somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবশেষে পাশার সাথে দেখা!

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি থাকি ইস্তানবুলে আর পাশা আঙ্কারায়। এর আগে দুইবার গিয়েছিলাম তুরস্কের রাজধানী শহরে। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় দেখা হয়নি এ মানুষটির সাথে। দ্বিতীয়বার যখন একটা আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে যোগ দিতে গেলাম তখন বলা হয়েছিল পাশার সাথে দেখা হচ্ছে আমাদের। মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম।


কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না। পরে মন খারাপ করে প্রোগ্রামের বাকি অংশে যোগ দিতে সূফি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির শহর কোনিয়ার পথ ধরি। এবার তৃতীয়বারের মতো গিয়ে আর মিস হলো না। তাকে দেখা হলো। যার বীরত্বে অভিভূত হয়ে শত বছর আগে কবিতা লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল। আমি সেই পাশার সামনে দাঁড়িয়ে। রাজধানী আঙ্কারাতে অফিস আদালত ছাড়া দেখার মতো তেমন কিছু নেই। মানুষ তাই বিনোদন পেতে ভীড় জমায় পাশার মাজারে। আমিও বহু মানুষের সাথে আজ এসেছি। কিন্তু ইতিহাসে কি লেখা হবে এ কথা কখনো? পাশার সাথে আমার এ দেখা দীর্ঘ প্রতিক্ষার। যে সাক্ষাতের জন্য প্রেমিকের মতো কাতর মন নিয়ে কয়েকটা বছর অপেক্ষায় ছিলাম এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমি! আজ যখন স্বদেশে ফেরার অপেক্ষায় আছি তখনো আমার মনে উজ্জ্বল এ স্মৃতি।



হ্যাঁ। কে এই পাশা! আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা, পৃথিবীতে দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য বারেবারে উচ্চারিত নামগুলোর একটি মোস্তফা কামাল পাশার কথাই বলছি। তুর্কিরা তাকে আতাতুর্ক (জাতির পিতা) সম্বোধন করে। মুসতাফা কেমাল আতাতুর্ক। কী সরকারি দপ্তর, কী বেসরকারি, তুরস্কের সর্বত্র ঝুলছে তার ছবি। যে তাকে পছন্দ করে সে যেমন ঝুলিয়ে রেখেছে আবার যে পছন্দ করে না সেও। এটাই এখনো পর্যন্ত বিধি এই দেশে। এখানে আসার পর দেখছি তুরস্কে সবে থেকে বেশি জীবিত আর সর্বত্র উপস্থিত দু’জন মানুষ। একজন ইস্তাম্বুল জয়ী অটোমান শাসক সুলতান মেহমেত আরজন পাশা। সুলতান মেহমেত পুরো পশ্চিম জুড়ে এখনো এক বিস্ময় ও ভয়ের নাম। পশ্চিমা দেশগুলোতো আর একজন অটোমান সম্রাটের লোককাহিনীও বেশ প্রচলিত। তিনি সুলতান সোলেমান। কানুনে সুলতান, গ্রেট সোলেমান প্রভৃতি নামেও তিনি সমাদৃত।



পাশাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পুরো মুসলিম দুনিয়া নিয়ে আমার নিজস্ব একটি পর্যবেক্ষণ বলা লাগে। প্রধানত মুসলিম দেশগুলোতে ব্যক্তি পূজার প্রবণতা ভয়াবহ। সেটা কি পাকস্তান, কি মিশর কি বাংলাদেশ, কি সৌদি বা ইরান। আমরা দেখি এক ব্যক্তি বা তথাকথিত এক চেতনার কথা বলে শাসকরা শাসনের ছুরি ঘুরার সেসব দেশে। এটা হয়তো উপযুক্ত শিক্ষা, সুষ্ঠু গণতন্ত্র না থাকার ফসল। তুরস্ক জুড়েও একই প্রণতা লক্ষ্য করেছি। পাশার ভক্তদের কাছে তিনি ইশ্বর। তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। কেন যাবে না তাও জানা যাবে না। আর পাশাকে জনসমর্থিত কতৃত্ববাদী এক নায়ক বললে কল্লা কাটা যাবে। তুর্কিদের এই প্রবণতাই হয়তো ৬০০ বছর দুনিয়া শাসন করা এ জাতিটিকে আধুনিক বিশ্বের নেতৃত্ব থেকে ছিটকে দিয়েছে।




এই পাশাকে জানতে হলে ফিরতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন বিক্ষুব্ধ, বিধ্বস্থ সময়ে। ক্ষয়িষ্ণু উসমানীয় খেলাফত তখন নড়েবড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা জড়াতে চায়নি শুরুতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্ধু রাষ্ট্র জার্মানির জন্য জড়ায় বা জার্মানি তাদের জড়াতে বাধ্য করে। সে যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের আগেই পরাজয় বরণ করে অটোমানরা। একে একে বেদখল হয়ে যায় অটোমান ভূমি। ইউরোপের বালকান, মধ্যপ্রাচ্যের আরব অঞ্চল, মধ্য এশিয়া আর আফ্রিকার সব অটোমান ভূমি ভাগাভাগি করে নেয় রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেন। এরপর তাদের নজর পড়ে অটোমানদের মূল ভূমি মানে বর্তমান তুরস্কের দিকে। কথিত আছে দুর্নীতিগ্রস্থ ও দুর্বল অটোমান শাসক সে সময় মূল ভূমিও ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় তরুণ কামাল।



