মে মাসের প্রচণ্ড গরম বাইরে, তবে বিল্লাহ গ্রুপের মালিক বাকী বিল্লাহ সাহেব সদ্য কেনা এসি পাজেরো গাড়ির ভেতর বইসা আছেন কিনা, তাই বাইরের প্রচণ্ড গরম তাকে শঙ্কিত করে না, তিনি শুধু একটা ড্রাইভার মুরাদ মিয়ারে বলেন গাড়ির এসিটা আরও একটু বাড়ায়া দিতে। মুরাদ মিয়া সাথে সাথে হুকুম তামিল করে, গত আট বছর ধইরা বাকী বিল্লাহ সাহেবের খাস ড্রাইভার সে, তাই এই একটা জিনিস জানে যে নিজের হুকুম তামিল হওয়ায় কোনও দেরি বিল্লাহ সাহেব একেবারেই বারদাশত করতে পারেন না।
শুধু গরম হলে বিল্লাহ সাহেব হয়ত বিরক্ত হইতেন না, তবে তার গাড়িটা আটকায়ে আছে ঢাকা শহরের ভয়াবহ জ্যামে, সেই জ্যামের কারনে তিনি একটু একটু করে বিরক্ত হইতেছেন সবকিছুর উপরে। এই দেশটার কিছুই হইব না, বিরক্তি চাইপা ভাবেন তিনি। সঠিক ভাবে কইতে গেলে কোনও দিনই তিনি এই দেশটারে ভাল চোখে দেখেন নাই, যদিও দেশটা তারে দিছে অনেক। না না, দেশ তারে দিবে কেন? তিনি আবার ভাবেন, নিজের হাতে সবকিছু তিনি আদায় কইরা নিছেন। এ দেশের তো ঠেকা পড়ে নাই যে তার মত একজন বিখ্যাত রাজাকারের হাতে সব কিছু আপসে তুইলা দিবে।
হ, আমি একজন রাজাকার, ভাবেন বিল্লাহ সাহেব, এবং মনে প্রানে তাই থাকমু মরার আগ পর্যন্ত। বাংলাদেশরে তিনি ইন্ডিয়ার একটা রাজ্য ছাড়া কিছুই ভাবেন না, আর যতবার এই কথাডা ভাবেন ততবার ওই হিন্দু ইন্ডিয়ান দালাল গুলোর প্রতি তার নাকটা কুচকায়া ওঠে, ঘেন্নায়। শালারা, খুব তো লাফালাফি করছিলি পাকিস্তানরে ভাঙ্গার জন্যে, এখন কি অবস্থা? না বুইঝা কয়েকটা ইন্ডিয়ান দালালের কথা শুইনা এই সুন্দর দেশটারে ভাইঙ্গা দুই টুকরো করলি; আর এখন নিজেদের ভাগটারে সামলাইতে তোদের পেছন দিয়ে বাইর হয়া যাইতেছে গু, আর আমরা যারা সেই সময়ে পাকিস্তানরে এক রাখতে চাইছিলাম, তারা ঠিকই আমাদের জায়গামত চইলা যাইতেছি। আগামী নির্বাচনের অপেক্ষায় আছেন বাকি বিল্লাহ সাহেব, কারণ আর মাত্র কয়েকদিন পরেই নির্বাচনে এমপি পদে দাঁড়াইতেছেন তিনি, আর একবার নির্বাচনে দাঁড়াইয়া গেলে কারো বাবার সাধ্য নাই তারে হারায়ে ওই আসনটায় বসে।
নির্বাচিত হইলে কি করবেন সেই চিন্তাটা মাঝে মাঝেই করেন বিল্লাহ সাহেব, কারণ চিন্তাটা তারে টনিকের মত কাজ দেয়, নিজের বয়স আরও দশ বছর কইমা গেছে বলে মনে হয় তার, আর সেই সাথে পাকিস্তানের খেদমতে নিজের জান উৎসর্গ কইরা দেয়ার সেই জোশ আবার অনুভব করেন তিনি। এখনও তিনি তাই করলেন, গাড়ির আরামদায়ক সীটে হেলান দিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়া ভাবতে লাগলেন তার ভবিষ্যতের সুখের দিনগুলোর কথা।
