প্রত্যেকটা সরকারের আমলেই দেখা যায় সরকারদলীয় সকল নেতা,বুদ্ধিপ্রতিবন্দীজীবিরা ,পীর মুর্শিদরা একটা বিষয় অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপির গ্রোথ ঊর্ধ্বমুখী! নেতা নেত্রীদেরকে এই জাতীয় হাস্যকর নির্লজ্জ ধাপ্পাবাজি যখন করতে দেখি, ইচ্ছে করে নিজের মাথার চুল নিজেই একটা একটা করে ছিঁড়ি। ওনারা বাংলাদেশের জিডিপির সাথে তুলনা করেন ইউরোপ, আমেরিকার জিডিপির! দেখাতে চান ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভাল অবস্থানে আছে!! ফাইজলামির একটা সীমা পরিসীমা থাকা উচিত।
আচ্ছা ধরেন আমেরিকার জিডিপি আর বাংলাদেশের জিডিপির কথা। আমাদের মাথাপিছু আয় কত? ২০১৪ সালে ছিল প্রায় এগারশ ডলার। আর ইউএসএ এর ? ২০১৪ সালে ইউএসের মাথাপিচু আয় চুয়ান্ন হাজার ছয়শ ২৯ ডলার! আপনারাই বলুন,আপনার দেশের জিডিপির গ্রোথ আর আমেরিকার জিডিপির গ্রোথ কি এক কথা!
বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ অনেকটাই বন্ধ। সরকারের তরফে কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা সন্তোষজনক নয় । চারিদিকে অস্থিরতা। সবার কাছে বিস্ময়, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে কিভাবে! হ্যাঁ, টিকে আছে। কেন? কোন নেতার ঐশ্বরিক গুণাবলীর জোরে? না। বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে কোটি কোটি প্রবাসী শ্রমিকের রক্ত জল করে পাঠানো বৈদেশিক পয়সা, আর লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা দিন রাত পরিশ্রমের বিনিময়ে।
অবাক না হয়ে উপায় থাকে না যখন দেখি, শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করেন, ইউরোপের কয়েকটা দেশের জনসংখ্যাও তার চেয়ে অনেক কম! এই সকল শ্রমিকদের নব্বই ভাগেরও বেশি দাসপ্রথার আমলের দাসদের মত কাজ করতে বাধ্য হন। এই সকল শ্রমিকদের মধ্যে যারা মহিলা; তাদের শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি আরবিয়ান শেখদের যৌনদাসী হিসেবে শরীর বেচেন। তারপর তারা রেমিটান্স পাঠান। সেই রেমিটান্স সচল রাখে এই দেশের লুটপাটতন্ত্র ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে অসহায়, নিরীহ নারীরা কাজ করেন গার্মেন্টসে। পৃথিবীর সবচেয়ে কম বেতনের মজুরে হচ্ছেন তারা। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে করতে নিজের জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন পোশাক শিল্প। আমেরিকা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। কেন করেছে?সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে অবিরাম এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, ডঃ ইউনুসের হস্তক্ষেপেই যুক্তরাষ্ট্র এমন কাজ করেছে। আমার প্রশ্ন হল যদি তাই হবে, তাহলে সরকার কেন ‘রানা প্লাজা’ সিনেমাটাকে প্রদর্শনের অনুমতি দিল না? নানান ছুতো নাতায় কেন বন্ধ করে দেয়া হল ‘রানা প্লাজা’ সিনেমার সম্প্রচার? কারন একটাই। আর তা হোল, গোমর ফাঁস হয়ে যাবার ভয়!হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক জীবন দিল কাজের পরিবেশের দুরবস্থার কারনে, আর দোষ দেয়া হচ্ছে কেষ্ট বেটার ?
যতদিন পর্যন্ত গার্মেন্টসে কাজের সম্মানজনক পরিবেশ সরকার তৈরি করতে না পারবে ততদিন জিএসপি র সুবিধা বন্ধ রাখাকে আমি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত মনে করি।আমার উন্নয়ন দরকার নাই, দরকার শ্রমিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ।
০২
চারদিকে নানান কিসিমের কেলেঙ্কারির পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকা, আর গার্মেন্টসের আয় দিয়ে। প্রবাসে দাস কিংবা যৌনদাসী হিসেবে কাজ করে কারা? কারাই বা গার্মেন্টসে যথোপযুক্ত মজুরি না মেলার পরও কাজ করেন? অশিক্ষিত কিংবা স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীরা। নিশ্চয়ই একজনে উচ্চশিক্ষিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাবেন না- খেজুর গাছ বাইতে অথবা বেশ্যাবৃত্তি করতে! তাই সরকার পরিকল্পিত ভাবে শিক্ষা খাতকে ধ্বংস করার জন্য নেমেছেন।অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা যেন উচ্চ শিক্ষা না নিতে পারেন তার বন্দোবস্ত করাই সরকারের প্রধানতম কাজে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ রোহিত করা, উচ্চ শিক্ষায় ট্যাক্স আরোপের প্রচেষ্টা( যা ইতিমধ্যেই ভেস্তে গেছে),পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অবিরাম প্রচেষ্টা, আর সর্বশেষ প্রশ্ন পত্র ফাঁসের ঘটনাকে অস্বীকার পাওয়া- সবই পুঁজিবাদী সরকারের শিক্ষাকে গরীব মানুষের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার নীল নকশার অংশ বলেই আমি মনে করি।কারন গরীব ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার সুযোগ না পেলে হয় মধ্যপ্রাচ্যে যাবে, নয়ত গার্মেন্টসে ঢুকবে। আর পুঁজিবাদী সরকার সেই অর্থ দিয়ে তার অর্থনীতির চাকা অর্থাৎ লুটপাটের চাকা সচল রাখবেন!
সেটাই যদি না হবে তাহলে,আমার মাথায় একটা জিনিস কাজ করে না, কি করে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে! যেখানে পুরো ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে মন্ত্রীর পদত্যাগ করার কথা সেখানে একের পর এক তিনি অস্বীকার করে যাচ্ছেন ! সরকারদলীয় বুদ্ধিজীবী ডঃ জাফর ইকবালের ইমেইলে পরিক্ষার আগের দিন প্রশ্ন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।পরের দিন তিনি মিলিয়ে দেখেছেন সেই প্রশ্ন হুবহু মিলে গেছে! এরপর এই বিষয়টা নিয়ে ডঃ ইকবাল অনেক চিল্লাচিল্লি করেছিলেন। কিন্তু সরকার কান দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি ডঃ ইকবালের কথায়। উল্টো অস্বীকার করেছে পুরো বিষয়টা। আরে দুইশো টাকায় নীলক্ষেত, আজিমপুর চায়না বিল্ডিং গলিতে প্রশ্ন কিনতে পাওয়া যায় এ কথা আমার ছাত্র আমার নিজের কাছে বলেছে। কিনে এনে দেখিয়েছে। আমি পরে মিলিয়ে দেখেছি।আর মাগনায় পাওয়া গেছে ফেইসবুকে! এক কালের বামজীবী নুরুল ইসলাম নাহিদ এই ‘ওপেন সিক্রেট’ নৈরাজ্যকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন; আরও খোলাসা করে বললে একের পর এক পরিহাস করেছেন। তার সম্পর্কে বেশি কিছু বলার নেই। শুনেছি পয়সার ব্যাপারে তিনি এখনো ১০০ ভাগ সৎ লোক। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে আমরা যারা প্রশ্নফাঁসের বিষয়টা সরেজমিনে দেখলাম তাদের শ্রদ্ধা সম্ভবত তিনি আর কোন কালেই পাবেন না! গত সরকারের হাজারও অপকর্মের ভিড়েও এহসানুল হক মিলনকে আজও অনেকে মনে করে তাঁর নকল বিরোধী ভুমিকার জন্য। আমি দুঃখিত, কারন আমাকে এ কথা বলতে হচ্ছে; নুরুল ইসলাম নাহিদ ব্যক্তিগত ভাবে টাকা পয়সার ব্যাপারে যতই সৎ হন না কেন, তার কথা মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে করবে গভীর অশ্রদ্ধা নিয়ে।
প্রশ্ন ফাঁসের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটলো মেডিকেলের ভর্তি পরিক্ষায়। একটা জিনিস দুঃখের সাথে খেয়াল করলাম, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় চারদিকে সবাই চিন্তিত(!) কারন তাদের ভবিষ্যৎ চিকিৎসার হাল কি হবে তা ভেবে! একেই বলে বাংলাদেশী চরিত্র! কিছু নিষ্পাপ ছেলেমেয়ের পড়ার অধিকার কেড়ে নিল দুর্বৃত্তরা,ধুলিস্মাত করে দিল কিছু সন্ত্রাসীরা- সে কথা না বলে নিজেদের চিকিৎসা নিয়ে ‘সচেতন নাগরিক’রা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন!
মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্যই হয়নি; লুটপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকার । সরকার যদি পুনরায় ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা না করে তাহলে আমরা ধরে নেব সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক হোমরা চোমরা ওয়ালারাও এই মহাদুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত! এভাবে চলতে পারে না।চলতে দেয়া উচিতও নয়। সকল ক্ষেত্রের নৈরাজ্য যদি এভাবে গা সওয়া বিষয়ে পরিণত হয়, তাহলে ব্যর্থ দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে , নৈরাজ্যকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিবেন আর অন্যদিকে মধ্যম আয়ের দেশ বানানোর কাসুন্দি বাজাবেন এটা তো ঠিক নয়।আমাদের সোজা কথা, ‘ আমরা উন্নয়ন চাই না, আমরা চাই আইনের শাসন’। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে উন্নয়ন আপনা আপনিই ধরা দিবে। আমরা ফিরে পেতে চাই শিক্ষাসহ আমাদের সকল সাংবিধানিক অধিকার। আইনের প্রয়োগ হবে শুধুমাত্র গরীবদের ক্ষেত্রে আর আপনারা থাকবেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে এটা তো হতে পারে না। এটা হতেও দেয়া হবে না। যত দ্রত সম্ভব মেডিকেলে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নিন। সময় থাকতে আপনারা যদি নিজেদের না শুধরান, ঠিকই একদিন দরিদ্র, নিষ্পেষিত, অধিকার বঞ্চিত ছাত্ররা আপনাদের মত পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেগে উঠবে। আর সেদিন যত উচ্চস্বরেই আপনারা পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীরা ‘রাম, রাম, হরে রাম’ বলুন না কেন; স্বয়ং রামও আপনাদের পতন ফিরাতে পারবে না.........
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১৫