ধর্ম মানুষের বড় আবেগের জায়গা। দৈনন্দিন জীবনাচারের সবখানে ধর্মের সরব উপস্থিতি থাকে বলেই ধর্মের কথায় খুব সহজে মানুষ আবেগাক্রান্ত হয়, বিহ্বলিত হয়। এই জীবনে মানসিক প্রশান্তি আর অপর জীবনে অপার সুখের রুপকথার গল্প শোনায় ধর্ম। নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করা সাদা চামড়াধারী পশ্চিমা সমাজে যখন খ্রিশ্চান মৌলবাদীদের দৌরাত্ম্য হুহু করে বাড়ছে। তখন বাংলাদেশের মতো একটা দেশে ধর্ম নিয়ে কিছু না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এসব ক্ষেত্রে প্রাণহাণী ঘটলে একদিকে যেমন বিচার হয় না অন্যদিকে অপরাধীও সাধারণত অনুতাপে ভোগার সময় পায় না। স্বর্গীয় অন্ধতা বলে কথা। তবে ব্যতিক্রমও আছে। ভারতে শিবসেনার যে ধর্মোন্মাদ হিন্দু কর্মী বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে তার ইট নিয়ে উৎসব করেছিল তাকে আমরা পরে দেখি এক জীবনের অনুতাপে ভুগতে। অনুতপ্ত হয়ে বলবীর থেকে আমীর হয়ে যাওয়ার এ ঘটনা আমাদের আশা দেখায়। বাংলাদেশেও যারা পান থেকে চুন খসলেই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে, উপাসনালয়ে হামলা করেন, তাদের মালামাল লুট করেন তাদেরও কেউ ব্যতিক্রম হয়ে ভুল স্বীকার করবেন, বিশ্বাস করি। যারা (রাজনৈতিক নেতারা) ধর্মের আড়ালে লুটপাট বা জমিদখলের জন্য যায় তাদের কাছ থেকে আমরা এমন সুমতি আশা করি না। তবে যারা নিখাদ ধর্মীয় ঘোরে এসব অপকর্ম করে তাদের কাছ থেকে আশা করতে দোষ দেখি না।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলদেশী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াযের মতে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের ইতিহাসে যে কেন সময়ের চেয়ে প্রধান দুটি দলেরই এখন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সাথে মাখামাখি প্রকাশ্য, রাখঢাকহীন। হেফাজতের কাছে যখন বারবার মাথা নত করছে কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল আওয়ামী লীগ, তখন বুঝতে হয় ভোট নামক একটা বিষয় আছে। যেখানে বিবেক, দায়বোধ, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি বলে কোন শব্দ থাকে না। তবু আমাদের আশাবাদী হতে হয়। যার সূত্রপাত প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের মাধ্যমে।
কুতববাগী নামক পীরসাহেব এবার ঢাকায় তার কথিত ওরস করতে দেওয়া হবে না খবর শোনে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম। অবশ্য আশংকাও ছিল, মুরিদরা কী থেকে কী করে বসে। তাদের বাবার (পীর কেবলা) কাজে বাধা দেওয়া বলে কথা। যিনি স্বপ্নে ইসলাম ধর্মের শেষ নবীর বেশে তাদের কাছে যান, তাদেরকে মৃত্যুর পর বেহেস্তে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন। না কিছুই হয়নি। তাহলে ওরসের নামে বেশ কয়েকদিনের নির্যাতন থেকে বেঁচে গেল ঢাকাবাসী।
এ খবর পুরনো না হতেই খুব সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। তারা এবার বাংলাদেশের পীর জগতের সবচেয়ে বড় গ্যাং দেওয়ানবাগীকেও ঢাকায় ওরস করতে দিচ্ছে না। একক পীর হিসেবে দেওয়ানবাগীই বোধহয় বাংলাদেশে সেরা। টাকা পয়সা, লাঠিয়াল সবকিছুই তার বেশি হওয়ার কথা। তার ওরস নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া তাই আমাদের আশা দেখায়।
