাড়া কয়েকটি রুটে কয়েকটি ট্রেন পরপর একটি করে ট্রেন পুরোটাই নারীদের জন্য। আর এইসব নারী রাজ্যে যদি কোন পুরুষ ভুল করেও ঢুকে পড়ে তাহলে তার কপালে বিরাট খারাপি আছে। কারণ অধিকাংশ সময় দেখা যায় ইয়া গবদা গবদা নারী পুলিশ সদস্য এইসব পুরুষদের আচ্ছা মতো সাইজ করতেছে। হা হা হা ।


লোকাল ট্রেনে নারীদের অনেক মজার কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে এরা যখন ঝগড়া বাধায় তখন তা সত্যিকারের দর্শনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। হা হা। আবার অন্যরকম বিষয়ও দেখা যায়। রাশ আওয়ারে যখন পা ফেলার জায়গা থাকে না তখন দেখা যায় কোন মহিলা বসে থাকা অপরিচিত কোন পুরুষের থাইয়ের উপর বসে পড়ে। হা হা। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। অবশ্য এটা আমি একবারই দেখেছি। সবসময়ই এরকম হয় কিনা আমি জানি না।


শহরের সিটি বাসগুলোতে নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যাবস্থা। অবশ্য এটা নারীদের জন্য না বলে বলা যেতে পারে প্রতিটি বাসে পুরুষদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত আছে। হা হা। বাসের দুসারি সিটের বামসারির সবগুলো সীট নারীদের জন্য বরাদ্দ। ডানপাশের সিটের একটা অংশ সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য, কিছু প্রতিবন্দিদের জন্য আর পিছনের অল্প কয়েকটা সীট পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত। বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীরা এরকম যাতায়ত সুবিধা পেলেই কতোই না খুশি হতেন।


একবার কলকাতার মেট্রো রেলে করে এসপ্ল্যানেড থেকে কালীঘাট যাচ্ছি, এসময় ট্রেনের দেখি ভিতরে দেখি এক তরুণী একজন মধ্যবয়সী স্মার্ট পুরুষকে ঠাস করে থাপ্পর দিয়ে জোর গলায় শাসাতে লাগলো। পুরুষটি মিউ মিউ করে আত্নপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করছে। আসলে হয়েছিলো কি, লোকটা ভীড়ের মধ্যে মেয়েটার শরীরে হাত দিয়েছিল। আর মেয়েটা সেটা বুঝতে পেরেই জোর আকারে প্রতিবাদ চালাচ্ছে। ইন্ডিয়ান ট্রেনগুলোতে প্রচন্ড ভীড় হয়। মেয়েরা সেই ভীড়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকে। তারা হয়তো বুঝতে পারে ভীড়ের মধ্যে কোন পুরুষের হাত ইচ্ছাকৃত। এপ্রসঙ্গে একটা বিষয় মনে পড়ে গেল, আমার বড়মামী ঢাকার একটা পত্রিকা অফিসে চাকরি করতেন। বাসায় আসতে আসতে তার রাত ১১টা বেজে যেত। তিনি সবসময় বলতেন যে অল্পবয়সী ছেলে বা তরুণেরা কখনো রাস্তা বা বাসে বিরক্ত করতো না। কিন্তু যন্ত্রণা করে মধ্যবয়সী ভদ্রবেশী পুরুষেরা। তো মামী তো শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।


ভারতীয় মেয়েদের আমার কাছে অনেক সাহসী মনে হয়েছে। এবং তাদের মধ্যে ন্যাকামো ব্যাপারটা কম। তারা একা একা দেড়-দুহাজার কিঃমিঃ জার্নি করে। মধ্যবয়সী নারী থেকে শুরু করে টিনএজ মেয়েরা পর্যন্ত। একবার দিল্লী থেকে কলকাতায় আসছি ট্রেনের স্লীপার ক্লাসে করে। দেখি মধ্যপথে একটা অল্পবয়সী মেয়ে উঠলো। তার কোন সীট নাই। সে দিব্যি অপরিচিত একজনের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘন্টাখানিক ঘুমালো। তারপর ঘুম থেকে উঠে টিফিনবাটি থেকে খাবার বের করে খেয়ে-দেয়ে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। তারপর আরো ঘন্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নিয়ে উঠে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে একটা স্টেশনে নেমে পড়লো।


