somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এটা সীমানাবিহীন পৃথিবীর ব্যাপার - রবার্ট ফিস্ক

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রবার্ট ফিস্ক, বরাবরই চমৎকার বিশ্লেষন করেন। সবাই যখন আলোর দিকে ছুটেন , তখণ তিনি অন্ধকারের পেছনের ঘটনা নিয়ে লিখেন। তেমনি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সংগঠন "আই এস" নিয়ে চমৎকার এই লেখাটা শেয়ার করলাম।

এটা সীমানাবিহীন পৃথিবীর ব্যাপার:

২০১৪ সালে আইএস তার অন্যতম প্রথম ভিডিওবার্তা প্রকাশ করে, এই ভিডিওটি ইউরোপের মানুষের নজরে একরকম পড়েইনি। এই ভিডিওটির মান অতটা উন্নত ছিল না, এমনকি আবহসংগীত হিসেবে ‘নাশিদ’ও সেখানে ছিল না, যেটা আইএসের পরবর্তী মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ভিডিওগুলোতে পাওয়া যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বুলডোজার ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্ত চিহ্নিতকারী বালুর দেয়ালটি ভেঙে ফেলছে। পুরো দৃশ্যটি হাতে ধরা ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল, আর সেই বালুর মধ্যে একটি পোস্টার পড়ে ছিল, যেখানে লেখা ছিল ‘সাইকস-পাইকটের শেষ’।
লাখো আরবের মতো আমি এই ভিডিওটি প্রথম দেখি বৈরুতে, এই সাইকস-পাইকট চুক্তিটি আরবের মানুষের কাছে দুষ্টক্ষতের মতো। ব্রিটিশ ও ফরাসি কূটনীতিক মার্ক সাইকস ও ফাঁসোয়া জর্জ-পাইকত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপনে এই সীমানা চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে ফ্রান্সকে সিরিয়া, মাউন্ট লেবানন ও উত্তর ইরাক দেওয়া হয়েছিল আর ব্রিটিশদের দেওয়া হয়েছিল ফিলিস্তিন, ট্রান্সজর্ডান ও ইরাকের বাকি অংশ। এ অঞ্চলের সব মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি সে কথা জানে। এই দুই কূটনীতিক ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে কৃত্রিম জাতি সৃষ্টি করেন, যেখানে সীমানা, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও পাহাড়ের মাধ্যমে পরিবার, গোত্র ও মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছিল। এটা ছিল ইেঙ্গা-ফরাসি উপনিবেশবাদের ফসল।
যেদিন এই ভিডিওটি দেখেছিলাম, সে রাতেই আমি লেবাননের দ্রুজ নেতা ওয়ালিদ জামব্লাতের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমার উদ্দেশে গর্জন করে বলেন, ‘সাইকস-পাইকটের শেষ’। আমি কিছুটা অধৈর্য হয়ে ফোঁস ফোঁস করলাম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেল, জামব্লাতের কথাই সত্য হলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন, লাখ লাখ আরব ১০০ বছর ধরে যেটা প্রত্যাশা করছিল, আইএস সেটা প্রতীকীভাবে দ্রুতই করে ফেলেছিল: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি ব্রিটিশ ও ফরাসিরা যে মিথ্যা সীমান্ত দিয়ে আরবদের বিভক্ত করেছিল, সেই সীমান্ত গুঁড়িয়ে দেওয়া।
