somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তর ভারতের হিমালয় (পর্ব - ১, আধিক্য যশোর রোড)

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সবগুলো পর্ব
সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দির প্রায় মধ্যভাগ। সবেমাত্র রাত্রি দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হইয়াছে এইরকম মুহূর্তে একখানা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া কালীগঞ্জের রানীমা যশোধাদেবীর নিদ্রাভঙ্গ হইলো। অস্থির অবস্থায় তিনি দ্বিতলের কক্ষ ছাড়িয়া সংলগ্ন ঝুল বারান্দায় আসিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খাস দাসী কমলা ছুটিয়া আসিলো, হাতের ইশারায় তিনি তাকে ভাগাইয়া দিলেন। ভীত কমলা পুরোপুরি চলিয়া না গিয়া একখানা দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া রানীমাকে অবলোকন করিতে লাগিলো, পূর্বে রাণিমাকে এইরুপে সে আর কখনো দেখে নাই। পূর্ণচন্দ্রের আলোতে চারিপাশ ঝকঝক করিতেছিলো আর মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসে রানীমার ধবধবে সাদা থানের আঁচল বাতাসে দুলিতেছিলো। রানীমা যেন কোন কিছুই দেখিতেছেন না। মেঝেতে বিছানো একখানা শীতল পাটিতে তিনি মূর্তিবৎ বসিয়া রহিলেন। যখন শুকতারাকে ম্লান করিয়া সূর্যদেব তাঁর রথ পূব আকাশে চালনা করিলো তখন বুঝি রানীমার ধ্যানভঙ্গ হইলো। নিজেকে তিনি কিছুটা সামলাইয়া লইলেন।


বেলা দশটার দিকে খবর পাইয়া পুত্র কালি পোদ্দার তাঁর মায়ের কাছে ছুটিয়া আসিলো। এতদঞ্চলে মাতৃভক্তিতে সে প্রবাদপ্রতিম। রাত্রি জাগরণের ফলে মায়ের ক্লান্তিময় মুখচ্ছবি তাহার অন্তরকে আন্দোলিত করিয়া তুলিলো। ভগ্নকন্ঠে সে জিজ্ঞাসা করিলো,’মা, কি হয়েছে?’ উত্তরে রানীমা যাহা কহিলেন তার সারমর্ম হইতেছে এইরুপ, একখানা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া তাঁর মনটা বিক্ষিপ্ত হইয়াছে আর এই কারনে তিনি গঙ্গাতীর্থে যাইতে মনস্থির করিয়াছেন।


মা যশোধা দেবীর ইচ্ছা পুত্র কালী পোদ্দারের কাছে আদেশ স্বরূপ ছিলো। ঊনিশ শতকের সেই সময়ে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিলো জলপথ। কিন্তু জমিদার কালী পোদ্দার তাঁর মাকে জলপথে তীর্থস্থানে পাঠাতে রাজী ছিলেন না। এজন্য তিনি মায়ের কাছে কয়েকটা বছর সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। জলপথ ছাড়া আর একটাই মাত্র উপায় ছিলো তীর্থে যাবার, মধ্যযুগে মোঘল সম্রাট বাবরের বীর সেনানী শের শাহ’র করে যাওয়া অমর কীর্তি, ‘গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড’।


কালী পোদ্দার তাঁর মায়ের তীর্থে যাওয়ার জন্য এই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডটিকেই নূতন ভাবে সংস্কার করলেন। সমস্ত খরচ তাঁর জমদারী থেকে বহন করা হলো। নূতন করে রাস্তা তৈরী হলো। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। কিন্তু এতো রোদ্দুরে এই রাস্তা ধরে গেলে মায়ের কষ্ট হতে পারে, এই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন কালী বাবু। শেষে তিনি কালীগঞ্জ থেকে কলকাতা পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার রাস্তার দুধার দিয়ে রোপন করলেন অতি দ্রুত বর্ধনশীল হাজার হাজার রেইনট্রি গাছ।


এক শুভদিনে রানীমা যশোধা দেবী তাঁর পুত্র জমিদার কালী পোদ্দারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় গঙ্গাস্নান করতে বের হলেন। গাছগুলো ততোদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে। নূতন হওয়া এই রাস্তাটার নূতন নামকরণও করা হয়েছে, যশোর রোড।


