somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা, তুমি কেন আমাকে তোমার ক্ষিধের গল্প শোনালে?

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছি, নানা প্রকারের খাবার টেবিলে, বেশ ক্ষিধে পেয়েছে... কিন্তু আমি মুখে খাবার দিতে পারছিনা, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। না, আমি এখন আর খেতে পারবোনা, আমার মায়ের মুখটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে।মা তুমি কেন আমাকে তোমার ক্ষিধের গল্প শোনালে? খেতে বসলেই আমার ক্ষিধে মরে যায়, আমি আর খেতে পারিনা । পেটে প্রচন্ড ক্ষিধে নিয়ে আমি খাবার টেবিলে বসে থাকি...

আজ মায়ের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক, পৃথিবীটাকে আজ স্বর্গের মতো মনে হচ্ছে। এ রকম একটি দিন যেন তার আজন্মের স্বপ্ন, কত যুগের লালিত কল্পনা শত সহস্র রুপে আজ যেন বাস্তব হয়ে উঠছে, সুখ..... শুধুই সুখ।তার সব ছেলেরা, ছেলের বউরা, নাতি-পুতি সবাই বাড়ীতে এসেছে। সরগরম পুরো বাড়ী।কোরবানীর ঈদ আজ, কোরবানীর গরু নিয়ে ছোট ছোট নাতিদের সেকি উত্তেজনা, ষাড়টাও জানি কেমন করে একদিনেই ওদের আপনজন হয়ে গেছে, সেটার গা ঘেসে দাড়িয়ে ছবি তুলছে ৩ বছরের রামি কিন্তু কোন প্রকার ফোঁসফাস নেই। মা দেখেন , সুখ....... আহারে , মায়ের চোখ বুজে আসে।

আজ অতীতটা খুব বেশী মনে পড়ে যাচ্ছে। বড় সংসারে যা হয় আর কি, সাত ছেলে মেয়ের সংসারে নুন আনতে পানতা পুরায় , তার মধ্যে বড় ৪ টি ভার্সিটি আর কলেজে , ছোট ৩ টি স্কুলে। এদের পড়াশোনার খরচ , জামা কাপড়, আর অন্নের সংস্থান করতে বাপের ঘাম ছুটে যায়, তার মুখের দিকেই তাকানো যায়না। ঈদ যেন সেখানে একটা উৎপাত হিসেবেই আসে, নতুন জামা কাপড় কেনাটা যেখানে বিলাসিতা মনে হয় সেখানে কোরবানী যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।

ঈদ আসে, মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ে, কিভাবে কি করবেন ? "কোরবানী আত্মার শুদ্ধতা আনবে , মনের সব কালিমা দুর করবে , রক্ত মাটিতে পড়ার সাথে সাথে বেহেশতের দরজা খুলে যাবে " না, হুজুরের এই বয়ান মায়ের মনে খুব একটা রেখাপাত করেনা। তার ভাবনা জুড়ে অসহায় ছেলে মেয়ের বুভুক্ষ চোখগুলো বড় করুন হয়ে ভেসে উঠে। চাচারা কোরবানীর গরু কিনে এনেছে , কোরবানী হবে কিন্তু সাত নামের একটা হওয়ার ও যে সামর্থ তার নেই। ঈদের দিনটাকে মায়ের অনেক লম্বা মনে হয়, আশে পাশের ঘর থেকে টাটকা রান্না করা মাংসের তীব্র গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, মায়ের বমি আসে , বুকের ভেতরটা চিন চিন করে, চোখ কোন বাধা মানেনা, যেন বুকের সব কষ্ট একসাথে বের হয়ে আসে। ছোট ছেলেটার মুখের দিকে মা তাকাতে পারেননা, শাক সবজি দিয়ে ছেলেটার পাতে ভাত তুলে দেন। তার আজ মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এক টুকরো মাংস যদি ওদের পাতে দিতে পারতেন....... কিভাবে দিবেন ? তার তো সাত ছেলেমেয়ে, এক মুখ সোনা দিয়ে ভরা যায়, সাত মুখ নাকি ছাই দিয়েও ভরা যায়না- তার শাশুরী প্রায়ই খুটা দেন।চোখে বিশাল শুন্যতা নিয়ে মা বিছানায় গা এলিয়ে দেন, চোখ আর কতটা পানি ঝরাতে পারে , তার চেয়েও বেশী বুকের রক্তক্ষরন।

