সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠেই মনে হল মনটা ভাল নেই। কারণটা মনে পড়ল একটু পর। রাতে বড় আপা বকা দিয়েছিল।যদিও আমার কোন দোষ ছিল না। অভিমান করে অল্প খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সেটা ঠিক হয়নি। খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করছে। আবার প্রচন্ড শীতের মধ্যে লেপের নীচ থেকেও বের হতে ইচ্ছে করছে না। তবু উঠতে হল। দাঁত ব্রাশ করে কোন মতে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। কারণ পানি বরফের মত ঠান্ডা।
বাথ রুম থেকে এসেই দেখি গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষী আপু। আমার অবস্থা দেখে আপু বললেন, তুই খাঁটের উপর লেপ মুড়িদিয়ে বোস্। আমি ওখানেই দিচ্ছি।
আপুর কথা শুনে আমি লক্ষী ছেলের মত খাঁটে বসেই নাস্তা শুরু করে দিলাম।
ও আচ্ছা, আপুর পরিচয়টাই তো দেয়া হয়নি। ইনি হচ্ছেন শ্রীমতী লক্ষী চক্রবর্তী। বড় আপার কলিগ্ ছিলেন এক সময়। প্রায় দশ বছর দুই বান্ধবীর দেখা নেই। মাস খানিক পূর্বে তাঁদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই বড় আপার সাথে এখানে তিন দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। আজ শেষ দিন। আগামী কাল ফিরে যাব।লক্ষী আপু বড় আপার অনেক দিনের প্রিয় বান্ধবী হলেও আমার সাথে পরিচয় হল এই প্রথম। তাও আবার রাঙ্গামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা বরকলে এসে।
মজার ব্যাপার হল প্রথম দেখাতেই আপু আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আদর সোহাগ দিয়ে মাতিয়ে রেখেছেন। সারাক্ষণ। আমি যেন তার শত জনমের চেনা ছোট্ট ভাইটি।
নাস্তা সেরে আস্তে আস্তে জানালা খুললাম। বাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। ঠান্ডা কনকনে বাতাস বইছে। একে তো চারদিকে পাহাড় তার উপর আবার ডিসেম্বরের ভরা শীত মৌসুম। সব মিলিয়ে জমে যাবার মত অবস্থা। গত দুই দিন দুপুর বারটার আগে সূর্য দেখিনি। আজও সূর্য মামাকে সহজে দেখা যাবে বলে মনে হয় না। সাদা কুয়াশা দেখতে দেখতেই আবার মনে পড়ে গেল রাতে বকা খাওয়ার কথা। না, বড় আপাকে আজ কিছুটা শাস্তি দিতেই হবে।
কিন্তু কি ভাবে? হ্যাঁ, উপায় একটা আছে। তাঁর সাথে আজ কোথাও বেড়াতে যাব না। আজ সময় কাটাব অন্য ভাবে। তাই বলে একা তো আর সারা দিনে ঘুরে বেড়ানো যায় না। একজন সঙ্গীর দরকার। এটা মনে হতেই মানসীর খুঁজে বেরিয়ে পড়লাম। মানসী হচ্ছে লক্ষী আপুর মেয়ে। এবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠবে। কথা ও কাজে খুবই পাকা। আশপাশের সব এলাকাও সে চিনে। প্রথম দিন অবশ্য আমার কাছেও আসতে চায়নি। চুইংগাম আর চকলেট বরাদ্দ করার পর থেকে সে সমস্যা কেটে গেছে। এখন মাঝে মধ্যে যোগান দিলেই চলে। তাই পকেটে চকলেট আর চুইংগাম নিয়মিতই রাখতে হয়।
না, এই শীতের মধ্যেও মানসীকে তার বিছানায় পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে গেলাম তিন তলার ছাদে।
ঐ তো, পানির ট্যাংকের পাশে বসে কার সাতে যেন খেলা করছে। কুয়াশার জন্য ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।
মানসী, কার সাথে খেলা করছ?
শ্যামার সাথে।
কী খেলছ?