হাইকমান্ডের নির্দেশ উপেক্ষা করে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে তুর্কি সেনারা। দীর্ঘ এ যুদ্ধে কয়েক লাখ সৈন্য মারা যায়। অবশেষ পরাজয় মেনে নিয়ে তুরস্ক ছেড়ে চলে যায় ব্রিট্রিশ বাহিনী। এ যু্দ্ধের মাধ্যমে কামাল পাশা তুরস্কে মোটামুটি এক প্রতিষ্ঠিত নাম। এটা বুঝতে পেরে অটোমান শাসক পাশাকে নাস্তিক ঘোষণা করে বসেন। এখানে হয়তো সাধারণ মুসলমানের সেন্টিমেন্টকে পাশার বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে তাকে কোনঠাসা করাটাই ছিল উদ্দেশ্য। পাশার বিরুদ্ধে গঠন করা হয় খেলাফত আর্মি। ফলে এখানে পাশাকে একই সাথে লড়তে হয় বিদেশী লুটেরা ও স্বদেশী তথাকথিত খেলাফত আর্মির বিরুদ্ধে। জন্ম হয় এক নতুন পাশার, যে তার মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলে যুদ্ধ করে তথাকথিত একদল খাঁটি মুসলমানের বিরুদ্ধেই। পাশার যে ইসলামবিরোধী মনোভাব তার শুরু মূলত অটোমানদের সাথে দ্বন্দ্ব থেকেই বলে অনেকে মনে করেন। কথা হচ্ছে, পাশার মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের যত্রতত্র সমালোচনা হয়। কিন্তু মোটা মাথার মুসলিমদের এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মুরোদ নেই, পাশাকে মুসলিম বিদ্বেষী বানালো কে, কেন পাশা ইসলাম ধর্মের লোক হয়েও এই ধর্মটিকে নিমূলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি কেন পাশাকে সেদিন নাস্তিক, দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তার কল্লা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল? পাশা বিরোধিরা এমন দাবিও করে না যে, পাশাকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করা হয়নি।



যাইহোক, ব্রিটিশরা এত সহজে পরাজয় মেনে নেওয়ার পাত্র না। তারা দেশে ফিরে গিয়ে গ্রিক বাহিনীকে তুরস্ক দখল করার জন্য উস্কানি দেয়, গ্রিকরাও ব্রিটেনের সমর্থন পেয়ে তুরস্ক আক্রমণ করে বসে। শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। প্রথমে দুর্বল তুর্কি বাহিনী পরাজয় বরণ করতে থাকে। এবার সোভিয়েত রাশিয়া শুরু করে অন্য খেলা। তারা এ অঞ্চলে পশ্চিমাদের আধিপত্য রুখতে চিরশত্রু তুরস্কের সাহায্যে এগিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত গ্রিক বাহিনীও পরাজয় বরণ করে তুরস্ক ছাড়তে বাধ্য হয়। আর কামাশ পাশা গোড়াপত্তন করেন তার ভাষায় আধুনিক এক তুরস্কের। সে সময় ইসলামিক পণ্ডিতরা পাশাকে ইসলামিক খেলাফত গঠন করে সে খেলাফতের আমির হওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ক্ষমতায় বসে তুরস্কজুড়ে আরবি হরফ বিলুপ্ত করেন। হিজাব, প্রকাশ্যে ধর্মীয় কার্যকলাপ, আরবিতে আজান, জুমার ক্ষুৎবা, বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ হয় পাশার নির্বাহী আদেশে। ইসলাম ধর্মের কয়েক হাজার পণ্ডিতকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। সে সময় বিখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিত বদিউজ্জামান (বেদেউযযামান) সাঈদ নুরসীকে দীর্ঘ বছর কারাবন্দী রেখে নির্যাতন করেন, তাকে ইস্পার্তার জনমানবহীন এক পাহাড়ী এলাকায় নির্বাসনে রাখা হয় বহু বছর। সেখানে বসেই তিনি লিখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ রিসালায়ে নূর। যেটা মূলত মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের সাথে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যমূলক বিস্তারিত ব্যাখা। সেই ১৯২৩ সালেই নতুন তুরস্কে দুটি ভিন্ন ধারা তৈরি হয়। একটির নেতৃত্বে পাশ আর একটির নেতৃত্বে নূরসী। এরদোয়ান সহ যারাই তুরস্কে ইসলামকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করে তাদের সবারই মতাদর্শিক আধ্যাতিক গুরু এই নূরসী। মৃত্যুর পর যার লাশ জনমানবহীন এক গ্রামে কবর দিয়েছিল তৎকালীন তুর্কি সরকার। সেই গ্রামে আমি গিয়েছিলাম, ঘুরেছি ইস্পার্তা নামক পুরো শহরটিও। সময় করে লেখার ইচ্ছা রইল।



শেষের রেখা টানি। পাশা হচ্ছেন তিনি। যিনি আমৃত্যু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মৃত্যুর আগের রাতেও অসুস্থ শরীর নিয়ে নাচছিলেন শুধু এটা জানান দিতে অসুস্থতার কাছে তিনি হার মানবেন না। পাশা মরেও বেঁচে আছেন পুরো তুরস্ক জুড়ে। বর্তমানে পাশার আদর্শ বিরোধী এরদোয়ান সরকার টানা ১৫ বছর তুরস্কের ক্ষমতায়। তবু তাদের মাথার উপরে রয়ে গেছেন পাশা, যা তার প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতীক। নানা তর্ক-বিতর্কের পর পাশাদের নিয়ে আমার শেষ মূল্যায়নটা এমন-পাশারা যুগশ্রষ্ঠা, ক্ষণজন্মা কালজয়ী বীর। পাশাদের জন্মই হয় নতুন করে ইতিহাস লেখা হবে বলে। পাশার গল্পের পেছনে ছোটে না কখনো, তাদের নিয়ে বিস্তর গল্প হয়। ফলে পাশারা একনায়ক হয়েও জননন্দিত থেকে যান।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৫
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×