পৃথিবীতে পরিবর্তণ ঘটেছে দ্রুত।এই পরিবর্তনের ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে। আওয়ামী ভাষায় “উন্নয়নের মহা সড়কে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ”। ফলে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যে ব্যাপক তারতম্য ঘটছে।
এই পরিবর্তনের হার দ্রত এবং আশংঙ্কাজনক। আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই কিসে কিসে পরিবর্তণের ছোড়া লেগেছে।
গ্রামীন কাঠামোঃ উন্নয়নের মহাসড়কে শহরের সাথে অসামঞ্জস্য তালরেখে এগিয়ে চলছে গ্রামীণ কাঠামো। 90 দশকে অজপাড়া গাঁ বলতে যা বোঝাত, তা এখন নদীর বুকে চর ছাড়া খুঁজে পাওয়া কঠিন । প্রত্যন্ত, দুর্গম এবং চরাঞ্চলের অনেক গ্রামও এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে জেলা শহরের সঙ্গে, জেলা শহর থেকে বিভাগীয় শহরের সাথে। যে গ্রামে তেলের অভাবে কুপি বাতি, হারিকেন ঠিকমত জ্বলত না সেখানে পল্লী বিদ্যুত্/ সৌর বিদ্যুতের আলো ঝলমল করে জ্বলছে। গ্রাম থেকে উঠে আসছে দেশ সেরা মেধাবীরা। যে সব গ্রামে ডাকে চিঠি, টেলিগ্রাম, মানিঅর্ডার পৌঁছাতে অনেক দিন লেগে যেতো সেই গ্রামে এখন মোবাইল ফোনের কাভারেজ, বিকাশের মাধ্যমে মুহূর্তেই প্রিয়জনের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সুযোগ, মডেমসহ ইন্টারনেট কানেকশন। ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটআ্যাপ, টেঙ্গ, ইত্যাদি ইন্টারনেট ভিত্তিক বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যমগুলো অধিক জনপ্রিয় হয়েছে। শুধু হাডুডু, নৌকাবাইচ, গোল্লাছুট প্রভূতি খেলায় এখন আর গ্রামের ছেলেরা সন্তুষ্ট নয় তারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এসে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে।কল সুন্দরের মেয়েরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। গ্রামের ছেলেরা এখন ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট/বিশ্বকাপ ফুলবলের সব খবরাখবর রাখে, সে জানে লা লিগার বার্সোলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচেরও খবরা খবর, কোলকাতা নাইডার্স বনাম ব্যাঙ্গালুর মারাত্মক ক্রিকেটের মহুর্ত। 3জি ভিত্তিক ফোনকোম্পানীর সেবা এখন গ্রাম গঞ্জে চোখে পড়ার মত। গ্রামের অনেক বাড়িতেই এখন রয়েছে ডিশ লাইনের সংযোগ। যার সুবাদে তারা ভারতীয় হিন্দি বাংলা জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের নিয়মিত দর্শক। স্টার জলসা আর জি বাংলা না দেখলে বউ পোলা, ছেলে মেয়েদের নাওয়া খাওয়া ঘুম ঠিক মতো হয় না। হালে সুলতান সলোমন কিংবা ইউসুফ জোলেখা তাদের নিকট অধিক জনপ্রিয় হয়েছে।
গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোঃ পালাবদল ঘটেছে খাদ্যের প্রাপ্যতায়, জীবনযাত্রার মানে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে। কুড়েঘরের জায়গায় এসেছে টিনের ঘর। প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা। কলেরা বসন্তের মত মহামারি বিদায় নিয়েছে। আগে যেখানে হাঁটা কিংবা নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না এখন গ্রামের মানুষ হরদম যন্ত্রচালিত বাহনে চড়ে। অনেক এলাকায় ডিস্ট্রিক ও হাইওয়ে নাইট কোচ যাতায়াত করে।ইন্ডিয়ান ও চাইনা মটর সাইকেল অবস্থানপন্ন গেরস্ত বাড়িতে দেখা যায়।
আবহমান সাংস্কৃতিঃ অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে জীবনটাকে নষ্ট করে দিতে রাজি নন বেশিরভাগ বাবা মা। বাল্য বিয়ের হার কমে গেছে উল্লেখযোগ্যহারে। আগে যেখানে গ্রামের যুবক-যুবতীরা প্রেম ভালোবাসা করত চিঠি চালাচালির মাধ্যমে এখন সেখানে ফেসবুকে চ্যাট করে। অনেকে 3জি মোবাইলের মাধ্যমে ছবি দেখে সরাসরি কথা বলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা একটি বৃহৎ অংশ দখল করে রেখেছে। বার্তা আদান প্রদানের অ্যাপসগুলো তাদের মোবাইলে হোসস্ক্রিনে থাকে।আগে যেখানে বিনোদন বিচিত্রা লুকিয়ে পড়ত তার যায়গায় এখন অনেকে অনলাইনে চটি পড়ে।ইউটিউবের হট সিনগুলো তাদের দেখা চাই।এইচডি সেক্স ভিডিওর লিঙ্কগুলো অনেকের মুখস্থ।দেশের ১4 কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহকের বড় অংশ গ্রামের মানুষ। তাদের কেউ কেউ স্কাইপ ব্যবহার করতেও শিখে গেছে। বিদেশে থাকা স্বজনরা এখন আর টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে নিজের গলার আওয়াজ পাঠায় না। গ্রামে কম শিক্ষিত অনেক তরুণ-তরুণী আজকাল নিয়মিত ফেসবুক চালায়। তাদের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে নিজের মতামত পোষ্ট করে চমকে দেয়। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক। প্রায় এক কোটি গ্রামবাসী কৃষকের আছে নিজস্ব ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। উৎসবেও এসেছে পরিবর্তন, আগে বিয়ে পার্বনে গ্রাম অঞ্চলে বিয়ে বাড়িতে মাইক বাজানো হতে সেখানে এখন তার জায়গা সাউন্ড বক্স দখল করে নিছে। দশ বছর আগেও গ্রামে একজন নাচ জানা ছেলে/মেয়ে খুজে পাওয়া যেত সেখানে এখন ডি.জে পার্টি গড়ে উঠেছে। এটা একদিনে হয়নি! দীর্ঘ দিন পথ পরিক্রমায় হঠাৎ দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে।
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতাঃ শুধু কৃষিকাজ নয়, গ্রামের মানুষ এখন বহু ধরনের পেশায় নিজেদের যুক্ত করে জীবন বদলে দিচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছে ব্যাংকের সেবা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে গ্রামের শিক্ষিত তরুণ তরুণীরাও। গ্রাম মানেই খন আর কৃষি কাজ নয়। এক দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা এখনকার মতো ততোটা চাঙ্গা ছিল না। তখন শহরের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পশ্চাত্মুখী সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছিল। বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের গা ঝাড়া মনোভাব লক্ষ্য করা যায় খুব সহজেই। বলা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নবজাগরণ এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। এতে করে উত্পাদনের পরিমাণ বেড়ে গেছে আগের তুলনায়। বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য উত্পাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণির ভাগ্য বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। কৃষি খাতে তো অবস্থা ভালোই, এমনকি কৃষির বাইরেও গ্রামীণ অর্থনীতি বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের মধ্যে এখন কৃষির পাশাপাশি ছোট ছোট শিল্প স্থাপনের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনেকে শহরে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পেরে গ্রামে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ধরণের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। তারা শুধু কৃষিজাত পণ্য উত্পাদন নয়, এর পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালন, মৎস্য চাষের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ তাদের ভাগ্য উন্নয়নে পুরোপুরি সচেষ্ট বলা যায়। আজকাল প্রায় প্রতিটি গ্রামেই হাঁস-মুরগীর খামার, দুগ্ধ উত্পাদনকারী ডেইরি ফার্ম, মৎস্য চাষ প্রকল্পের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। আগে ধান পাট শাক-সবজি শস্য উত্পাদনের মধ্যেই গ্রামের মানুষ তার কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখতেন। এখন খামার বা কৃষি প্রকল্প ভিত্তিক কাজে তারা আগ্রহী। যেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে শুরু করে শহুরে জীবনের মতো উন্নত নানা সুযোগ-সুবিধা থাকছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে গ্রামীণ জীবন-যাপনে আধুনিকতার ছাপ ক্রমেই সুস্পষ্ট হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের চেহারাটাই বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এখন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে মেধা ও যোগ্যতার বলে জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারা শহরের বড় বড় পদে চাকরি করছে। বড় বড় ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। তারাও গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে।
গ্রামের অর্থনীতির পরিবর্তনটি চোখে পড়ে বাজারের কোনো মুদি দোকানে গেলেই। সেখানে এখন শুধু চাল, ডাল আর কেরোসিন তেলই নয়, বিক্রি হয় শ্যাম্পু, সুগন্ধি সাবান, বিলাসী প্রসাধনী সামগ্রীও। বিশ্বের নামীদামী ব্রান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী এখন গ্রাম গঞ্জের হাটে সয়লাব। গ্রামের মানুষ এখন আর কাঠ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে না, মাঝে টুথপেষ্ট ব্রাশ দিয়ে কিংবা নিদেনপক্ষে টুথ পাউডার দিয়ে। চিপস্, কোল্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস ফ্রুট ড্রিংকস-এমনকি মিনারেল ওয়াটারও পাওয়া যায় গ্রামের বাজারের দোকানে। ইলেকট্রনিক্স পন্যের শো-রুম গঞ্জের হাটে দেখা যায়।
সবচেয়ে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে একান্নবর্তী পরিবার কাঠামোতে। আগে যেখানে দশ-বারো বা তার চেয়ে একান্নবর্তী পরিবার বিদ্যামান ছিল সেখানে এখন ছোট পরিবারের জয় জয়কার।ছোট পরিবার গঠনে ভারতীয় হিন্দি সিরিয়াল মারাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। সিরিয়ালে দেখানো কূটকৌশলগুলো পরিবারের নতুন বউয়েরা বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রয়োগ করেছে।নতুন বউদের সাজ সজ্জাতেও এসেছে বিবর্তন। তারা এখন ভারতীয় ও পশ্চিমা স্টাইল পোশাকে নিজেকে স্বচ্ছন্দবোধ করে। বারো হাত শাড়ি যেন ঘরের কোণে লুটিপুটি খেয়ে কেঁদে মরছে। এটা দেখার কেউ নেই। আগে যেখানে থানায় মামলা মোকাদ্দমা বলতে ছিল গরু চুরি কিংবা সাধারণ জগড়া ঝাটি সেখানে এখন নিত্য নতুন মামলা চালু হচ্ছে। মানুষ রাজনৈতিক সচেতন হয়ে বিভন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে দলাদলি করে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মূলক মামলাতে ফাসাচ্ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। শহর থেকে তৃণমূল রাজনীতি বেশী সফলতা দেখাচ্ছে।
বিপজ্জনক অবক্ষয় ঘটেছে পিতা-মাতার প্রতি দায় বদ্ধতা। আগে পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ করা ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ববোধ বলে মনে করত, তার বদলে এখন পিতা-মাতাহীন পরিবারে নিজেকে স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকে। গ্রামেও বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
এই পরিবর্তনের মাঝে ব্যাপক কু-ফল পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:০৮