বাঘ-বন্ধি খেলছি।
এটা আবার কেমন খেলা? ওমা! তুমি এটাও জাননা! এই যে দেখ, তিনটা ছাগল আর একটা বাঘ দিয়ে এইভাবে খেলতে হয়।---
মানসী আমাকে খেলা বুঝাচ্ছে। আর আমি তাকিয়ে আছি তার খেলার সাথী পাহাড়ি মেয়েটির মুখের দিকে। শ্যামা, মানসীরই সমবয়সী। মুখচ্ছবিতে মায়া-মমতায় ভরা এক অপূর্ব দৃশ্য খেলা করছে। যে সব শিশুকে প্রথম বার দেখেই একটু ছুঁয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে এও ঠিক সেই রকম। নিজের অজান্তেই পকেট থেকে চকলেট বের করলাম। প্রথম দিলাম শ্যামাকে। একটু ইতস্ততা করল। কিন্তু মানসী পরিচয় করিয়ে দিলে স্বাভাবিক ভাবেই নিল।
এই শ্যামা, এটাই তো আমার মামা। তোকে কালকে না বললাম। চকলেট গুলো নিয়ে নে না। না নিলে মামা কিন্তু রাগ করবে।
চকলেট পেয়েই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠল শ্যামার স্নেহময় ছোট্ট মুখখানা। এর পর দুই বান্ধবী মিলে আমাকে খেলার নিয়ম কানুন শিখাতে শুরু করল।
কিছুণ পর লক্ষী আপু ছাদে এলেন কাপড় শুকাতে। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, শ্যামার মা আপুদের সাথে একই অফিসে চাকরি করতেন। তিন মাস আগে মারা গেছেন ম্যালিরিয়া রোগে। ওর বাবা আবার বিয়ে করেছে। নতুন মা শ্যামাকে দেখতে পারে না। তাই বাবা তার নতুন মাকে নিয়ে অন্যখানে থাকে। আর শ্যামা থাকে তার দাদীর সাথে। আপুদের নীচ তলার বাসায়। সরকারী বাসাটি তার মায়ের নামে বরাদ্দ ছিল। এখানে হয়ত আর বেশি দিন থাকতে পারবে না। শ্যামা খুবই শান্ত মিষ্ট মেয়ে। পড়া-শুনাতেও ভাল। আগে দেখতে শুনতে আরো ভাল ছিল। মা মারা যাওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। অনেক সময় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দেয়। একা বসে বসে কান্না কাটি করে। দাদীও খুব বয়স্ক তাই সব কিছু ঠিকমত দেখা শুনা করতে পারে না। ---
আপুর মুখ থেকে শ্যামা চাকমার করুণ কাহিনী শুনতে শুনতে দু'চোখ বেয়ে কখন যে অশ্রু নেমে এসেছে তা বুঝতেই পারিনি। ভাবছি, সৃষ্টিকর্তা এই অবুঝ শিশুর মনে এতগুলো দুঃখ দিলেন কিভাবে। আর এই ছোট্ট প্রাণে কষ্টগুলো কেমন করেই বা সইছে। এক হাতে নিজের চোখ মুছলাম আর অন্য হাত চালিয়ে দিলাম শ্যামার মাথা ভরা ঘন কালো চুলের মধ্যে। আস্তে আস্তে এলোমেলা করে দিলাম সমস্ত চুল।
না, সে একটুও প্রতিবাদ করল না। বরং আরো ঘনিষ্ট হয়ে বসল আমার পাশে। মমতা মাখা মুখটা কাছে টেনে চিবুক ছুঁয়ে একটু আদর করে দিলাম। মুখ তুলে চাইল। কি বুঝল সেই জানে। তারপর থেকে সারাদিন লেগে রইল আমার সাথে। দুপুরে গোসল করতে গিয়ে দেখি মানসীর সাথে জামা-কাপড় নিয়ে শ্যামাও হাজির। খাবার খেতে বসলাম একই সাথে। ওর মাছের কাঁটা গুলোও বেছে দিতে হল আমাকেই।
আজ বেড়ানোর শেষ দিন। আপুরা দুই বান্ধবী আর কয়েকজন প্রতিবেশীসহ বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছি। অভিমান কেটে গেছে কখন ঠিক মনে নেই। বাসা থেকে বের হতেই দেখি টুকটুকে লাল জমা পড়ে শ্যামা দাঁড়িয়ে আছে। সেও যাবে আমাদের সাথে। আমি বললাম, দাদী তো তোমাকে খুঁজবেন।
সে বলল,তুমি একটু দাঁড়াও। আমি দাদীকে বলে আসছি, বলেই এক দৌড়ে বাসায় গেল। আবার কয়েক সেকেন্ড পরেই ফিরে এসে বলল, বলে এসেছি।
একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। সেও পরম নির্ভরতায় হাতটা ধরে হাঁটতে লাগল। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে অবস্থিত বরকল সদরের পরিধি খুব বেশি নয়। তবে যে দিকেই যাই শুধু সিঁড়ি আর সিঁড়ি। বরকল কোন দিন শহর হিসেবে পরিচিত হলে মনে হয় বিখ্যাত হবে সিঁড়ির শহর হিসেবেই। পাহাড়ের ঢালুতে বিভিন্ন অফিস আর বাড়ি-ঘর হওয়ার কারণে যোগাযোগের জন্য পাকা সিঁড়ির কোন বিকল্পও নেই। অন্য কোথাও হলে হয়ত আমার গুণে দেখতাম সিঁড়িতে কয়টা ধাপ আছে। কিন্তু এখানে গুণলে গুণতে হবে কোন পথে কয়টা সিঁড়ি আছে। লক্ষী আপুর বাসাতে উঠতে হলেও তিনটি সিঁড়ির মোট দুইশত সাতষট্টিটি ধাপ পার হতে হয়।
ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আপুর পরিচিতি বেশ কিছু বাসাতেও গেলাম। যে খোনেই যাই চা-নাস্তা, মিষ্টি কিংবা পিঠা কিছু একটা খেতেই হয়। খেতে খেতে কোন সময় কিছুটা তুলে দেই শ্যামার প্লেটে, আবার মাঝে মধ্যে সেও তুলে দেয় আমার প্লেটে। ঘুরতে ঘুরতেই অন্ধকার হয়ে এলো। তবু ফিরতে পারছি না। আরো কয়েকজন অপেক্ষা করছে অতিথিদের নিজের বাসায় নিয়ে যেতে। সবাইকে ফিরিয়ে দেয়াও সম্ভব হল না।
টর্চ লাইটের ব্যবস্থা হল। লাইটের আলোয় পাহাড়ি পথে ঘুরে বেড়ালাম আরো ঘন্টাখানিক। তবে যেখানেই গিয়েছি শ্যামার ছোট্ট একটি হাত খেলা করেছে আমার হাতে। অথবা আমার হাত খেলা করেছে তার হাতে। তাই সময় কখন কিভাবে গেছে বুঝতেই পারিনি। যখন বাসায় ফিরছি তখন অন্ধকার আর কুয়াশা মিলে একাকার। লাইটের আলোতেও পথ-ঘাট ভাল দেখা যায় না।
বাসায় ফিরে টিভি দেখা আর রাতের খাবার খেয়েছি একই সাথে। এর পরও শ্যামা বাসায় যেতে চাচ্ছে না। দাদীমা দু'বার এসে ডেকে গেছেন। ও শুধু বলেছে, আসছি তো।
রাত দশটা বেজে গেছে। এত রাত এই পাহাড়ি অঞ্চলে কেউ জেগে থাকে না। তাই নিজেই ওকে নিয়ে গেলাম দাদীমার কাছে। বললাম, কাল সকালে তো আমি চলে যাব। তুমি ভালো থেকো। দাদীমার কথা শুনিও তাহলে ওনি তোমাকে অনেক আদর করবেন।
ভাবলাম সকালে যখন লঞ্চে ওঠব তখন তো কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা থাকবে। শীতের মধ্যে সে হয়ত ঘুম থেকেই ওঠবে না। তাই আর দেখাও হবে না। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। সকাল বেলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যখন নামছি তখন দেখলাম নীচ তলার সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামা। কম্বল গায়ে দিয়েও শীতে কাঁপছে । পাশ থেকে দাদীমা ওকে ধরে রেখেছে।
আমাকে দেখেই দাদীমা বলল, বাবু, ওতো আটটার আগে ঘুম থেকেই ওঠতে চায়না। অথচ আজ ওঠেছে সেই ভোর বেলা। ওঠেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে দেখবে বলে। না, আমি কিছুই বললাম না। এগিয়ে গেলাম তার দিকে। আল্তো করে দুই ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিলাম কপাল। ততক্ষণে তার ছোট্ট দুটি হাত জড়িয়ে ধরেছে আমাকেও। একটু যেন কাছে টানছে। নীচু হতেই আদরে আদরে ভরিয়ে দিল আমার কপাল আর আমার সারা মুখ। প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করলাম নিজেও। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে শিথিল করে দিল হাতের বাঁধন।
বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে উঠল। হারিয়ে গেছে কথা বলার শক্তিও । তাই কিছু না বলেই ছুটলাম কুয়াশা ঢাকা পথের দিকে। পেছন থেকে শুনলাম, শ্যামার মুখ থেকে শেষ কথা ,
তুমি-আবার-এসো।
ফিরে তাকালাম। না, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পর্দা টেনে দিয়েছে ঘন কুয়াশার চাদর। চোখ দু'টিও কেন জানি হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে সেই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি ঠিকই।
তুমি-আবার-এসো। তুমি--আবার--এসো।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