আম্মা দেখেনতো এই শাড়িটা আপনার পছন্দ হয় কি না? মেঝো ছেলের কথায় কিছুটা কেঁপে উঠেন মা। এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরে আসেন। তোরা কি আমাকে শাড়ী দিয়ে মুড়িয়ে ফেলবি নাকি? এক ঈদে ৪ টা শাড়ী লাগে নাকি? মায়ের কন্ঠে কৃত্তিম অভিমান।বুকের ভেতর একটা আনন্দের ঝিলিক উঠে, সব গুলি ছেলে মেয়েই মায়ের জন্য এটা সেটা নিয়ে এসেছে, সুখ....... শুধুই সুখ।

কোরবানী হয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজন, গ্রামের গরীব দুখী আর ফকির মিসকিনদের মধ্যে মা নিজ হাতে মাংস বিলি করেন, রান্না বান্নার দায়িত্ব বড় বউ এর হাতে দিয়েছেন, সারা বাড়ীতে আনন্দের হুল্লোড়, বাতাসে পোলাও আর মাংসের তরকারীর মৌ মৌ গন্ধ।সবাই খেতে বসেছে, কি সুন্দর !!! যেন স্বর্গ !!! মায়ের চোখ জুড়িয়ে যায়। সুখ........ শুধই সুখ।

সন্ধ্যা নামে, বড় দুই মেয়ে এবং তাদের জামাইরা আসে। বাড়ী ভরপুর, মায়ের বুকে আনন্দের শিহরন।

খাটে হেলান দিয়ে মা বসেন, অনেকটা রাত হয়েছে, এটা সেটা নিয়ে গল্প গুজব হচ্ছে, সবাই যেন আজ পুরনো দিনের কথামালার ঝাপি নিয়ে বসেছে, একজনের শেষ হয় তো আরেকজনের শুরু। মা শোনেন, পুরনো দিন গুলো তার চোখে ছবির মতো ভেসে উঠে। কষ্ট........ সীমাহীন কষ্ট করে তিনি ছেলে মেয়েগুলিকে মানুষ করেছেন। কত কষ্টই না করেছেন, আচ্ছা ওরা আমার কষ্টের কতটাই জানে? মনে মনেই মা নিজেকে প্রশ্ন করেন ? না, ওরা অনেক কিছুই জানে কিন্তু পুরোটা নয়।

আমি আজ তোদের একটা কথা বলবো, কোন দিন কাউকে বলিনি এমনকি তোর বাপকে ও না। সবাই কথায় মনোযোগ দেয়, আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাই, না সেখানে সুখের ছিটেফোটাও নেই।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। সেই সব দিন যেন একলাফে তার চোখে হাজির হয়.....

"আমি তোদের সবার পাতে খাবার দিতাম, চাইতাম তোদের পেট যেন ভরে। তোদের সবার খাওয়া শেষ হলেও অপেক্ষা করতাম যদি কারো আবার খেতে ইচ্ছে করে, তখন কোথা থেকে খাবার দিবো? তাই হাড়ির তলায় অবশিষ্ট কিছু ভাত সামনে নিয়ে বসে থাকতাম।" এতটুকু বলে মা থামেন, যেন পরের কথা গুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন, আমরা সবাই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, কারো মুখে কোন কথা নেই, চোখ ছলছল.....

“তার পর আমি ভাত খেতে বসতাম, সামান্য একমুটো ভাত মুখে দেওয়ার সাথে সাথে রাজ্যের সব ক্ষুধা আমার পেটে ভিড় করতো, মনে হতো পেট পুরে খাই কিন্তু হাড়ি যে খালি, ক্ষিধেয় চোখে পানি এসে যেতো"

না, মা আর বলতে পারেন না, আমি যে কাঁদতে শুরু করেছি, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, সব খাবার একসংগে পেট থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে , নিজের সমস্থ সুখ স্বপ্নকে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার মুখে আর কোন কথা ফুটেনা , কেবলি মরে যেতে ইচ্ছে করছে.......

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১০:৫৯
৩৮টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×