ঘটনা এখানেই শেষ হলে পারতো, কিন্তু কিভাবে যেন হলো না। তীর্থস্থান গঙ্গা দিয়ে ততোদিনে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। রানীমা যশোধা দেবী আর তাঁর জমিদার পুত্র কালী পোদ্দার একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। যশোর রোডের দুধারের গাছগুলো বিস্তৃত ডালপালা মেলে আরো বিকশিত হয়ে উঠলো, বহু পথিক এর ছায়ায় বসে প্রান জুড়ায়। কেউ যশোধা আর মাতৃভক্ত পুত্র কালীর কথা মনে রেখেছে কিনা কে জানে! যশোর রোডটাও তো একসময় ভাগাভাগি হয়ে গেল। একভাগ পড়লো পূর্ব পাকিস্তানে আর অন্য অংশটা ভারতে। আর তারপর ১৯৭১ সালে গাছগুলোর বয়স যখন ১২৯ বছর তখন পৃথিবীর ছোট্ট একটা অংশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ গনহত্যাগুলোর একটা শুরু হলো।


একপাশে শ্বেতশুভ্র বিশাল হিমালয় আর অন্যপাশে সুনীল জলরাশির বঙ্গোপসাগর। মাঝখানে পলিমাটি দিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ভূমি। এখানে নাকি মাটিতে বীজ পড়লেই ফসল হয়ে ওঠে, এখানে নাকি পাখিরা গাছে বসে হাজার রকমের গান গায়, এখানকার জলাশয়ে নাকি শয়ে শয়ে রঙিন ফুল ফোটে, এটি নাকি কবিদের দেশ, চিরকালীন প্রেমের দেশ, এখানকার মানুষেরা কৃষ্ণচক্ষু, তাদের হাসিতে নাকি জাদু আছে, এখানকার মেয়েদের বাহু নাকি রাজহংসীর গলার মতন, সেইসব হাতের ভঙ্গিমা দেখে সাপেরাও মোহিত হয়ে যায়, এখানে নৃত্যরতা নারীরা, অপূর্ব ছন্দ যেন...... সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাঁসেরা নাকি এখানে আসে সাঁতার কাটতে......


সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাঁসেরা যেখানে সাঁতার কাটতে আসে সেইখানকার বাসিন্দারা একসময় নিজেদের প্রাণ বাচানোর তাগিদে ভিনদেশে ছুটে পালানো শুরু করলো। পাকিস্তানি হিংস্র দানবেরা তাদেরকে তাড়া করেছে। অসহায় মানুষগুলো শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যখন ছুটে চলা শুরু করলো, তখন যে কয়টি পথ তাদের চেনা ছিলো তার মধ্যে একটি ছিলো এই যশোর রোড। একসময় যশোধা আর কালী যে পথ দিয়ে তীর্থে গিয়েছে সেই পথ দিয়ে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে চললো। কোথায়? কলকাতায়। ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের পর যে পথটা কানা গলি হয়ে পড়েছিলো সেটাই আবার সরগরম হয়ে উঠলো জীবন বাচাতে একরাশ ছুটে চলা মানুষের পায়ের ধূলায়।


কতো মানুষ হেঁটে গেছে এই পথ দিয়ে। শুধু হেঁটে গেছে তাই বা বলি কিভাবে! ৯০ উর্ধ্ব বুড়ো-বুড়িরা তো গড়িয়ে গড়িয়ে গেছে এই পথ দিয়ে। আচ্ছা, পোয়াতি নারীরা নাকি দল বেঁধে যেত? হুম, তাদের গতি ছিলো খুবই মন্থর। আচ্ছা, সদ্য বিয়ানো সন্তানকে নিয়ে নাকি মা হেঁটে গিয়েছে? হুম, মায়ের জরায়ুর সাথে শিশুটির নাভির তখনো নাড়ির সংযোগ ছিলো। সেই অবস্থায় তাকে বুকে জড়িয়ে মা নিজেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেছে এই যশোর রোড দিয়ে। আচ্ছা, দেশ স্বাধীনের পর নাকি কোন শিশু আর কোন বুড়ো-বুড়ি নাকি ফেরত আসেনি এই পথ দিয়ে? আসবে কোথা থেকে!! তারা বেঁচে থাকলে তো আসবে! আচ্ছা, এই ঘটনার সাক্ষী ছিলো কেউ? ছিলো তো! পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ ছুটে এসেছিলো এই ঘটনার সাক্ষী হতে। সেপ্টেম্বরের একটা দিনে এসেছিলেন প্রথাবিরোধী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, তাঁর পথ প্রদর্শক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।


