![]()
মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকার পুরস্কার হিসেবে ইংরেজরা এই ভবনটি (হাজারদুয়ারী) তার পরিবারের জন্য নির্মাণ করেছিলেন।
আজ ২৩ জুন। ২৫২ বছর আগে, ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর আমবাগানে সংঘটিত যুদ্ধে কুচক্রী মীর জাফর এবং তার সাথীদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ক্লাইভের কাছে পরাজিত হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয় নির্দয়ভাবে। পলাশী দিবস বাংলার ইতিহাসে শোকাবহ ও বেদনাবিধূর একটি দিন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব। তার জন্ম ১৭৩৩ সালে। নবাবের পুরো নাম মীর্জা মুহম্মদ সিরাজদ্দৌলা। তার পিতা নবাব আলিবার্দী খাঁ’র ভাইয়ের ছেলে এবং মেয়ে জামাই মীর্জা মুহম্মদ জয়েন উদ্দীন। সিরাজের মাতা আমিনা বেগম নবাব আলিবর্দী খাঁ’র কনিষ্ঠ কন্যা। নবাব আলিবর্দী খাঁ ছিলেন অপুত্রক। কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা’র পুত্র অর্থাৎ তার নাতি সিরাজ নবাবের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। নবাব আলিবর্দী খাঁ’র মৃত্যুর পর, তার ইচ্ছা অনুযায়ী ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মসনদে আরোহন করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
![]()
নবাব সিরাজউদ্দৌলা
সিংহাসনে আরোহনের পরপরই সিরাজকে এক তীব্র গৃহবিবাদের সম্মুখীন হতে হয়। নবাব আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম, মধ্যমা কন্যার পুত্র শওকত জঙ্গ এবং অপর এক ভগিনীপতি সেনাধ্যক্ষ মীর জাফর-এরা কেউই সিরাজের মসনদ লাভকে সুনজরে দেখেননি। ঘসেটি বেগম সিরাজের শুত্রুতা করতে শুরু করেন। ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ ও ঘসেটি বেগমের সাথে সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
সিরাজের রাজত্বকালের প্রথম থেকেই ইংরেজরা নানাভাবে তার কর্তৃত্ব উপেক্ষা করতে থাকে। তারা সিরাজের অনুমতি ছাড়াই দুর্গ নির্মাণ করে। সিরাজ তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং দুর্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু তবুও ইংরেজরা এ আদেশ অমান্য করে। আদেশ অমান্য করার অপরাধে ১৭৫৬ সালের ২০ জুন সিরাজ কলকাতা দুর্গ অধিকার করেন। কলকাতা পতনের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছলে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বাংলায় সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হন। ১৭৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা কলকাতা দুর্গ পুনর্দখল করেন এবং অল্পকালের মধ্যে নবাবকে আলিনগরের সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করেন।
এদিকে রাজদরবারে সিরাজ বিরোধী চক্রান্ত ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেট, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ, উমিচাঁদ এরা সিরাজের খুব বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। অথচ, এরাই নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ক্লাইভের সাথে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয়।
এরপর ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধিভঙ্গের মিথ্যা অজুহাত এনে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন তারিখে পলাশী নামক গ্রামের আমবাগানে নবাব ও ক্লাইভ পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবাব পক্ষের জয় যখন সুনিশ্চিত তখন আচমকা প্রধান সেনাপতি যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেন, তারই বিশ্বাস ঘাতকতায় যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়ে, প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। নবাব ঐদিনই রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। ২৪ জুন স্ত্রী লুৎফুন্নেছা ও শিশু কন্যাসহ নৌকাযোগে রাজমহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজমহল যাওয়ার পথে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত নবাব দানা শাহ নামে এক ফকিরের আশ্রয় নেন। কিন্তু এ লোভি ফকিরও নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেয়। ২৭ জুন বন্দি নবাবকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়। মীরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ ৩ জুলাই নবাবকে হত্যা করে। এরপর নবাবের মৃত দেহ হাতির পিঠে উঠিয়ে সারা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়ে অমর্যাদাকর অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। রাতের আঁধারে নবাবদের বিশ্বাসী খাদেম হোসেন খাঁ খোশবাগে তাঁকে সমাহিত করেন। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। পাশে শায়িত আছেন কন্যা ও স্ত্রী।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনকাল এক বছর কয়েক মাস বেশী স্থায়ী হয়েছিল। সিংহাসনে আরোহনকালে তিনি ছিলেন কৈশোর উত্তীর্ণ মাত্র ২৩ বছর বয়েসের এক তরুণ। ২৪ বছর বয়সে স্বদেশকে ভালবেসে, স্বদেশের মানুষকে ভালবেসে, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই প্রাণবিসর্জন দিয়েছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এখানে কায়েম ঔপনিবেশিক শাসন যার স্থায়ী হয়েছিলো প্রায় ২শ বছর।
পলাশী থেকে মেহেরপুর
![]()
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তার ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পলাশী থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (মুজিবনগর) বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ ও প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আবার সে স্বাধীনতার সূর্য উদয় হল। ।
———————————————————–
তথ্যসূত্র : ইত্তেফাক, বাংলাপিডিয়া

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




