গ্রন্থ পর্যালোচনা
‘তবুও বৃষ্টি আসুক’
--এম,এ মান্নান রিপন
কবি শফিকুল ইসলাম আধূনিক সাহিত্যেও একজন বিদগ্ধ ও প্রসিদ্ধ কবি । কাব্যগ্রন্থের উৎকর্ষতা যাচাইয়ের মাপকাঠি যদি হয় সাহিত্য তাহলে “তবুও বৃষ্টি আসুক” কাব্যগ্রন্থটি চরম উৎকর্ষতার প্রতিফলন । কাব্য পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ খুবই দূরহ কাজ । কারন কবির প্রতিটি সৃষ্টি কর্মেও প্রতিরূপ কবিতায় ফুটে উঠে যা থেকে বুঝা যায় কবির দর্শন,চিন্তা,চেতনা ও জীবনধারা । শুধু তাই নয়, কবির এই সৃষ্টির মধ্যে স্থান পায় ব্যক্তি ,সমাজ,রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক দর্শন । কবি শফিকুল ইসলাম এর তবুও বৃষ্টি আসুক কাব্যগ্রন্থটি এমনই এক ধরণের কাব্যগ্রন্থ যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রেম,ভালবাসা,মানবতা,শান্তি । পাশাপাশি কামনা করা হয়েছে বৈষম্যবিহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা। যা নাকি মার্কস,লেলিন,সার্ত্রের দর্শনও ছিল। আজ ও অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচেছন যাহার জন্য বহুযুগব্যাপী কারারুদ্ধ ছিলেন । কবি লিখেছেনঃ--
“তবুও বৃষ্টি আসুক
ইথিওপিয়ায়,সুদানে
খরা কবলিত,দুর্ভি পীড়িত
দুর্ভাগ্য জর্জরিত আফ্রিকায়-
সবুজ ফসল সম্ভারে ছেয়ে যাক
আফ্রিকার উদার বিরান প্রান্তর।’”
(বহুদিন পর আজ )
কবির এই প্রতিকী বৃষ্টি কি, সাম্য,শান্তি নাকি প্রেম ? যা দিয়ে কবি এক ভাবী সুন্দর পৃখিবীর ছবি একেছেন । এ স্বপ্ন তো নজরুল সুকান্ত ও দেখেছেন। এখানে কবি শফিকুল ইসলাম যেন তাদেরই একজন হয়ে তাদেরই কথা বলেছেন । কিন্তু কিভাবে এ পরিবর্তন সম্ভব । কি দ্বারা এই সমাজ,রাষ্ট্র ও বিশ্বের পরিবর্তন করা যাবে ? অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো যে, কাল মার্কস,লেলিন,মাওসেতুং এর মত সমাজ চিন্তাবিদরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য অর্থকে নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শফিকুল ইসলাম এক্ষেত্রে প্রতীকি বৃষ্টি নামুক প্রেমকে ব্যববহার করেছেন । তাদের সাথে এখানেই কবির পার্থক্য । তাইতো কবির লেখায় ফুটে উঠেঃ--
“তারও আগে বৃষ্টি আসুক
আমাদের বিবেকের মরুভূমিতে,
সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক,
আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা,হৃদয়ের গ্লানি।
মানুষের জন্য মানুষের মমতা
ঝর্ণাধারা হয়ে যাক...”
(বহুদিন পর আজ )
“তবুও বৃষ্টি আসুক” কাব্যগ্রন্থে কবির প্রেম এক পর্যায়ে এসে ধরা দেয় তার ভালবাসা ,ভালবাসা মানবীর কাছে । যাকে কবি ভালবেসে হৃদয়, মন উজার করে দিয়েছেন। যার স্পর্শ কবিকে ভীষণ পীড়া থেকে আরোগ্য দানে সহায়তা করে । কবি সারা জীবন অসুস্থ থাকতে চান কিন্তু প্রিয়ার সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকতে চান না । তাইতো প্রেমার্ত কবি বলেনঃ--
“সুলতা আমাকে তোমার
আঁচল তলে লুকিয়ে ফেলো,
তোমার কোমল বুকের উম দাও,
দেখো পথ্যবিহীন কেমন দ্রুত
আমি নিরাময় হয়ে উঠি।”
(সুলতা বহুদিন পর আজ )
কে এই সুলতা? যে সুলতা আজ কবির জীবনে অবিচেছদ্য অংশ হয়ে আছে । যে সুলতাকে ভালবেসে কবি মন,প্রাণ উৎসর্গ,করেছেন সে সুলতা কেন কবিকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আজ কবির জীবনে স্মৃতি হয়ে আছেন । প্রশ্নগুলোর উত্তর একের পর এক ধরা দেয় ‘তবু ও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থে । যাকে প্রেমিক কবি প্রেম নিবেদন করেছেন। কবির প্রেম থাকে কাব্যে ,কবিতায় সাহিত্যেও কল্পনায় । যেমন প্রেমিক ছিলেন কবি নজরুল,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও (কাদম্বনী ভিক্টোরিয়া)। ফরাসী সাহিত্যেও এক উল্লেখযোগ্য কবি বোদলেয়ারের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। তার জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাবো এমনই এক প্রেম । কিন্তু তাদের প্রেম তাদেরকে বিখ্যাত করেনি। করেছে প্রেমের ফসল,কবিতা কাব্য,সাহিত্য ।
কবি শফিকুল ইসলাম তেমনই এক মানবীকে ভালবেসেছেন । যার ভালবাসা কবির প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে । রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের সময় যেমন ‘বনলতা সেনের’ কাছে ধরা দেয় কবির সময়ও ধরা দেয় ‘সুলতা’ নামক এই মানবীর কাছে ।
“প্রিয়তমা বল কী করে
আমি তোমার প্রসঙ্গ পাল্টাই-
তুমি যে আমার প্রিয় প্রসঙ্গ
তোমাকে বাদ দিলে আমার আর থাকে কি?