আরেকবার ট্রেনে স্লীপার কাসে চড়েছি, আমার সামনে সীট পড়েছে সদ্য বিবাহিত অল্পবয়স্ক এক দম্পতির। স্বামীটি গুজরাটের আর স্ত্রীটি ঝাড়খন্ডের। ছুটিতে তারা ঝাড়খন্ড যাচ্ছে। সারাটাদিন ধরে তাদের মান-অভিমান আর খুনসুটি দেখলাম। তারপর যখন রাত এলো স্ত্রীটি এলো আমার পাশের বার্থে শুতে। তারপর কি হলো, আচ্ছা থাক!! পরে অন্য কোন এক সময় এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।


সিমলা শহরতা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। শহরটার দেখতেও যেমন সুন্দর তেমন আইন-শৃঙ্খলা ভালো। মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবনতা খুব বেশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই শহরের পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশ হচ্ছে নারী, এমনকি ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত। আমি কয়েকবার এই নারী পুলিশ সদস্যদের কাছে ঘুরঘুর করেছি। আসলেই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মুগ্ধ হতে হয়। কামনা-বাসনা থেকে বলছি না, একটা ভালো গল্প পড়লে যেমন ভালো লাগে ঠিক সেইরকম একটা মুগ্ধতা।
সিমলা শহরে স্কুলগামী মেয়েদের ইউনিফর্ম হচ্ছে শর্ট ফ্রক। মানে তাদের ফ্রকের শেষাংশ হাঁটুর উপর-নীচেই ঘোরাফিরা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে পথচলতি কোন লোক মেয়েদের দিকে বিশেষ ভঙ্গিতে তাকায় না। আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, একগাদা জামাকাপড় পড়ার পরও ঠান্ডায় আমার প্রায় হি হি অবস্থা। আর এই মেয়েগুলোর কি এতোটুকু শীত লাগছে না!!!


কিলং নামের ছোট্ট একটা শহরে আমি একরাত ছিলাম। শহর না বলে তাকে জনপদ বলাই শ্রেয়। হিমালয়ের বুকের মধ্যে ছোট্ট একটা লোকালয়। সেখানে আমি দেখেছি নারী-পুরুষেরা সবাই কি সুন্দর মিলে মিশে কাজ করছে। জায়গাটা অনেকটা বান্দরবানের থানছির মতো। এই এলাকাগুলোতে দেখেছি নারি-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই একসাথে সমানতালে কাজ করে চলেছে। অনেকটা আমাদের দেশের আদিবাসীদের মতো। অবশ্য ইন্ডিয়ার যে জায়গাগুলোতে আমি ঘুরেছি সবজায়গাতেই আমার মনে হয়েছে মেয়েরা অনেক সাবলম্বী। বড় বড় শহরগুলোতে মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধ করে কাজ করছে আর ছোট শান্ত স্নিগ্ধ অঞ্চলগুলোতে মেয়েরা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করছে।


কিলং থেকে লেহ যাবার পথে কয়েকটা অস্থায়ী লোকালয় চোখে পড়ে। এই লোকালয়গুলী গড়ে ওঠে ট্যুরিস্টদের কথা মাথায় রেখে। তারা ট্যুরিস্টদের কাছে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। দেখা যায় যে এইসব দোকানদারদের অধিকাংশই হচ্ছে মহিলা।


কাশ্মীরে যখন আমি যাই তখন সেখানকার লোকেরা আমাকে বলেছিলো যে তাদের রাজ্যে নাকি রেপ হয় না। এই কথাটা আমি কাশ্মীরের কয়েক জায়গাতেই শুনেছি। কেমন যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তাইনা! হয়তো কথাটা সত্যি। কাশ্মীরের মুসলমানেরা খুবই ধর্মপ্রাণ। মেয়েরা খুবই সুন্দরভাবে তাদের পোশাক-আশাক পড়ে থাকে। ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় এটা বেশ আলাদা ভাবেই চোখে পড়ে। একটা মজার বিষয় মনে পড়ে গেল। বনগা রেল স্টেশন থেকে বেনাপোল বর্ডার পর্যন্ত অটোর পাশাপাশি ভ্যানও চলে। আমি একবার অটোতে করে যাচ্ছি, দেখি ভ্যানে করে একদল যাত্রী যাচ্ছে। তারমধ্যে এক মহিলার ব্লাউজের কাট এতোই বিশাল যে তার আর আলাদাকরে অন্তর্বাস পড়ার দরকার পড়েনি। তবে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মহিলাটি যদি আড়ামোড়া ছাড়ে তবে তার সুক্ষ বাঁধনের ব্লাউজ পটাস করে ছিড়ে যাবে। যদিও ব্যাপারটা দেখতে আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম।


