somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে পথ বাঁক নিয়েছে

২৯ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কার্তিক মাস সবে শুরু হয়েছে। পুব আকাশে সূর্য মামা উঁকি দিয়ে হেসে উঠেছে। তার রঙ্গিন আভায় আলোকিত হয়েছে পৃথিবী। এই আলোর উপর ভর করে আদম সন্তানরা বেরিয়ে পড়েছে অন্ন জোগাড় করতে। সে দলে পৃথিবীর আদিম পেশাদারী হোসেন আলী আছেন। হোসেন আলী এই মাত্র জমিনে নাঙ্গলের হাল বসাইছে। জমিনে হাল বসানোর আগে তিনি কিছু দোয়া দুরুদ পড়েন। এই দোয়া দুরুদ তিনি পরলোকগত বাবা আক্তার আলী থেকে পেয়েছেন । তার বাবা একজন পাকা হাল চাষারু ছিলেন। আক্তার আলীর বিশ্বাস ছিল, দোয়া দুরুদ পড়ে হালচাষ শুরু করলে তার ফযিলতে ফসলের উপর আসমানী-জমিনী হাওয়াই বালা মছিবত আছর করতে পারেনা।

হোসেন আলীর তিনটা হালের গরু রয়েছে। এর মধ্যে দুইটি ষাড় এবং একটি গাই। গাই গরুর এখন বাছুর দানের সময় হয়েছে তাই সে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করছে। এই সময়টা ষাড়ের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। তাদের একটানা কাজ করে যেতে হয়। এই মহুর্তে হোসেন আলীর নাঙ্গল জমিনের বুক চিড়ে ছুটে চলছে। নাঙ্গলে হাল চাষ করাটা একটা শিল্প। জমিনের চারিদিকে ঘুরে পাক দিতে হয়। এক ঘূর্ণায় একপাক। পাক দেয়ার সময় নাঙ্গলের মাথায় যে লোহার শিষ রয়েছে তা মাটির ভিতর দিয়ে অনেকটা সরল রেখায় চলে। চলার সময় মাটির উপরিভাগ উন্মুক্ত হয়ে দু’ধারে গড়িয়ে পড়ে। ফলে মৃত্তিকার ভিতরে আবৃত অংশ অনাবৃত হয়ে হেসে উঠে। এই হাসিটা হোসেন আলীর কাছে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর কান্নার মত লাগে।

ষাড় দুটি জমিনের বুকে হেটে চলছে। কাঁধে বাঁশের জোয়াল এবং গলায় ঘন্টি লাগানো। ষাড় ‍দুটি হাটার সময় ঘন্টির টুং টাং শব্দ হয়। হালচাষ করার সময় যদি পার্শ্ববর্তী খেতে কোন ফসল থাকে তাহলে মুখে কাপাই বা গোমাই বেঁধে দেয়া হয়, যাতে ষাড় দুটি ফসলে মুখ দিতে না পারে। এ সময় হোসেন আলীর হাতে থাকে পাইচন বা পান্টি। হালচাষ করার সময় গরু যদি কোন রকম ঢিলামী বা এদিক ওদিক করে তাহলে পাছায় ধপাস ধপাস করে কয়েক বার পিটানো হয়। চাষের ফাঁকেফাঁকে হোসেন আলী মাঝেমধ্যে গান ধরেন। তার গানের সূর পূর্ণতা পায় গরুর গলায় ঝুলানো ঘন্টার টুং টাং শব্দে। তিনি গলা ছাড়েন, “ভবের দুনিয়ায়…. তোমার খেলা বুঝা বড় দায়….” অথবা, পর মানুষে দুঃখ দিলে দুঃখ মনে হয়না……….।” গান শেষ হলে মুখে বিড়ি গোঁজে আগুন দেন এবং মুখ দিয়ে ধূয়া ছাড়ার সময় বিভিন্ন কসরত দেখান।

জমিনের বুকে নাঙ্গল চলছে। জমিনে নাঙ্গল চালানো দুনিয়ার আদি পেশার একটি। এই পেশার আসতে মানুষের তেমন শিক্ষার দরকার হয়না। যারা চাষার বা হাল্লার ছেলে তারা ছোটকালে বাবার সাথে খেতে যেতে যেতে সব কিছু শিখে যায়। একদিন হয়ত বাবা নাঙলের হাল হাতে দিয়ে পরীক্ষা নেন। এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার কোন সুযোগ নাই। কারণ এই শিক্ষা যে ধারাবাহিক এবং প্রাকৃতিক। আজ হোসেন আলীর শরীল দুর্বল লাগছে। সূর্য পুরোপুরি মাথার উপর উঠে গেছে। কিছুক্ষণ পর তার বউ সেলিনা ভাত নিয়ে আসবে। তার হাতে পানির জগ এবং সাথে থাকবে ছয় বছরের ছেলেটি। ছেলেটি ক্ষেতে মই দেয়ার সময় মইয়ের উপর উঠার বায়না ধরবে। সে মইয়ের উপর উঠে মই শক্ত করে ধরে রাখবে। এ সময় জোয়ালের গরু দুটি খুব সর্ন্তপনে হাটে যাতে মনিবের বাচ্চা অতিরিক্ত ঝাঁকুনির কারণে পড়ে না যায়। কয়েক পাক দিয়ে তারপর তাকে মই থেকে নামানো হয়। হোসেন আলী বিলের মাঝে ভাত খেতে বসলে সম্পূর্ণ বিলকে একটি ঘর মনে করে। ক্ষেতের আইল বা তুলণামূলক একটু উুঁচ স্থানে যখন তার বউ পাতে ভাত বেড়ে দেন তখন গৃহ আর ক্ষেতের মাঝে একটা পার্থক্য থাকেনা। সেলিনা কে মাঝেমধ্যে হোসেন আলী ভাত খেতে সাঁধেন, কিন্তু সে বলে কি, ‘মাইষে কি বলবে? সরম করেনা বুঝি!

ইতিমধ্যে হোসেন মিয়ার জমিনে এক পাক দিয়ে ফেলেছেন। কিছু দূর থেকে ট্রাক্টরের আওয়াজ ভেসে আসছে। বেশিরভাগ মানুষজন এখন ট্রাক্টরে হালচাষ করে। সেলিনার চাপাপাচিতে একদিন হোসেন মিয়াও সিন্ধান্ত নেয় হালের গরু বিক্রি করে ট্রাক্টর কিনবেন। তারপর হাটে গরু নিয়ে যান বিক্রি করার জন্য। পার্টির সাথে দরদাম করে যখন রশি হাতে তুলে দিবেন ঠিক তখন গাই গরুটা কিযে হাম্বা হাম্বা শুরু করে দেয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেন কোন গরুই তিনি বিক্রি করবেন না। গরু দিয়েই হাল চাষ করবেন। গরু থাকলে দুধ পাবেন, গোবার পাবেন, যা সার ও জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বছরে বছরে বাছুর পাবেন। এটাই বা কম কিসের!

এখন সময় হয়েছে হালের বলদ দুটিকে বিশ্রাম দেয়ায়। সেলিনা ক্ষেতের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার পিছে পিছে একমাত্র ছেলেটি আসছে। ছেলেকে আসতে দেখে তার পুড়ানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেটা আশি দশকের শেষের দিকের কথা। তার বাবার একপাল গরু ছিলো। ধানী জমি ছিলো । তখন তার বাবার সুদিন চলছিলো। এক কথায় সক্ষম গেরস্ত পরিবার। তাদের বাড়িতে দুইজন রাখাল থাকত হালচাষ করার জন্য, এবং ফসল কাটার মৌসুমে সারা বাড়িতে মানুষে গমগম করত। সেই গমগম ভোরে আরম্ভ হয়ে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা চলত। তবে তার বাবার ফসল তোলার এই ধূমধাম ভাটা পড়ে যখন মেঘনা নদী ফসলি জমি গ্রাস করা শুরু করে দেয়। এভাবে কয়েক বছর পার হলে আটাশি সালেন বন্যা শুরু হয় যায়। বন্যায় হুহু করে পানি বাড়তে থাকে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে জনজীবন মারাত্মক বির্পযস্ত করে ফেলে। মানুষ ‍উপায় না দেখে রাস্তায় আশ্রয় নেয়। এই সময় গৃহপালিত গবাদি-পশুপাখী সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে। তাদের কে রাস্তায় আশ্রয় দেয়া হলেও তীব্র খাবার সংকট পড়ে। খাবার বলতে অল্প পরিমান কচুরিপনা ও কলা গাছের কুটিকুটি অংশ। ইতিমধ্যে গরুর পালে এনথ্রক্স নামক জীবানু ছড়িয়ে পড়লে চোখের সামনে গরু গুলো একে একে মরে যেতে থাকে। একটি মাদি বাঁছুর ছাড়া সমস্ত গরু মরে সাফ হয়ে যায়। বন্যার পানিতে টান পড়লে নদী ভাঙ্গন প্রবল আকারে শুরু হয়। পরের তিন বছরে ভিটেমাটি পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলে। উপায় না দেখে তারবাবা মেঘনার অপর পাড়ে চলে আসেন। নদী ভাঙ্গা মানুষের সম্ভল বলতে ঘরের চাল, পরনের কাপড়, গৃহপালিত পশুপাখি আর আসবাবপত্র। হোসেন আলীর বাবা এপারে চলে আসার সময় সাথে করে বাঁছুর ছানাটি নিয়ে আসেন। এখানে তারা তীব্র আর্থিক সংকটের পড়েন। তারা ছিলেন এলাকায় নতুন, তারপর আবার বন্যার কারণে দেশে আর্থিক সংকট চলছিলো। মানুষের হাতে তেমন কাজ ছিলোনা। জিনিষপত্রের দাম হুহু করে বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায় তার বাবার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি পক্ষঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। অত:পর এক বছর রোগে শোকে ভুগে পরপারে পাড়ি জমান। যাওয়ার সময় তিনটি প্রাণী পৃথিবীতে রেখে যান। হোসেন আলী, হোসেন আলীর মাতা, আর একটি বাছুর ছানা। সেই বাছুর ছানাটি হলো বর্তমানে যে গাভীটিকে মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয়েছে তার মা।

সেলিনা বেগম ক্ষেতের একেবারে কাছে চলে এসেছে। আজকে হয়ত কাঁচা মরিচ, পিয়াজ, ডিম বাজা আর পান্তা ভাত এনেছে। ভাত ক্ষেতে ক্ষেতে সেলিনার সাথে সংসারের টুকিটাকি গল্প হবে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হবে। সেলিনার ইচ্ছা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্ত হোসেন আলীর ইচ্ছে ছেলে পশুর ডাক্তার হবে। হোসেন আলী ভালো করে জানে, তিনি মারা যাওয়ার পর বংশপরম্পরায় যে পেশা চলে আসছে তার ছেলে হয়ত তা টেনে নিবেনা। কিন্তু পশু ডাক্তার হলে সেটি কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। গরু সহ অন্যান্য প্রাণীদের চিকিৎসা করতে পারবে। এতে গৃহপালিত পশুদের মঙ্গল হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:৫৬
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×