একাত্তরের শব্দসৈনিকদের স্বীকৃতি দেয়া হোক।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কন্ঠ দিয়েও যুদ্ধ সম্ভব। এমন ধারণা তৈরী করতে সম্ভব হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সেই কন্ঠ যোদ্ধাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান মাতিয়ে রেখেছিল। আর সারাদেশের মানুষের কাছে এই কন্ঠযোদ্ধারাই পৌছে দিয়েছেন সাহস, স্বপ্ন এবং যুদ্ধের সকল বিজয়ের খবর।
অথচ এই কন্ঠযোদ্ধাদের খবর কিন্তু কেউ সহজে নিতেও চায় না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই শিল্পীদের খোজ কেউ কেউ নিলেও যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেকে পরিচালনা করতেন কিংবা বলা যায় যাদের জন্য এই কাজটি সম্ভব হয়েছিল তাদের কাছে কেউ কিন্তু সহজে যায়ও না। তাদের মধ্যে হতাশা এবং একটি চাপা বেদনা কাজ করে। মনের মধ্যেই সে কষ্টকে তারা লালন করছেন স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও।
যেমন, একটি সাক্ষাতকারে কবি মুস্তফা আনোয়ার বলেছেন,
কেউ ব্যাপারটা জানতে চায় না। সরি। হ্যা সরি। আমি এক্সাইটেড হয়ে গেছি। আমরা এক্সাইটেড হই এ জন্য যে প্রতিবার মার্চ মাস আসলেই অনেকেই আসে, খোঁজ নেয়। আজেবাজে, নেক্কারজনক প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করে, আচ্ছা আপনি তো তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে ছিলেন, বলুন তো, কার গলায় স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন। কে দিয়েছিলেন? ইনি দিয়েছিলেন নাকি তিনি দিয়েছিলেন? কখন শুনেছিলেন?
মুস্তফা আনোয়ার এভাবেই মনের কষ্টের কথা বলেছেন। তিনি হচ্ছেন একজন কবি। ১৯৭১ সালে যখন ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন হলো তখন চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটারটি কালুরঘাট স¤প্রচার কেন্দ্রে নিয়ে স্থাপন করা হলো। নামকরণ করা হলো “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। ২৭ শে মার্চ এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পাকি সরকারের নজর পড়লো এই কেন্দ্রের উপর এবং ৩০ শে মার্চ চালালো বিমান হামলা। পরে যে ১০ তরুণের সহায়তায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি পুনরায় প্রাণ পায় সেই ১০ জনের একজন হচ্ছেন কবি মুস্তফা আনোয়ার। আরও ছিল, সৈয়দ আব্দুস শাকের, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদ, আমিনুর রহমান, রাশেদুর রহমান, শরফুজ্জামান, কাজী হাবিব উদ্দিন আহম্মেদ মনি এবং রেজাউল করিম চৌধুরী । ১ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন টান্সমিটার উঠিয়ে তারা রওনা দিলো আগরতলায়। সেখান থেকেই তারা পুরো উজ্জীবিত করে রেখেছিলেন গোটা নয়টি মাস।
তাদেরই সহায়তায় পুরোদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বহু শিল্পীকে। তারা গান গেয়ে কবিতা আবৃত্তি করে শক্তি যুগিয়েছেন গোটা জাতিকে। দোসর বাহিনীর বিপক্ষে কন্ঠ দিয়ে ভাষার বৃষ্টি ঝরিয়ে কাবু করেছেন পাকি সরকারকে। এই ভাষা সৈনিকরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে সেদিন জীবন বাজি রেখে কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন যেন এখন গুড়ে বালি। ইতিহাস যেনো তাদের মূল্যায়ণ করতেই ভুলে গেছে। উদ্যেক্তা এবং শিল্পীরা উভয় পক্ষই যেনো আড়ালে পড়ে গেছেন।
সেই সব শিল্পীদের দেয়া বিভিন্ন সময়ে দেয়া সাক্ষাতকার পড়লেই বোঝা যায় তাদের কষ্টের কথা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা তুলে ধরছিল।
মঞ্জুলা দাশগুপ্ত:
তিনি একজন গানের শিল্পী। তিনি বললেন,
.......কত আশা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিষ্ঠিত হবে। গর্ব করে বলবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমরা শব্দসৈনিক, আমরা সাহিত্যিক- আমরাই তো তোমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্যি যে দেশ আজ অব্দি ঐ সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তেমন কিছুই করতে পারলো না। এমন কি স্বীকৃতি পেল না সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিও, যার স¤প্রচার এক সময় সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছিল স্বাধীনতাকামী সকল মানুষকে। ভেবে ছিলাম আর কিছু না হোক স্বাধীন বাংলাদেশে অন্তত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পাবে। আমরা আবার ঐ কেন্দ্রে থেকে গান গাইবো আর দেশটাকে সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করবো। আগামী প্রজন্মকে জানাতে পারবো তাদের অতিত আত্মা উৎসর্গকারীদের গৌরব-গাঁথা, তারা খঁজে পাবে তাদের জন্মর ঠিকানা। .......
