somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দীন মোহাম্মদের সফরনামা: ইংরেজি ভাষায় ভারতীয়দের প্রথম বই

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে দীন মোহাম্মদের সফরনামা সবার অলক্ষ্যে থেকে গেছে: কিছুটা অবহেলায়, আর কিছুটা অসচেতনতায়। দীন মোহাম্মদ (১৭৫৯-১৮৫১) এর সফরনামা-ই কোন ভারতীয়র ইংরেজি ভাষায় লিখিত প্রথম বই। বইটির প্রকাশকাল ১৭৯৩-’৯৪, প্রকাশস্থল আয়ারল্যান্ড। এই সফরনামার ইংরেজি শিরনাম হলো The Travels of Dean Mahomet, A Native of Patna in Bengal, Through Several Parts of India, While in the Service of The Honourable The East India Company Written by Himself, In a Series of Letters to a Friend এবং এটি ইউরোপীয় সাহিত্যের পত্রোপন্যাস ধারায় বন্ধুর কাছে লেখা চিঠির আকারে বই হিসাবে প্রকাশ করা হয়। উত্তর ভারতের পাটনায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া দীন মোহাম্মদের এই আত্মজীবনীমূলক সফরনামার বিবরণ শুরু হয় ১৭৬৯ সালে, শৈশবে বাবাকে হারানোর পর মায়ের কাছ থেকে তার বিচ্ছেদের ঘটনার মধ্য দিয়ে। সফর বর্ণনা শেষ হয় ১৭৮৪ সালে ঔপনিবেশিক আয়ারল্যান্ডে দেশান্তরি হওয়ার মাধ্যমে। এই সফরনামায় আমরা দেখি, দীন মোহাম্মদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক চাকুরিতে থাকাকালীন নিজ দেশে কোম্পানির বিজয় অভিযানের অংশিদার হয়ে পশ্চিমে দিল্লি আর পূর্বে ঢাকা পর্যন্ত ঘোরাফিরার সুযোগ পেয়েছেন। এসব অভিযানের সময় সাক্ষাত হওয়া মানুষ আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায় তার সফরনামায়।

দীন মোহাম্মদ অষ্টাদশ শতাব্দির টালমাটাল ভারতে ২৫ বছর পার করেন, তারপর আয়ারল্যান্ডে পাড়ি জমান। একদিকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সাংস্কৃতিক ছোঁয়া, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরির প্রতি আনুগত্য, এই দুইয়ে মিলে দীন মোহাম্মদ নিজেই ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে পড়েছেন। বাবার অকাল মৃত্যুতে দীন মোহাম্মদ মাত্র ১১ বছর বয়সে নিজ ভবিষ্যত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ১৭৬৯ সালে তিনি গডফ্রে ইভান বেকার নামের এক প্রোটেস্ট্যান্ট অ্যাংলো অফিসারের ক্যাম্প ফলোয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮ বছর পরে বেকারের মৃত্যু পর্যন্ত এই দু’ব্যক্তি সর্বত্র একসঙ্গে চলে ফিরেছেন। ১৭৬৯ - ৮৩ সময়কালে বেকার সাধারণ ক্যাডেট থেকে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উন্নীত হন, সেসঙ্গে দীন মোহাম্মদও সাবঅলটার্ন অফিসারের পদে উন্নীত হন। এই পুরোটা সময় দীন মোহাম্মদ তার আত্মীয় স্বজনের মাঝে সম্মানী অতিথি হিসেবে মর্যাদা পেলেও ইংরেজদের সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করার কারণে আত্মীয়দের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠেনি। এমনকি কখনো কোন ভারতীয় তাকে অপমান করেছে, আবার অন্য কোন ভারতীয় তাকে রক্ষা করেছে।

সেসময়ের ইংরেজভাষী ইউরোপীয়দের পক্ষে একথা মেনে নেয়া কঠিন ছিল যে ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে থাকা একজন ভারতীয়র পক্ষে এমন একটি বই ইংরেজিতে লেখা সম্ভব। এই সফরনামা-র চেয়ে বেশ নিম্নমানের বইপুস্তকও তখন আয়ারল্যান্ডে বিভিন্ন পর্যালোচকদের সুদৃষ্টি পেত। হয়ত এ কারণেই বইটি প্রায় দুশ বছর তেমন কোন আলোচনা সমালোচনা ছাড়াই চাপা পড়ে ছিল। তবে ভারতীয়দের জন্য দীন মোহাম্মদ যে একজন বীর সে কথা বলাটা বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি যেমন ভারতীয়দের ভাল দিক দেখিয়েছেন, অসংস্কৃত দিকও তুলে ধরেছেন, তেমনি ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের প্রতি আনুগত্যও অস্বীকার করেননি। বইটি তিনি বেঙ্গল আর্মির ইংরেজ কোম্পানির কর্ণেল, উইলিয়ম এ. বেইলিকে উৎসর্গ করেন। আয়ারল্যান্ডে গিয়ে মুসলিম পরিবারের দীন মোহাম্মদ বিয়ে করেন খ্রিস্টান নারী। পরবর্তী জীবনকালে দীন মোহাম্মদ তার নিজ সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মর কতটুকু নিজ পরিবারে অব্যাহত রেখেছিলেন, সে বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে।

মাইকেল এইচ. ফিশার এর সম্পাদনায় ক্যালিফোর্ণিয়া ইউভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত The Travels of Dean Mahomet- An Eighteenth-Century Journey through India এবং সে বইয়েরই বর্ধিত সংস্করণ ১৯৯৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত Dean Mahomet: The First Indian Author in English: Dean Mahomet in India, Ireland and England একাডেমিক মহলে দীন মোহাম্মদের সফরনামাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই সফরনামা থেকে জানার, গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন ইউনিট সম্বন্ধে জানতে পারি, বইটিতে তাদের অবকাঠামোও তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন শহরের বর্ণনা পায় এখানে। হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মিশেল দেখতে পাই, যখন বলা হয়, মুসলমান শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠানের ৪টি ধাপের প্রথমটি সম্পন্ন করা হতো ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে। কিভাবে সম্ভ্রান্ত নবাবি মুসলিম সমাজ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এলো, দীন মোহাম্মদ সে ব্যাখ্যাও দেন। সে সময়ের দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্রও সফরনামায় আছে। কলকাতা আর ঢাকার প্রাচুর্যের কথাও দীন মোহাম্মদ বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনা কতটুকু সত্য, কতটুকু রঙ চড়ানো, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন গবেষকের। এরপরও মূল কথাটি হলো, দীন মোহাম্মদের সফরনামা সেই বই যেটি লেখা হয়েছে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় পাঠকের জন্য, কিন্তু এর লেখক উপনিবেশের যাঁতাকলে পিষ্ট এক ভারতীয় যাকে নিজ জীবনে নিজ ঐতিহ্য-সংস্কার ও ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে এক জটিল বোঝাপড়া করতে হয়েছে।

আগামীতে এখানে সফরনামার ৩৮টি পত্রের মধ্যে আপাতত পত্র ১, ২, ৩, ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ এর অনুবাদ তুলে ধরা হবে। এই ক’টির অনুবাদ সোনারদেশ ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×