কাশ্মীরের মেয়েদের আমি সেভাবে বোরখা পড়তে দেখিনি। তারা সালোয়ার কামিজ পড়ে, এবং তাদের সালোয়ার কামিজ পড়ার ধরনটি খুব সুন্দর। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের মধ্যে কোন জড়তা নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তারা খুব অবলীলায় চলাফেরা করছে, খুব স্বাভাবিকভবে তারা অপরিচিত পুরুষদের গা ঘেষে দাড়াচ্ছে এবং কোন পুরুষ ভীড়ের মধ্যে সুযোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করছে না। বাসে ওঠার সময় কোন হেলপার কোন নারী যাত্রীর পিঠে হাত দিচ্ছে না।


তবে শ্রীনগরে আমি একটা এডাল্ট রোড খুঁজে পেয়েছিলাম। একটা সুদৃশ্য নির্জন ছায়া ঢাকা পাহাড়ি পথ যেখানে একগাদা বিলাসবহুল প্রাইভেট কার সারি সারি পার্ক করা আছে। আমি যখন সেগুলোর পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি তখন গাড়িগুলো হঠাত হুড়মুড় করে নড়ে উঠে জোরে চলা শুরু করলো। প্রথমে আমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারিনি। কিছুক্ষন পর যখন বুঝেছিলাম তখন হো হো করে হেঁসে উঠেছিলাম।


একবার আগ্রা থেকে বাসে করে ফতেপুর সিক্রি যাচ্ছি। হঠাত দেখি বোরকা পড়া একটা মেয়ে ১০০ সিসির মোটরসাইকেল চালিয়ে আমার বাসের পাশ দিয়ে জোরছে বের হয়ে গেল। দৃশ্যটা দেখে এতো ভাল লেগেছিলো। ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেই দেখা যায় মেয়েরা স্কুটি চালাচ্ছে। তবে একটি মুসলমান মেয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে পুরুষদের দক্ষতায় এটা দেখতেই ভালো লাগে।


দিল্লীর মেয়েরা খুবই সুন্দর, স্মার্ট এবং চৌকশ। দিল্লীতে ইন্ডিয়া গেটের কাছে বিকালে গেলে দেখা যায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাদের বৈকালিক সময়টা সেখানে উপভোগ করছে।
দিল্লীতে মেট্রোতে চড়ার সময় একটা কান্ড দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। মেট্রোতে সাধারণত খুবই ভীড় থাকে। একটা রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আমার সামনের মেয়েটা হঠাত একটা কাজ করলো। মেয়েটা বেশ মোটাসোটা বলা যায়। দিল্লীর মেয়েরা সাধারণত ওড়না পড়ে না। এই মেয়েটা হুট করে তার জামার ভিতরে ডান হাত ঢুকিয়ে দিলো। তারপর তার অন্তর্বাসের ভিতর দিয়ে বাম স্তন নেড়েচেড়ে ঠিক করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি খুব অবাক হয়েছিলাম এ কারণে যে একটা মেয়ে পাবলিক প্লেসে তার প্রাইভেট প্রপার্টি ঠিকঠাক করছে, অথচ কাছে এতো পুরুষ রয়েছে তারা কেউ চোখ তুলে হা করে ব্যাপারটা দেখছে না। হয়তো এরকম ব্যাপার স্বাভাবিক দিল্লীবাসীর কাছে। আসলে এরকমই তো হওয়া উচিৎ। একটা মেয়ের বিভিন্ন কারণে সমস্যা হতে পারে, কিন্তু তাই বলে অন্যরা কেন সেই সুযোগটা নেবার চেষ্টা করবে।


আমাদের দেশে পুরুষেরা মেয়েদের দিকে যেমন পশুর চোখে তাকায়, ভারতে সাধারণত সেরকম তাকায় না। অথচ ওখানে মেয়েরা অনেক খোলামেলা পোষাক-আশাক পড়ে। কারো কারো ভঙ্গি তো শিষ্ঠাচার বহির্ভূত। কিন্তু ওখানে ছেলে মেয়ে একে অপরের দিকে তাকায় প্রতযোগিতার মনোভাব নিয়ে । তারা মনে করে এই ছেলেকে বা এই মেয়েকে একটু পিছনে ফেলতে পারলে আমি আরেকটু এগিয়ে যাবো। তার পুরোপুরি প্রফেশনাল ভঙ্গিতে চলাফেরা করে।


কলকাতায় নাইট ক্লাব নামে একটা ব্যাপার আছে। দিল্লিতে সেটার প্রকোপ আর বেশী। আমার এবারের ভারত ভ্রমণে দুজন বাংলাদেশী রাজপুত্রের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সিমলা পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম। তারপর আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। আবার দেখা হয়েছিলো কলকাতাতে এসে। তো আমার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো এই রাজপুত্রদ্বয়ের সাথে এক নাইট ক্লাবে ঢোকার। ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার খুবই কৌতূহল ছিলো। আমি শুধুই দেখতে চেয়েছিলাম। দরজা খুলে যখন ভিতরে ঢুকি তখন হিন্দী গানের প্রচন্ড ধাক্কায় আমার কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়।

ভিতরে দেখি একটা মঞ্চ যেখানে সারিবদ্ধ ভাবে সাত-আটটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পোশাক আশাক সেই পর্যায়ের। একেবারেই অশ্লীল না কিন্তু প্রচন্ডভাবে আবেদনময়ী। শাড়ী পড়ার ধরণও যে ওরকম হতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। ভয়ঙ্করভাবে মোহনীয়। আর মেয়েগুলো এতোই সুন্দরী যে তাদের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যাচ্ছে না, চোখ ঝলসে যাচ্ছে। মেয়েগুলোর সামনে রাখা ব্যাগ, যে ব্যাগভর্তি শুধুই টাকা। বিভিন্ন মাতাল পুরুষেরা মঞ্চের নীচে দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোর শরীর স্পর্শ না করে বিভিন্ন পছন্দের মেয়েকে ইশারা দিয়ে ডাকছে, তারপর দুজনে নির্দিষ্ট দূরত্ত্ব বজায় রেখে নাচানাচি করছে। নাচ শেষে মেয়েগুলোর হাতে এক তোরা টাকা তুলে দিচ্ছে। মেয়েরা তখন সামনে একটা ছেলের হাতে টাকাগুলো তুলে দিচ্ছে , আর সেই ছেলেটা মেয়েগুলোর সামনে রাখা ব্যাগে টাকা ভরে রাখছে। হঠাত এই ঘরের একটা দরজা খুলে যাওয়ায় দেখি পাশে এরকম আরো কতোগুলি ঘর আছে।


প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছিলো। এতো সুন্দরী মেয়েগুলো এতো সস্তা হবে কেন? সারাজীবন শুনে এসেছি সৌন্দর্য আরাধ্যের বিষয়। বহু উপাসনা, ত্যাগ-তীতীক্ষার পর তার মালিক হওয়া যায়। অথচ এখানে কি অবলীলায় তা পাওয়া যচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠেছিলো। সঙ্গী রাজপুত্র দুজনকে ফেলে রেখে সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। বমি ঠেকানোর জন্য একটা পানের দোকান থেকে একগাদা সুপুরি চেয়ে নিয়েছিলাম। শরীর একেবারে ঘিনঘিন করছিলো। নিজেকে কেমন যেন নোংরা মনে হচ্ছিলো। বাধ্য হয়েছিলাম হোটেলে ফিরে এসে গোসল করতে।


লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আজ থাক। শেষ করতে চাই আমার দেখা প্রিয় একটা দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে। ঘটনাটি কাশ্মীরের এক মসজিদের। পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্রতম স্থান একটা মসজিদের প্রাঙ্গনে আট-নয় বছরের ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড় ঝাপ দিয়ে খেলা করছে, একটু পাশেই তার মা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে কন্যার দৌড় ঝাপ দেখছে। সময়টা গোধুলী, সূর্যের শেষ লালচে আলোটুকু মাতা-কন্যা দুজনের শরীরে পরশ বুলিয়ে কাশ্মিরি এই পরিবারটাকে আরো রঙিন করে তুলেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলাম। ওদের ওখানে নারীরা খুব সহজেই মসজিদে যেতে পারে।


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ১২:৩৩
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×