অ্যালেন এই বর্বরতার শুধু সাক্ষীই হননি, মানুষের আদালতে জোরালো গলায় তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। রচিত হয়েছিলো মানব ইতিহাসের সবচাইতে করুণতম কবিতাটি, সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।


আচ্ছা, পথ জুড়ে শুধুই কি হাহাকারের স্মৃতি? কই নাতো! বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তো এই পথ দিয়েই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বাধীন দেশে। ভাষন দিয়েছিলেন তাঁর মুক্তাঞ্চলে। সেই স্মৃতি তো ভালোবাসার স্বপ্নমাখা, সেই স্মৃতি তো গৌরবের! আচ্ছা, সেই যশোর রোডটা কি এখনো আছে? সেই গাছগুলো? সবগুলো গাছ তো নেই বাপু! কিছু রাক্ষসেরা অনেকগুলো গাছ গিলে খেয়ে ফেলেছে। আর বাকী যেগুলো রয়েছে সেগুলোকে নিয়ে নাকি লুই আই কানের তৈরী আধুনিক পৃথিবীর সবচাইতে সেরা ভবনগুলির একটিতে বাদানুবাদ হয়। কি জানি! সেগুলোও রাক্ষসের পেটে যায় কিনা! আর যশোর রোড! সেটারও তো নাম বদলেছে। সেটা তো এখন বেনাপোল মহাসড়ক!




আগের পর্ব

২০১৬ সালের ১ অক্টোবর বেনাপোল মহাসড়ক দিয়ে ছুটে চলেছি। বাড়ি থেকে বের হয়েছি সকাল আটটার দিকে। কোন ট্যুরে গেলে আমি সবসময়ই দুরাকাত নফল নামায পড়ে বের হই। আমি দেখেছি এর ফলে অনেক বড় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। একবার ঢাকা থেকে যশোরে আসবার সময় আমি যে বাসে ছিলাম সেটা একসিডেন্ট করেছিলো। বাসের সামনের অংশটুকু পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। আল্লাহর রহমতে সে সময় বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছিলো বলে আগুন খুব বেশি ব্যাপকতা ছড়াতে পারেনি। হুড়োহুড়ি করে সবাই যখন বাস থেকে নামলো দেখা গেল যে আমিই ওই বাসের একমাত্র সুস্থ যাত্রী ছিলাম, যার কিচ্ছু হয়নি। আর একটা কয়েকমাসের বাচ্চা ছিলো যে খুব অল্পের উপর দিয়ে রেহাই পেয়ে গিয়েছে।


সকালের রোদমাখা আবহাওয়াতে মোটরসাইকেলে করে বর্ডারে যাচ্ছি, কিছুটা শীত শীত লাগছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার জ্বর এসেছে এবং কোমরেও ব্যাথ্যা। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে ঔষধ খাওয়া আর কোমরে গরম ছ্যাক দেবার কাজ করতে হয়েছে এবং একয়দিন আমি খুব স্বাভাবিক আচরণ করছি যেন বাবা-মা একেবারেই আমার অসুস্থতার বিষয় টের না পান। ঘুণাক্ষরেও যদি তারা টের পান যে আমি অসুস্থ তাহলে কোনমতেই আর ট্যুরে যেতে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত আমি সফল হয়েছিলাম। তবে সকালে বাড়ি থেকে বের হবার সময় আমি মাত্র ৯ কেজি ওজনের ব্যাগ-প্যাকটা যখন কিছুতেই পিঠে নিতে পারছিলাম না তখনই আমার মা সবকিছু বুঝে ফেলেছিলেন, কিন্তু আমার মুখের দিকে চেয়ে তিনি আর ট্যুরটাতে বাঁধা দেননি। শেষ পর্যন্ত তিনিই ব্যাগটা কাঁধে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর মুখটা চিন্তিত দেখেছিলাম আমি সেসময়।




আমার বাবা তাঁর মোটরবাইকে করে আমাকে বেনাপোল পর্যন্ত দিতে চলেছেন। আমাদের বাড়ি থেকে বেনাপোল বর্ডার মাত্র ৩৮ কিলোমিটার। রাস্তাটা গতো বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। মসৃণ পথ, দুপাশে মোটা মোটা গাছ আর বিস্তৃত ধানক্ষেত। আবহাওয়া খুবই চমৎকার। মিষ্টি রোদ আর ছায়া মিলে চমৎকার পরিবেশ।










মাঝে মাঝে ফুলের ক্ষেত দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের ফুলের চাহিদার ৭০ ভাগ যোগান দেয় যশোর। গদখালীকে ফুলের রাজধানী বলা হয়। ফুল নিয়ে এখানে এলাহী কর্মকান্ড চলে। সকাল বেলা এতো গোছা গোছা বিভিন্ন রূপ আর রঙের তাজা ফুল দেখা যে কি আনন্দের তা নিজের চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।


বেনাপোল রোডের সমান্তরাল ভাবে রেলপথ চলে গেছে। এই রেলপথটি কলকাতার সাথে সংযুক্ত। ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে পাশাপাশি তৈরী হলো দুটো শত্রু দেশ। একে-অপরকে সহ্য করতে না পারলেও দেশ দুটি নিজেদের স্বার্থে একে-অপরের রেলপথ ব্যাবহার করতো। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত খুলনা থেকে ট্রেনে রাজশাহী যেতে হলে যশোর-বেনাপোল হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে হতো। তারপর বনগাঁ দিয়ে রানাঘাট হয়ে দর্শনা ষ্টেশনের মাধ্যমে আবার দেশের ভিতরে ঢুকতো। অনুরূপভাবে কলকাতার লোকেরা দার্জিলিং যেতে চাইলে কলকাতা থেকে দর্শনা ষ্টেশনের মাধ্যমে এপাশের দেশে প্রবেশ করতো।





কিন্তু ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দেশদুটি অন্যদেশের রেলপথ ব্যাবহার করে যাতায়ত বন্ধ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে কলকাতার লোকেরা দার্জিলিং যেতে চাইলে প্রথমে কলকাতা থেকে ব্রডগেজ লাইনে চেপে ফারাক্কা পর্যন্ত যেত। সেখানে স্টীমারে করে নদী পার হয়ে ওপাশ থেকে মিটার গেজের লাইনে উঠে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যেত। তারপর সেখান থেকে ন্যারো গেজের ট্রেনে উঠে পৌঁছে যেত ব্রিটিশ সাহেবদের অবকাশকালীন শৈল শহর দার্জিলিং-এ।


আর রেলপথ না থাকার কারণে তো খুলনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধই হয়ে গেল। পরে অবশ্য যশোর স্টেশন থেকে দর্শনা পর্যন্ত নূতন রেললাইন তৈরী করা হয়েছিলো। দর্শনাতে নূতন একটি স্টেশন তৈরী করতে হলো, নাম দেয়া হলো দর্শনা হল্ট। মজার ব্যাপার হচ্ছে দর্শনা হল্ট স্টেশনে একটাই মাত্র রেল লাইন। অর্থাৎ এই স্টেশনে একবারে মাত্র একটাই ট্রেন দাঁড়াতে পারবে। এই নূতন রেলপথটি তৈরী হবার পর আবার খুলনা-রাজশাহী রুটে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ ব্যাবস্থা চালু হলো।


১৯৬৫ সালের পর যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এখন এই রুটে মাঝে মাঝে মালবাহী ট্রেন যাতায়ত করে। আর যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন দিনে দুবার যাওয়া-আসা করে। শুনেছি খুব শীঘ্রই নাকি খুলনা থেকে যশোর বেনাপোল হয়ে কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল আবার শুরু হবে।





একসময় কপোতাক্ষ পার হলাম।পৃথিবীর একটি বিখ্যাত নদ এটি। এই নদটার জন্য একসময় মাইকেল সুদূর ফ্রান্সে বসেও উতলা হয়েছিলেন।







বেনাপোল শহরে প্রবেশ মুখে দেখলাম খুব সুন্দর করে নগর তোরণ তৈরী হচ্ছে। শহরের প্রবেশ মুখ থেকে বর্ডার পর্যন্ত রাস্তা এবং এর দুপাশ আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম এই ছোট্ট শহরটার উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধির ঘোষনা দিচ্ছে।





মোটরবাইকে করে একেবারে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত চলে এলাম।





আমার বাবার পরিচিত কিছু লোক আছে এখানে। তাদেরই একজন আমার পাসপোর্ট নিয়ে গেল ট্রাভেল ট্যাক্স জমা আর ইমিগ্রেশনের সিল দেবার জন্য। আমি শুধু আমার ব্যাগটা নিয়ে তাঁর পিছু পিছু কাস্টমস পার হলাম। সবমলে এক মিনিটও লাগলো না। তারপর আন্তর্জাতিক গেটটাতে পুলিশ আমার পাসপোর্ট দেখে জিরো পয়েন্টে যাবার অনুমতি দিলো। বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী তখন সকাল সাড়ে নয়টা অর্থাৎ ইন্ডিয়ান সময় অনুযায়ী সেটা নয়টা।





