রাতের অটুট নিস্তব্ধতায় ভেঙ্গে গেলো-
কোনো এক রাত জাগা পাখির ডাকে,
শেওলাধরা পুরানো পাঁচিলে-
ঘেরা গোরস্থানে
উঠছে নামছে ক্লান্তির কোদাল!
তৈরী হচ্ছে নতুন আবাস-
উদ্দেশ্য পরপার
না আমি কোন বেওয়ারিশ লাশের গান গাইছিনা, আমি বলতে এসেছি এই পরপার এ যাবার প্রথম যে আবাস স্থল যারা তৈরী করে তাদেরই একজনের কথা। কেন বলছি ? কারন সে বলার মতনই। যার কথা বলছি সে হল, শুকনা টিং টিঙ্গা লম্বা, দ্রুত কথা বলা ছেলেটা, চোখের সামনে বেড়ে উঠল ধাই ধাই করে। ওর নানী আমাদের গৃহপরিচারিকা, প্রায় ১৫ বছর ধরে একটানা কাজ করছে। আমাদের পরিবারেরই একজন প্রায়। মহিলা যখন কাজ করতে আসত সাথে করে তার ছোট্ট নাতিটিকেও নিয়ে আসত। সে ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির উচ্ছলতা স্পর্শ করত আমাদের পুরো পরিবারকে। সময়ের ধাবমান স্রোতে সবাই এগিয়ে চললাম, সেই ছোট্ট ছেলেটিও বেড়ে উঠল, সারাটি দিন থাকত আমাদের বাড়িতে। আম্মাকে ডাকে খালা, আর আমাদের ভাইয়া আর আপু। ও ছোটবাবু নামে পরিচিত, কারণ আমাদের বাসায় বাবু নামে একজন আছে, সে হল এই অধম আমি। সুতরাং, ও হল আমাদের বাসার ছোট বাবু। ও আবার আমার খুবই ভক্ত, এর কারন হয়ত ওকে আমি টিভিতে কার্টুন দেখতে দিতাম অথবা মুভি দেখার সময় ওকে ডাকতাম আমার রুমে। ওর নিস্কর্মা বাবা আর সংন্সার চালনা কারী মায়ের জন্য দুইছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে চলা কষ্টকর ছিল। ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম, ভালোই বছরগুলো যেতে লাগল, কিন্তু ওর আমাদের বাসায় আসা মিস নেই। প্রতিদিন একবার হলেও আসতেই হবে। আর যে কোন কাজেই ওর চরম আগ্রহ। বাসার সমস্ত প্রকার ক্লিনিং প্রোগ্রামের ওই প্রতিনিধিত্ব কারি। আমাদের কোরবানীর গরু কেনার জন্য ওর ২ মাস আগের থকে ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্লান করে কিভাবে নিয়ে আসবে গরু, কত বড় হবে ইত্যাদি ইত্যাদি আর সেগুলো শেয়ার করতে থাকে আমাদের সাথে। আমি ভক্ত ছোটবাবু ধীরে ধীড়ে আমাকে হারাতে থাকল, কারন আমি ততদিনে ইঊনিভার্সিটিতে ঢুকে গেছি, নিজ শহরেরই। আর কোচিং সেন্টারের ব্যাস্ততা নিজেকে ১৮ ঘন্টা ব্যতিব্যাস্ত করে রাখল। এর পর ওর সময় কাটে আমার ছোটভাইয়ের সাথে। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে বের হতাম, নিয়ে যেতাম ভার্সিটিতে আমার সাথে। আমার বন্ধু মহলে সবাই ওকে চেনে, ছোটবাবু-এক করিতকর্মা ছেলে। আবার সকল প্রকার খেলা ধুলায়ো পারদর্শী, বিভিন্ন স্কুল টুর্নামেন্টে ও ভাল খেলে পুরস্কার পেতো আর আমাদের দেখাতে নিয়ে আসত। এর পর ভার্সিটি জীবন শেষ করে ঢাকায় চলে গেলাম, ও তখন ক্লাস নাইনে পড়ে, মাঝে মাঝে আমার ছোটভাইয়ের ফোন দিয়ে ফোন করত আমাকে, সালামের পরেই প্রথম প্রশ্ন আমি কবে আসব খুলনা ?
এর পর সময় গড়িয়ে যায়, আমি এক বছর পর চলে গেলাম দেশের বাইরে। ওখানে বসে ওর খবর নিতাম আমার বাসা থেকে, আসে মাঝে মাঝে আমাদের বাসায়, ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আর শখের বশে ওরা কয়েক বন্ধু মিলে কবর খুড়তে যায়। শুনে অবাকই হলাম, অনেক ভাবে চেস্টা করেছে সবাই ওকে আমার সাথে কথা বলনোর জন্য কিন্তু, আসেনা আমার ভয়ে, পাছে রাগ করি ওকে। এর বছর খানেক পর শুনলাম ছোটবাবু ক্লাস টেন এর পরে আর পড়েনি, কাজ শুরু করেছে ঢাকার কোন এক গার্মেন্টসে। এক বার দেশে আসলাম কয়েক সপ্তাহের জন্য, বাসার সবার সাথে সাথে ওর জন্যও আনলাম টি শার্ট। আমি এসেছি শুনে ছুটি নিয়ে চলে আসলো খুলনা, বলে –আপনি যতদিন আছেন, আমি আর যাবনা ঢাকায়। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, পড়া বন্ধ করলি কেন ? ঊত্তরে অপরাধী ভঙ্গীতে উত্তর দেয়, আবার ভর্তি হব। আমি বলি আমার সাথে সবসময় থাকতে চাইলে পড়াশুনা করতে হবে, টুই ডিগ্রি পাশ করলে আমি তোকে চাকরি দিয়ে দেব। জিজ্ঞেস করলাম, কবর খুড়তে যাস কেন? বলল, এলাকার কেউতো যায়না, এলাকার গরিব মানুষ গুলো মরে গেলে, কেউ ওদের কবর খুড়ত্রে চায় না, তাই আমি, রবিউলের ভাই রমযান (রঙ মিস্ত্রি), আযোমের ছেলে জমিরুল(পালিশ মিস্ত্রি), আর সোহেল( কাঠ মিস্ত্রি) আমরা কয়েক জন মিলে কবর খুড়ি। এর পর আবারও দুবার আসলাম দেশে, ও যেখানেই থাকুক, চলে আসে বাসায় আর প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত বিভিন্ন গল্প করতে থাকে, কে খুব খারাপ কাজ করে, কে ওকে নষ্ট করে দিতে চাইছিল, ওর অফিসের ড্রাইভাই কিভাবে গারীর তেল ্চুরি করে, ওর বিদেশী মালিকএর জন্য ঢাকার কোথা থেকে মদ কিনে নিয়ে আসত ও, ওর মালিক ওরে অনেক পছন্দ করে, ওর সাথে কি কি কথা বলে এইসব, ওর মালিক কে আমার কথা বলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন শুনলাম ওর কবর খোড়ার সংখ্যা ৪০ টার মত। ঢাকায় থাকার কারনে, কম হয় খোঁড়া। আর এল্কার যে কেউ মারা গেলে ওদের ডাক আসে, এখন আর সমাজের গরিবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ওরা। গত বছর নভেম্বরে আসলাম দেশে ঈদ করতে, এসে শুনলাম ওর চাকরি নাই, কারন মালিক চলে গেছে ওস্ট্রেলিয়া। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় আর রাত হলেই আসে আমার সাথে গল্প করার জন্য। ওর নানী নালিশ দিল, আজে বাজে ছেলের সাথে ঘোরা শুরু করছে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাতে কোন টাকা আছে কিনা, বলল খুব বেশী নাই। বললাম, শেষ হলে কি করবি ? বলে ড্রাইভিংটা শিখে ফেলব ভাবতেছি, গাড়ি চালাবো-আর আপনি যখন গাড়ি কিনবেন তখন সারাদিন আপনার সাথে থাকব। আপনার গাড়ি চালাবো। সেই ছোট্ট বেলা থেকে এই সহজ সরল ছেলেটির যে বিশ্বাস আর ভালোবাসা দেখে আসছি তা যেন আজ আরও বেশী করে উপলব্ধী করতে পারলাম। ওকে একটি কম্পিঊটারের দোকানে চাকরি দিলাম-আর বলে দিলাম, আমি এক বছর পরে আসব, এসে যেন শুনি তুই স্কুলে ভর্তি হয়েছিস আর কম্পিউটারের হার্ডোয়ার এর কাজ শিখে ফেলেছিস।
মাঝে মাঝে খোজ নিতাম ওখান থেকে, ওই দোকানের মালিক এর জন্য ও একটা বিস্ময়,শুনতাম ভালোই আছে, কঠোর পরিশ্রমি, আর খুব ভদ্র যা এই ধরনের ছেলেদের মধ্যে দেখা যায়না। তার ধারনা খুব শিক্ষিত পরিবারে বেড়ে না ঊঠলে এই ধরনের শিষ্টতা সম্ভব না। এবার আবার দেশে ফিরে আসলাম। আর সবার সাথে ও খুব খুশি, প্রথমেই বলল “আমি জানুয়ারীতে স্কুলে ভর্তি হব আবার। আপনি আমারে ভর্তি করে দিয়েন। আর আপনই বিদেশে যাইয়েন না”। ও আসে প্রতিদিন রাতে আমি কাজ করতে থাকি ল্যপ্টপে আর ও টিভি দেখতে থাকে এবং সাথে সাথে ওর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প করতে থাকে। মাঝে মাঝে কবরখানার রোমহর্ষক কিছু গল্প বলে, আমি শুনি । ওর খোঁড়া কবরের সংখ্যা এখন ১১৯ টি। কিছুদিন আগে ওদের কে কোদাল, চার্জ লাইট ইত্যাদি কিনে দিলাম। ছোট ছোট ছেলেরা বিনা পয়সায় এরকম একটি সমাজ সেবা মূলক কাজ করতেছে ভাবতেই ভাল লাগে। ও বলেছে একদিন রাতে কবর খোঁড়ার সময় আমাকে নিয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞেস্ক করলাম কেন? উত্তরে বলল- “ভাইয়া আমাদের সবারই মনে হয় মাঝে মাঝে কবর খানায় যাওয়া উচিত, তাহলে আর মানুষ খারাপ হতে পারবে না। কারন সে দেখবে যে আমরা যত কিছুই করিনা কেন শেষ জায়গা এইটা। আর একটা জিনিস ভাইয়া, সেইটা হল যত বড়লোক, যত বড় নেতা যেই হোক, মরে যাওয়ার পরে কেউ কিছু না, নিজের পরিবারের লোকেরাও এক সময় আর আসেনা কবর দেখতে, আমরা একটি কবরের উপর আর একটা কবর দেই, পচা গলা লাশ দুহাতে ঊঠাই । কিছু কিছু ভাল মানুষের কবরের উপরে আমরা ফুল আর মাটি দিয়ে আসি কারন বেশী দিন হয়ে গেলে আর কেউ আসেনা।” মুগ্ধ হলাম এই ছেলের কথা শুনে, জীবনের সত্য দর্শন ও শিখে ফেলেছে, না কোন বই পড়ে বা শিক্ষকের কাছে থেকে নয়, ও শিখেছে নিজে নিজে, ও আসলে সত্য আলোয় আলকিত এখন, ওকে আর কেউ অন্ধকারে টেনে নিতে পারবেনা। আমাদের ছোটবাবু একজন সত্যমানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