তিমির নন্দী:
......আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টর রয়েছে বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিকে কি একটি সেক্টর বলা যায় না? তার কি কোনো ভূমিকা ছিল না? আমরা কি সেদিন দেশের জন্য কিছুই করিনি? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম তৎপরতা। কী কষ্ট সহ্য করে ১০জন নির্ভীক শব্দসৈনিক চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিশনটি জীবনের ঝুকি নিয়ে কাঁধে করে ভারতের আগরতলায় জঙ্গলে পুনঃস্থাপন করে প্রচার করতে থাকেন তাঁদের অনুষ্ঠান। তাঁরা এ সাহসী কাজটি না করলে আমরা কোথায় পেতাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র? অতীতে যারা দেশ পরিচালনা করেছেন তারা কিভাবে এই ১০ জন বীর যোদ্ধাদের মূল্যায়ণ করেছেন তা আমার জানা নাই। ৩৭টি বছর পার হয়ে গেছে স্বাধীনতার। এর মাঝে আমাদের দেশে অনেক সরকার এসেছেন। কিন্তু কোনো সরকারই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের কথা ভাবেননি। আমরা আজও অবহেলিত ভাবে পড়ে রয়েছি। তাই বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে মুক্তিযুদ্ধের ১২ নং সেক্টর হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। আর সেই সাথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রয়াত শিল্পী ও কলাকুশলীদের পরিবারের জন্য এবং বর্তমানে যে সব শিল্পী ও কলাকুশলী এখনও জীবিত অথবা অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন তাঁদেরকে সরকারিভাবে মূল্যায়ণ করে তাঁদের জন্য কিছু করা হোক। ........
এই হলো তাদের মনের কথা। ১০ তরুণ এবং স্বাধীন বাংলার অসংখ্য শিল্পীদের দাবি ও দুঃখ সবই চাপা। কারণ আমরা নতুন প্রজন্ম তাঁদের নিয়ে কখন কথাও বলি না। তাঁদের কাছে সে সময়গুলোর গল্পও শুনতে চাই না। জীবনের ঝুকি নিয়ে যে দশ তরুণ সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে দাঁড় করিয়েছিল তাদের সেই সাহসের কথা বলতে গিয়ে মুস্তফা আনোয়ার বলেন,
ওই ঘটনাটা আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো কমিউনিস্ট পার্টি ঘটায়নি। অল ইয়াং অফিসার ডিট ইট। বলতে পারো, সেটা ছিল তারুণ্যের স্বভাবসুলভ গতি। সাহস, পিছুটানহীন। ট্রান্সমিটার খুলে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমরা যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে চাই। জানাতে চাই। আমাদের কথা বলার আছে। তখন তো অবস্থা ছিল ডু অর ডাই। আর ব্যাক করা? করবো কেনো? তারুণ্য কি ব্যাক করতে বলে?
কথাগুলো শুনলে নিজেরও খুব খারাপ লাগে। ভেতরে একটা অপরাধ বোধের জন্ম হয়ে। তারুণ্য সামনের দিকে যেতে বলে। কিছু করতে বলে। কিন্তু আমরা একদম ঝিমিয়ে যাওয়া তরুণ আমরা তো তাঁদের চিনতেও পারলাম না। তাদের মতো সাহস দেখিয়ে দেশের জন্য কিছু করতেও পারলাম না।
যাইহোক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের এবং এই দশ তরুণদের সরকার কখনও মূল্যায়নও করেনি। স্বাধীনতার এতো বছর পরও তারা ইতিহাসের অন্ধকার জায়গায় পড়ে রয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালের ২৫শে মার্চ তথ্য মন্ত্রণালয়ের হ্যান্ডআউটে সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০ উদ্যোক্তাকে স্বর্ণপদক দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সাক্ষর হওয়ার পরও তা এখনও কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। তাদের স্বীকৃতি এখনও মেলেনি।
এ সম্পর্কে মুস্তফা আনোয়ার বলেন,
এটা জাতির জন্য দুঃখ জনক ব্যাপার। আসলে আমরা বুড়োগুলো না মরলে হবে না। মাটি, মাটি তো যাবে না। মাটি থাকবে। এখন যারা ক্ষমতায় আছে, আর যারা নাই কিংবা আসতে চাচ্ছে, এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এরা তো পিপলের পার্টি না। এরা তো চেগুয়েভারা না! ক্যাস্ট্রো না। এরা বিপ্লব করে না।
আসলে এসব নিয়ে বহু লেখা হয়েছে। পদক দেয়া হচ্ছে না কেন, পদক দেয়া হোক! এখন বক্তব্য হচ্ছে, ঠিক আছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যদি সরকার দিতে না চায় তবে তা বাতিল করা হোক। তারা স্পষ্ট বলুক, স্বীকৃতি দিতে চাই না। এটা বাতিল করা হলো। বলুক। আমি চাই সরকার একটা কিছু বলুক। ঝুলিয়ে রাখা যেনো না হয়।
ক্ষোভের তৈরী হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্ষোভ তৈরী হয়েছেও। সাথে হতাশা। তবে আমি শুধু বলতে চাই পদক যদি নাই দেন সরকার তবে অন্তত এই সাহসী কন্ঠ সৈনিকদের নাম ইতিহাসের পাতায় নাম লেখা হোক। তারা ত্যাগ এবং তাদের সাহসকে ইতিহাসে তুলে ধরা হোক।
তথ্যসূত্র:
১. লিরিক, গানের কাগজ, মুক্তিযুদ্ধের মূর্ছনা।
২. বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ, কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, শামীমা বিনতে রহমান।
১২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর
বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছবির গল্প, গল্পের ছবি
সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন