somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘ডুয়ার্সের পথে পথে’ পর্ব- ২

২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকালে ভারিয়া গ্রাম পর হয়ে সামান্য এগোতেই পথ ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে এক পাহাড়ি নদীর বুকে। পথের শেষে আরেক স্বপ্নের শুরু। চার দিকে গভীর জঙ্গল ভরা পাহাড় আর পাহাড়। সেই সবুজ জঙ্গলমহলকে দু’পাশে ঠেলে তিরতির করে বয়ে চলেছে সুনতালেখোলা নদী। নদীর উপর মানানসই একটা ঝুলন্ত ব্রিজ।



ব্রিজে দোল খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম ‘পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন নিগন’ এর প্রকৃতি দর্শৃন কেন্দ্রে। ছোট ছোট কটেজ দেখতে খুবই সুন্দর। চারদিকে অফুরন্ত সবুজ। নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে অনুভব করা যায় জঙ্গলের সবটুকু, সাথে বরফ ঠান্ডা পানির শীতল অনুভূতি। ফিরে এলাম আমাদের বাংলোতে।

সকালের নাস্তা সারলাম রুটি, ডিম ও আলুর দম দিয়ে। সাথে অবশ্য চিলি পেষ্টও ছিল, তবে ওটার ধারে কাছেও কেউ গেল না। নাস্তা সেরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরের গন্তব্য ‘রকি আইল্যান্ডে’।

রকি আইল্যান্ডের পথে



আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দু’পাশে নাম না জানা গাছগাছালি দিয়ে সংরক্খিত সবুজ বন। হাটতে হাটতে বেশ খানিকটা পথ পার হয়ে একটা রাস্তা বামে মোড় নিল। এ পথেই যেতে হবে ‘রকি আইল্যান্ডে’। পাহাড়তলির নীচে লিচু, আপেল আর কমলার বাগানের ছায়াছন্ন পথ ধাপে ধাপে নেমে গেছে মূর্তি নদীর কোলে। আপেল-কমলার বাগান দেখে এসব চুরি করার একটা সুপ্ত বাসনা বার বার মথা চারা দিলেও তাকে দমন করতে হলো। চমৎকার একটি ব্রিজ সংযুক্ত করেছে মূর্তি নদীর দু’পার। ব্রিজের পাড়েই মূলত ‘রকি আইল্যান্ড’। এখানে রাত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সেটা বেশ মজার! তাবুতে! এখানে রয়েছে কৃত্রিম রক ক্লাইম্বিং এর ব্যবস্থা। মূর্তি নদীর স্বচ্ছ পানি দেখে কাওছার গোসল করার প্রস্তুতি নিল। পানিতে এক পা ফেলেই বেচারা শক খাওয়ার মত সাথে সাথেই পা তুলে নিল। আমি হাসতে লাগলাম। নভেম্বরের শেষে বরফ গলা পানি যে কেমন ঠান্ডা হয় তা আমার ভালই জানা আছে!

রকি আইল্যান্ডে



বেশ খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে আমরা ফিরে চললাম সামসিং এর পথে। সামসিং থেকে আবার চালসা। চালসা থেকে রওনা হব জলঢাকার দেশে অর্থাৎ ঝালং ও বিন্দুতে। এর আগে অবশ্য আমাদের ডলার ভাঙ্গাতে হবে। ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে পড়লাম ঝামেলায়। এখানে কোন মানি একচেঞ্জ নেই। একজন বললো মাল বাজারে ডলার চেঞ্জ করতে পারবেন। বাধ্য হয়ই আমাদের যেতে হল মাল বাজারের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে। কিন্তু বিধি বাম! এখানেও ডলার চেঞ্জ করা যায় না। ম্যানেজার জানালেন আমাদের যেতে হবে শিলিগুড়ি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের একটা দিন নষ্ট হল শুধু ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে। শিলিগুড়ি এসে আমাদের ‘ভ্রমণ বাংলাদেশের’ সৌম্য ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি সান্দাকফু ট্র্যাকিং শেষ করে মাত্র ফিরেছেন। রাতে হোটেলে জমপেশ একটা আড্ডা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন আমরা রওনা হব ঝালং এর উদ্দেশ্যে আর সৌম্য ভাই চলে আসবেন বাংলাদেশে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সৌম্য ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম ঝালং এর উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ঝালং যাওয়ার রাস্তাটি প্রকৃতি সাজিয়েছে তার আপন মনে। ছোট বাচ্চারা যেমন খেলনার জন্য বায়না ধরে, প্রকৃতিও যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে বায়না ধরে নদী-পাহাড়-জঙ্গল চেয়ে নিয়েছে। নদীতে নদীতে যেন কাটাকাটি খেলে এখানে। অন্তত সাতটি নদীর অভিবাদন নিয়ে পৌঁছাতে হয় জলঢাকার দেশে।

তিস্তা



নদীগুলো হল তিস্তা, লিস, ঘিস, চেল, মাল, কুর্তি ও মূর্তি।নদী পার হতেই খুনিয়া মোড় থেকে শুরু হয় গা-ছমছমে বন। এই বনের অন্য নাম চাপড়ামারি অভয়রন্য। বনের ভিতরে চাপড়ামারি রেলষ্টেশনের পাশে লেভেলক্রসিং পার হয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চা-বাগানের সীমানা শেষ করে রাস্তা সোজা উঠে গেছে পাহাড়ে। এখানেও চারদিকে সবুজের সমারোহ। কোথাও পাহাড়ীদের ছোট ছোট গ্রাম। এসব পার হয়ে পথ পাক খেতে খেতে যেখানে শেষ হয়েছে, সেটাই ঝালং। ভুটান পাহাড়ের গায়ের কাছে ডুযার্সের এক অপরূপ সৌন্দর্র্যমন্ডিত জনপদ। সে যেন সুন্দরী শ্রেস্ঠা, দিন-রাত ঝুকে পড়ে নিজের রূপ দেখতে চায় জলঢাকা নদীর আয়নায়।
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম ঝালং এ। বন বিভাগের বাংলোতে রূমও পেয়ে গেলাম থাকার জন্য । খেতে গিয়ে আমাদের মতো ভেতো বাঙ্গালিদের একটু সমস্যই হলো।করন এখানে কোথাও ভাত খুজে পেলাম না। অগত্যা এখানকার প্রধান খাবার মোমো আর চাওমিন দিয়েই আমাদের দুপুরের খাবার সারতে হলো। খাবর সেরেই চলে এলাম জলঢাকা নদীতে। নদীর পাড়ে পরে থাকা পাথরগুলোর ফাঁক ফোঁকর গলে কুল কুল করে বয়ে চলেছে স্রোতের ধারা । এখানে মাছেদের অবাধ বিচরন ।বিকালে আমরা চলে এলাম কাছের এক পাহাড়ে। ছয়-সাতশ ফুট উপর থেকে নদীর তীরের ছোট ছোট ঘরবাড়ি-মানুষজনকে ঠিক পুতুলের মত লাগছিল। এ যেন এক পুতুলের শহর।


নদীর সমতল থেকে শুরু করে সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের ওপর পর্যৃন্ত ছড়ানো এখানকার জনবসতি। বেশ কয়েক বছর আগে নদীতে বাঁধ দিয়ে এখানে তৈরি করা হয়েছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের লোকজনই বেশি। এই কেন্দ্রের জন্যই জায়গাটা এখন রমরমা, আগে ছিল অরণ্যের দখলে।
বাজারের মোড়ে একটা চোর্তেন চোখে পড়লো।অনেক মন্ত্র লেখা রঙ্গিন পতাকা উড়ছে তাকে ঘিরে। পতাকাগুলোতে বিভিন্ন ধর্মীয় বানী লেখা।



নেপালী আর হিন্দি ভাষা চলে এখানে। আমাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভুল হিন্দি শুনে তাদের হাসি আর দেখে কে! সন্ধায় ফিরে এলাম রুমে। নদীর কুল-কুল বয়ে চলার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঝালং এর পাট চুকিয়ে আমরা চলেছি বিন্দুতে। ঝালং হতে বিন্দুর দূরত্ব মাত্র ১২ কি.মি.।মাঝ রাস্তায় চোখে পড়লো ছবির মতো একটি গ্রাম। এর নাম প্যারেন। প্যারেনে সবাইকে একটু থামতেই হয়, প্রকৃতিই যেন যত্ন করে আঁকা নিজের চিত্রকর্র্ম দেখাতে গাড়ি থামাতে বলে। প্যারেনের বাড়িগুলো নানা রঙ্গে রাঙ্গানো। প্রতিটি বাড়ির গায়ে নানা রঙ্গের ও নানা রকমের ফুলের বাগান।

বিভিন্ন ক্যাকটাস ও ফুল


চাষের খেতে সবুজের বন্যা। বসন্তদিন যেন কখনও শেষ হয় না এই পাহাড়ি স্বপ্নরাজ্যে। প্যারেন পার হয়ে পথের শেষটুকু জলঢাকা নদী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। বিন্দুতে রাত থাকার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই। তাই বিন্দু পৌঁছেই একই সাথে চোখ ও মনের মহাভোজে লেগে গেলাম।রেসিপি হলো চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্র্য।
সবুজের বন্যা



এখানেও নদীতে বড় বড় পাথর রয়েছে। পাথরের উপর বসে জলঢাকার গান শুনতে আর ফেনা ছড়িয়ে বয়ে চলা দেখতে দারুণ লাগে। পাহাড় আর নদীর সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে কাটিয়ে দিলাম সারাটা দুপুর। নদীর ওপারেই খাড়া উঠে গেছে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের উপরের ঘরবাড়ি এপাশ থেকেই চোখে পড়ে। ওটাই ভূটান। জায়গার নাম ’বকবকি’।সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের ফিরতে হবে। জঙ্গল ভেদ করে, অরন্যের নিস্তব্ধতা খান-খান করে আমাদের জীপ ছুটে চলেছে শিলিগুড়ির পথে। পিছনে ফেলে এসেছি ঢেউখেলানো পাহাড়ের বিস্তার, অনাবিল প্রকৃতির হাতছানি।


আরও কিছু ছবি

১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×