পীর সাহেবী বাংলাদেশে খুব লাভজনক একটা ব্যবসা। শুধু আর্থিক না, শারীরিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন এসব দরগা, মাজারের সাথে সম্পৃক্তরা। আমি বলি পীরালয়গুলো হচ্ছে অপরাধের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের যে ক জায়গায় মাকাসক্ত, যৌন নিপীরকরা নিরাপদ বোধ করে তার অন্যতম হচ্ছে মাজার বা দরগাগুলো। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। ভোট-ভাগ দুটোতেই টান পড়ার আশংকা। পীর সাহেবের দরগার যা আয় তার থেকে একটা অংশ প্রশাসন পায় না তা বিশ্বাস করার মতো ওদ্ধত্য আমার নেই।
সবচেয়ে দু:খজনক হচ্ছে, এইসব মাজারের যে ভণ্ডামি, মূর্খামি এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। সুফিজমের কথা বলে ওদের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন অনেকে। আমাদের কথিত প্রগতিশীল মিডিয়াকেও দেখা যায় সুফিজম আর পীর ব্যবসাকে একসাথে গুলিয়ে ফেলতে। মিডিয়া এমনটা রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবেলার চিন্তা থেকে করতে পারে। কিন্তু যারা নিজেরাই মার্কা ছাড়া বাটপার তাদের দিয়ে অন্য কাউকে মোকাবেলার চিন্তা করাটাও এক ধরণের বাটপারি, আমার কাছে। একটা ভুল কেবল আরেকটা দুর্যোগেরই জন্ম দেয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম যেমন মানহীন তেমনি অতিমাত্রায় দলবাজির কারণে মূল্যহীনও। ওদের প্রভাব তাই জনমানসে খুব একটা নেই।
সুফিরা ছিলেন এসব দরগা বিরোধী, ব্যবসা বিরোধী। দরগার যে কনসেপ্ট তা সুফিজমের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বা মিডিয়াকে এ কথাটা বোঝাবে কে! পাবলিক খুঁজে একটা সহজ পথ। পাপ থেকে মুক্তির আর জান্নাতে যাওয়ার। ফলে যারা খুব শিক্ষিত ঘুষখোর, তারা গিয়ে পীরের মাজারে হাজির হয়, ঘুষের কাফফারা দেয়। আর যারা খুব অশিক্ষিত, মূর্খ, তারাও যায় পরকালে পার পাবার আশায়। আর আমার মতো মধ্যবিত্ত বাঙালি চেয়ে চেয়ে রং দেখে। সুফিরা জীবনের সব স্বাদ-আহ্লাদকে ত্যাগ করে মানবসেবায় ব্রতী হয়েছিলেন। আর প্রধানত বৃহত্তর ভারতে গড়ে ওঠা মাজারগুলি হচ্ছে অন্যরকম গরীব খেকু, রক্তচোষা। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আর কোথাও এসব মাজার ব্যবসা নেই। এক একটা পীর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে। ওদের শরীর যেন কুরবানির বিশাল গরুকেও হার মানায়।
দেশের বিশাল একটা অংশ ওদের পূজা করে বলে ওদের সবাই মেনে ও মানিয়ে চলে। এরমধ্যেই ব্যতিক্রম করে দেখাল দুই সিটি কর্পোরেশন। তারা যে সদিচ্ছা দেখিয়েছে আশা করি সরকার তা এগিয়ে নেবে। এর থেকেও বড়, বাস্তব ও কঠিন সিদ্ধান নেবে। আমার মত হলো, বাংলাদেশে যতো দরগা, মাজার ইত্যাদি আছে এগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হোক। মাজারের যাবতীয় আয় দিয়ে ফ্রি স্কুল, হাসপাতাল, এতিমখানা ইত্যাদি পরিচালনা করা হোক। এটা করা গেলে যারা না বোঝে পীরের দরগায় গিয়ে টাকা দিয়ে ভুল করে আসছে তাদের টাকাগুলো অন্তত কিছুটা হলেও সঠিক পথে ব্যবহৃত হবে। এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করা হোক, যে কমিশনের আওতায় মাজারগুলো পরিচালিত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ২:৩৬