জিরো পয়েন্টের এই জায়গাটা অন্যরকম। দুপাশে দুটি দেশ, মাঝখানের একচিলতে জায়গাটা কারো না। একপাশে বেশ উঁচু করে গাল্যারি তৈরী করা হয়েছে। ভোর আর সন্ধ্যায় দুদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন আর নামানোর সময় এখানে নাকি দুইদেশের সীমান্তবাহিনীর যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। দর্শনার্থীরা যেন বসে সেই মহড়া উপভোগ করতে পারে এজন্য এই গ্যালারী তৈরি হয়েছে।





জিরোপয়েন্টের এই জায়গাতে বিজিবি আর বিএসএফের সদস্যরা টহল দিচ্ছে। এখান থেকে শেষবারের মতো বাংলাদেশ অংশে তাকালাম। আমার বাবা দেখি উদ্বিগ্ন মুখে বাংলাদেশের গেটটাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবারই বাবার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা আমার এই মুহূর্তটাকে বিষন্ন করে তোলে । শেষবারের মতো তাঁর দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ান অংশের গেটের দিকে।এই গেটে এক কর্মকর্তা আমার পাসপোর্ট চেক করলেন আর তারপর ইন্ডিয়ান ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। কাস্টমস অফিসের দিকে এগোলাম, আর আমার সঙ্গী লোকটা সরাসরি ইন্ডিয়ান ভূখণ্ডে ঢুকে গেল।


ইন্ডিয়ান অংশে ঢুকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা সরু একটা পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হয় ইন্ডিয়ান কাস্টমস অফিসের দিকে। আজকে একেবারেই ভীড় নেই। খুবই ফাঁকা পরিবেশ। আমি সবসময়ই দেখেছি যে শনিবারদিন বর্ডারে দুদেশের যাত্রী সংখ্যা একেবারেই কম থাকে।


ইমিগ্রেশন অফিস সবসময়েই আমার স্নায়ুর উপর বাড়তি চাপ ফেলে। আমি জানি এটা কিছুই না, অথচ কেমন যেন মানসিক অস্থিরতায় ভুগি আমি। আর এবারের ব্যাপারটা আরো বেশি অস্বস্তিকর আমার কাছে। কারণ গতবারে বাংলাদেশ কাস্টমস পুরো দেড়টা ঘণ্টা জুড়ে আমাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। অবশ্য সেবার আমার কিছু দোষ আর ভুলত্রুটি ছিলো। আমি কিছু চালাকি করেছিলাম, যার খেসারত দিতে হয়েছিলো আমাকে। বাপরে! সেদিনের কথা ভাবলে এখনো আমার জ্বর চলে আসে। সেই ঘটনার পর আমার মনে হয়েছিলো যে আর জীবনেও দেশের বাইরে যাবো না। কারণ বাইরে যেতে হলেই কাস্টমস পার হতে হবে। কিন্তু হিমালয় আমাকে প্রচণ্ডভাবে টেনেছে। তাঁর আহ্বান আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি। তবে হিমালয়কে ছাপিয়ে এখন বর্ডার পার হবার এই মুহূর্তটাতে গতোবারের হয়রানি হবার ঘটনার কথাই বেশি করে মনে পড়ছে। আর আরো তটস্থ হয়ে উঠছি আমি।


যাই হোক আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে ইন্ডিয়ান কাস্টমসে ঢুকে পড়লাম। একদম ফাঁকা, কোন যাত্রীই নেই। একজন সুদর্শন কাস্টমস আমার ব্যাগ চেক করতে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসা করলো এতো বড় ব্যাগ কেন। বললাম যে শীতের অংশটাতে যাবো এজন্য একগাদা শীতের পোষাক। সে আর তখন আমার ব্যাগটা চেক না করে চোখের ইশারায় অন্য একজন সৈনিকের পিছনে চলে যেতে বললো।


আমি এই সৈনিকটার পিছু পিছু চললাম। সৈনিকটা একটা আলাদা ঘরের এক কোনে আমাকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে আমার পাসপোর্টটা চেক করলো। তারপর আমাকে বললো যে আমার মানিব্যাগটা খুলে দেখাতে। আমি মানিব্যাগ বের করে তাঁর সামনে মেলে ধরা মাত্রই সে আমার মানিব্যাগ থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট ছো মেরে তুলে নিয়ে গটগট করে সেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৫৭
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×