আমরা চালাকি করে আরবদের ওপর রাজা গছিয়ে দিয়েছিলাম, ১৯২২ সালে ইরাকের হাশেমি রাজা ফয়সালের পক্ষে গণভোট করে তাঁকে ৯৬ শতাংশ ভোট পাইয়ে দিয়েছিলাম। আমরা আরবদের জেনারেল ও একনায়ক উপহার দিয়েছি। ব্রিটিশরা ১৯ শতকে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসর দখল করেছিল, পরবর্তীকালে যাদের ভাগ্যে মিথ্যাবাদী সরকার, পাশবিক পুলিশ বাহিনী, মিথ্যুক সংবাদপত্র ও ভুয়া নির্বাচন জুটেছিল। মোবারকও ফয়সালের মতো মহাকাব্যিক ৯৬ শতাংশ সমর্থন পেয়েছিলেন। আরবদের কাছে গণতন্ত্র মানে বাক্স্বাধীনতা বা নিজের নেতা নির্বাচন করার অধিকার ছিল না, তার মানে ছিল ‘গণতান্ত্রিক’ পশ্চিমা সরকারগুলোর আরব একনায়কদের সমর্থন দেওয়া, যারা তাদের নিপীড়ন করেছে।
ফলে ২০১১ সালে আরবে যে বিপ্লবের হাওয়া বইতে শুরু করে, সেখানে কিন্তু তারা গণতন্ত্রের দাবি তোলেনি, ‘আরব বসন্তের’ কথা ভুলে যান, সেটা ছিল হলিউডের সৃষ্টি। কায়রো, তিউনিস, দামেস্ক ও ইয়েমেনের রাস্তায় যেসব পোস্টার দেখা গেছে, সেখানে মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের কথাই ছিল, যে দুটি বস্তু আমরা নিশ্চিতভাবে আরবদের জন্য খুঁজিনি।
আমি নিজের প্রতিবেদনেও এই উপলব্ধির কারণ হিসেবে বলেছিলাম, আরবদের শিক্ষার হার ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ভ্রমণ বেড়েছে। আর ইন্টারনেট ও সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকা স্বীকার করে বলেছিলাম, এর গভীরে কোনো না–কোনো একটা ব্যাপার কাজ করছে। আরবেরা গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, তারা আর নিজেদের নাসের, সাদাত, মোবারক, আসাদ, গাদ্দাফি ও সাদ্দামের মতো পিতৃতান্ত্রিক নেতার সন্তান হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং মনে করে সরকার তাদের মতো সন্তানদের নিয়েই গঠিত হয়। আরবেরা তাদের বাসস্থানের মালিকানা চেয়েছে।
কিন্তু এখন মনে হয়, আমি কতটা ভুল ছিলাম। আমি এই বিপ্লবের বার্তা অনুধাবন করতে মারাত্মক ভুল করেছিলাম। আমি এখন বিশ্বাস করি, ২০১১ সালে আসলে এটাই উদ্ভাসিত হয়েছে যে আমরা পশ্চিমারা ১০০ বছর আগে এই মানুষের জন্য যে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম, সেটা মূল্যহীন। যে কৃত্রিম জাতি ও ততোধিক কৃত্রিম সীমান্তের ওপর আমরা রাষ্ট্র আরোপ করেছিলাম, তা অর্থহীন ছিল। অর্থাৎ তাদের ওপর আমরা যা গছিয়ে দিয়েছিলাম, তারা সেটার পুরোটাই খারিজ করে দিয়েছে।
গাজার হামাস ও ব্রাদারহুড এক হয়ে গেছে, সিনাই-গাজা সীমান্ত ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ওদিকে লিবিয়ার পতনের কারণে গাদ্দাফির আগের সীমান্ত খুলে গেছে, যেটা এখন অস্তিত্বহীন। গাদ্দাফির অস্ত্রগুলো এখন মিসর ও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে বিক্রি হচ্ছে, রাসায়নিক শেলসহ। তিউনিসিয়া ‘গণতন্ত্রের’ প্রতি আসক্ত হওয়ায় সে এখন পশ্চিমের প্রিয় পাত্র, কিন্তু লিবিয়া ও আলজেরিয়ার সঙ্গে তার যে সীমান্ত আছে, সেটা ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র সরবরাহের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় দেশটি বিপদে পড়েছে। আইএস সীমানাবিহীন ভূমি দখলে আনতে পেরেছে, যার মানে হচ্ছে, সে তার অন্তর্দেশীয় অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে: ইরাক হয়ে সিরিয়ার আলেপ্পোর প্রান্ত, ওদিকে নাইজেরিয়া থেকে নাইজার ও চাদ।