-----------------------------
মন্দিরে যখন পূঁজো দিতে যাই
মন্দিরের বিগ্রহ কখন
তোমার আদলে পাল্টে যায়
টের পাইনা,
আর আমি তোমাকে
পূঁজো দিয়ে চলে আসি।”
(প্রিয়তমা বল কি করে )
কবি যাকে এমন যত্ন করে ভালবেসেছেন সে কবিকে সুখ দেয়নি । দিয়েছে দুঃখ আর দুঃখ। অপূরনীয় তিসাধন করেছে তাঁর । যে তি “তিনটি তি” কবিতায় কবি উল্লেখ করেছেন । এখানে কবির জীবনের সবচেয়ে বড় তিটির কথা বলেনঃ--
“আজ যৌবনে এসে
তোমাকে হারানোর তি যেন
কিছুতেই ভূলা যায়না।”
যা স্থায়ী তচিহ্ন হয়ে জেগে থাকে কবির বুকের মাঝখানে । এই ত চিহ্ন এক সময় ব্যাধি হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে । যা কবির দেহঘড়িকে থামিয়ে দেয় । কবি লিখেনঃ--
“অথচ আজ নষ্ট ঘড়ির বন্ধ কাটার মত
এক জায়গায় এসে
আমার হৃদয় স্পন্দন থেমে গেছে
ব্যস্ত জীবনের মাঝে
তোমারই বিরহে।”
(ক’দিন থেকে বুকের মধ্যিখানে )
যে সুলতা কবির জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে । যার জন্য কবি নিঃশেষ হচেছন পরিত্যক্ত জ্বলন্ত সিগারেটের অবশিষ্টাংশের মতো। সে সুলতা কবিকে দুঃখ কষ্ট দিলে ও কবি তাকে ভালবাসেন সব সময় এবং সব সময়ই তার প্রতি কবির ভালবাসা থাকবে বলে জানান । কবি প্রিয়া বিরহে বলেনঃ--
“যেখানেই যাও বন্ধু
কাছে কিংবা দূরে
আমি আকাশের মতো তোমায়
ছায়া দিয়ে রাখব।
চৈত্রের দাবদাহে
যখন তোমার শীর্ণ জলের স্রোতস্বিনী ও
শুকিয়ে যাবে মিলিয়ে
সেদিন ও আমি বুকভরা জল নিয়ে
তোমায় সাগর সংগমে আহ্বান জানাব।
যেদিন তুমি আমায় আর ভালবাসবেনা
সেদিন ও আমি তোমায় ভালবাসবো।”
(যেখানেই যাও বন্ধু)।
আধুনিক কবিতায় কবির সকল চিন্তা,চেতনা স্বাভাবিক ভাবে ফুঁটে উঠে । কবি শফিকুল ইসলাম এর সবগুলো কবিতায় এ বৈশিষ্টে বিদ্যমান । এদিক দিয়ে কবির কবিতা আধুনিকতার দাবীদার । আমি মনে করি কবিতার উৎস কবির দতা ও বুদ্ধিমত্তা নয় । মানুষের সমগ্র সত্তাই এর মূল উৎস । শফিকুল ইসলাম এর সবগুলো কবিতাই তার বাস্তব সত্তার চিত্ররূপ । কবি তুলে ধরেছেন তার নিজস্ব সত্তা প্রেম ভালবাসা,চাওয়া-পাওয়া ও কামনা । সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টি তার কবিতায় ল্য করা গেছে, তাহল দুঃখিত চিত্তের গেয়ে যাওয়া গান ।
“তবুও বৃষ্টি আসুক”কাব্যগ্রন্থটি যেন একটি দুঃখবাদী আখ্যান। তা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব হতে পারে। অসম্ভবের কি আছে? কারন কবি তিনি তো কখনো অবিকল সামাজিক বা সাধারণ স্বভাবই হতে পারেন না । তাকে হতে হয় কোন না কোন দিক দিয়ে ব্যর্থ,অভাবগ্রস্থ ।(হোমার যেমন অন্ধ ও বাল্মীকি ও পূর্ব জীবনে ছিল দস্যু ) । যে অভাবের তি পূরণ করে দৈব অথবা অবচেতনের মতা । এদিক দিয়ে চিন্তা করলে কবি শফিকুল ইসলাম সত্যই অভাবগ্রস্থ । তাঁর অভাব তাঁর প্রিয়তমার ভালবাসার । প্রিয়া হারানোর ব্যর্থতাই যেন কবিকে আজ এ অবস্থায় রেখেছে । আর এজন্যই সম্ভব হয়েছে কবিতার মাধ্যমে তার অব্যক্ত কথাগুলো প্রিয়াকে উৎসর্গ করার । কবি লিখেনঃ--
“সুলতা আজ তুমি নেই
বিরহ ব্যথিত হৃদয়ে
কেবলই বেদনার পংক্তিমালা লিখে যাই
যদি তাতে কোনো সাত্ব—না খুঁজে পাওয়া যায়-
যদি তাতে ভূলে থাকা যায়
ক্ষণিকের জন্য হলেও
তোমাকে না পাওয়ার অন্তর্গত অন্তর্জ্বালা”
(সুলতা একদিন তুমি ছিলে তাই )
অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার প্রশ্ন করেছিলেন-“ক” বোতল টানিলে মদ “রঘুবংশ” যায়গো লিখা ? আর আমার প্রশ্ন কতটুকু দুঃখ পেলে বেদনার এই পংক্তিমালা যায় লিখা ?সত্যিই কবি খুব দুঃখবাদী । আধুনিককালের অনেক কবিই দুঃখবাদী । যার নাম ক্লাসিস্ট(যেমন ইংরেজী ভাষায় এলিয়ট,মিল্টন এবং বাংলা ভাষায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ) ।
আরেকটা বিষয় না বললে অপূর্ণ থেকে যায় কবি শফিকুল ইসলাম এর চিন্তা চেতনা,দর্শন যা তার কবিতায় ফুঁটে উঠেছে তা অনেকটাই বস্তুবাদী দর্শন চিন্তা । এ ধরনের চিন্তা চেতনা আধূনিক সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ.নজরুল,সুকান্ত ও জীবনানন্দের লেখায় দেখা যায় । কবি কবি শফিকুল ইসলাম লিখেনঃ--
“পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল
অথচ আমার জীবনে এক ভাগ স্থল নেই-
পুরো চারভাগই জল।”
(পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল )
তাছাড়া “মহাকাল সবই হরণ করে নেয়” কবিতায়ঃ--
“জীবন,যৌবন আয়ু
হৃদয়াবেগ
সকলই হারিয়ে যায়-
মহাকালের দূরন্ত স্রোতে।”
এগুলো বস্তুবাদী চিন্তা চেতনারই রূপ ।
অবশেষে যে বিষয়টি তার কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায় তাহলো হারানো ব্যর্থতার পরও সংশয়হীন এক আহ্বান । যা কবিকে দ্বন্দবিহীন পথ চলার প্রেরণা যোগায় ।“সুলতা তুমি নেই” ও “সুলতা এখনও সময় আছে ” কবিতায় তাই দেখা যায় ।
“সুলতা, এখনও সময় আছে
এখন ও ফিরে আসো এই বুকে
নইলে যে একটি হৃদয়ের হাহাকারে
এই পৃথিবী নিমিষে
একটি বিষন্ন বিচিছন্ন দ্বীপ হয়ে যাবে।”
সব মিলে দুঃখীবাদী কবির বেদনা বিদগ্ধ কাব্যগ্রন্থ “তবুও বৃষ্টি আসুক” । কাব্যপ্রেমী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে সামান্য প্রেম বিরহের ছোঁয়া ফেললে কবির লেখা সার্থক হবে বলে মনে করি। ধ্র“ব এষের প্রচছদে মোড়কিত কবির এই চতুর্থ কাব্যগ্রন্থটি বাজারে এনেছে আগামী প্রকাশনী।
আলোচিত ব্লগ
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।