আইএস এই নতুন ব্যাপারটা আমাদের আগেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আধুনিক যুগে সীমান্ত নিরাপত্তাহীন—আইএসের এই উপলব্ধি আর আরবদের স্বসৃষ্ট জাতির অসারতা-বিষয়ক উপলব্ধি কিন্তু যুগপৎভাবে একই সময়ে হয়েছে। আমরা ইসরায়েলকে সমর্থন দিই, কিন্তু এটা স্বীকার করি না যে দেশটির পূর্ব সীমান্ত আরব বিশ্বের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে, তবে আমাদের স্বার্থের সঙ্গে মিলে গেলে আমরা তা স্বীকার করি। সর্বোপরি আমরাই তো ‘বালুতে রেখা’ বা ‘লাল রেখা’ আঁকার সুযোগ পেয়েছি। আমরা ইউরোপীয়রাই সিদ্ধান্ত নিই, সভ্যতা কোথায় শুরু হয়, আর কোথায় গিয়ে শেষ হয়।
হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নেন, ‘খ্রিষ্টান সভ্যতা রক্ষা’ করতে তিনি কোথায় সেনাবাহিনী নামাবেন। হ্যাঁ, আমাদের পশ্চিমাদেরই তো সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার চারিত্রিক সাধুতা আছে, মধ্যপ্রাচ্যের জাতীয় সীমানা মানা হবে কি হবে না।
কিন্তু যখন আরবেরাই ঠিক করেছে যে তারা আর এই নাচ নাচবে না এবং ‘আমাদের’ ভূমিতেই নিজ ভবিষ্যৎ খুঁজে নেবে, ‘তাদের ভূমিতে’ নয়, তখন এই নীতি ভেঙে পড়ে। এটা সত্যিই কেমন অনন্যসাধারণ বিষয় যে আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই, আধুনিক যুগের সীমান্ত ভঙ্গকারী ব্যক্তি কিন্তু একজন ইউরোপীয়, যিনি ইউরোপের ইহুদিদের নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। হিটলার নিজের আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্প–এ মুসলমানদের সম্পর্কে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তাঁর হত্যাযজ্ঞ আরবেও সম্প্রসারিত হয়েছে।
আমরা সব সময় ঘোষণা করছি, আমরা ‘যুদ্ধে লিপ্ত’ হয়েছি। বলা হচ্ছে, আমাদের নির্দয় হতে হবে। আমাদের তাদের ভূখণ্ড আক্রমণ করতে হবে, তা না হলে তারা আমাদের ভূখণ্ড আক্রমণ করবে। কিন্তু সেই দিন আর নেই যে আমরা অন্যের দেশ আক্রমণ করে নিজ দেশে নিরাপদ থাকতে পারব। নিউইয়র্ক, প্যারিস, মাদ্রিদ, লন্ডন ও ওয়াশিংটনে হামলার ঘটনা আমাদের সে কথাই জানান দেয়। আমরা যদি ন্যায়বিচারের জন্য কণ্ঠ ছাড়ি, অর্থাৎ হন্তারকদের বিচার-প্রক্রিয়া ও আদালতের মুখোমুখি করি, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের রাজদণ্ডধারী মহাদেশে নিরাপদ থাকতে পারব। না, শুধু নিজের ও শত্রুর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই চলবে না, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্যও তা নিশ্চিত করতে হবে, যারা এক শতাব্দী ধরে আমাদের সৃষ্ট একনায়কতন্ত্র ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়ে যারপরনাই ভুগেছে, যার কারণে আইএসের উত্থান হয়েছে।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

সংক্ষেপিত অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৯
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×