ভাবতে ভাবতে প্রায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় চইলা গেছিলেন বিল্লাহ সাহেব, হঠাৎ কইরা একটা চিৎকারে ধ্যান ভাইঙ্গা গেল তার, মেজাজ টা খারাপ কইরা জানালা দিয়া মুখ বাড়ায়ে তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন চিৎকার টা কোথা থাইকা আসতে পারে।
গাড়িটা জ্যামের কারনে সামান্য আগায়ে আসছে, আর আগায়ে এসে যেইখানে থামছে সেইখানে রাস্তার পাশেই ফুটপাতে একটা ভাঙ্গাচোরা চাকা লাগানো কাঠের গাড়িতে এক ফকির বইসা ভিক্ষা চাইতেছে, কথা বের হইতেছে না মুখ দিয়ে, তার বদলে কিছু অর্থহীন ধ্বনি শুনা যাইতেছে কেবল। ফকিরটা বোবা, বুইঝা নিলেন বিল্লাহ সাহেব, তবে সে জন্যে মনে এক্সট্রা কোনও মায়া-দয়া জাগলো না তার, কারণ এইরকম বোবা ফকির ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে হাজারে হাজারে দেখা যায়, সবাইরে দয়া দেখাইতে গেলে দুই দিনেই তারে পথে বসতে হবে।
নাকটা সিটকায়ে আবার সীটে হেলান দিলেন বিল্লাহ সাহেব, আর ভাবলেন মুরাদ মিয়ারে কইবেন কিনা জানালার কাঁচটা উঠায়ে দিতে, কারণ ইদানীং কি সব নতুন নতুন গাড়ী বের হইতেছে, আগা মাথা কিছুই তিনি বুঝতে পারেন না। তবে কথাটা মুরাদ মিয়ারে তিনি শেষ পর্যন্ত কইলেন না, বা কইতে পারলেন না, কারণ তার আগেই জানালা দিয়া আরও কেউ একজন একটা হাত ঢুকায়ে দিছে, হাতটা তার নাকের সামনে নাড়াইতেছে। মেজাজটা এইবার সপ্তমে উইঠা গেল বাকী বিল্লাহ সাহেবের, প্রচণ্ড রাগে তিনি মাথাটা ঘুরাইলেন জানালার দিকে, উদ্দেশ্য হাতের মালিকরে মা বাপ তুইলা একটা গালি দিবেন।
ওই শালা ‘......’র পুলা, হাতটা কই ঢুকাইতেছস...কথা টা শেষ করতে পারেন না বাকী বিল্লাহ সাহেব, কারণ তার আগেই তিনি দেখতে পাইছেন যে হাতের মালিক কোন পুলা না, মাইয়া এবং আরও সঠিক কইরা বলতে গেলে, একটা ফকিরনী। আরও অনেক ফকিরনীর মত এইটাও মুখের মধ্যে একটা করুন ভাব ফুটায়ে রেখেছে, বিল্লাহ সাহেব তাকাইতেই কইল, সার, কিছু টেকা দিবেন গো সার, দুই দিন ধইরা কিছু খাই না, বাচ্চাডা লয়া বড় কষ্টে আছি গো সার...
বিল্লাহ সাহেব দেখলেন, ফকিরনী তার কোলে একটা হাড় জিরজিরে দুই-তিন বছরের বাচ্চা ধইরা রাখছে, দেইখা মনে হয় দুনিয়ার যত অসুখ সবই এই বাচ্চার মধ্যে আছে। আর বাচ্চাডার দিকে তাকানর পরেই তার চোখ একটু পাশে সইরা গেল, ফকিরনীর ছেঁড়া শাড়িটা যেইখানে তার শরীরটারে কোনমতে ঢাইকা রাখার চেষ্টা করতেছে, তবে সামান্যই সফল হইতেছে বইলা মনে হয়, সেইখানে। তিনি আরেকবার ফকিরনীটার মুখের দিকে তাকাইলেন, তবে এইবার একটু অন্য ভাবে, আর দেখলেন যে যদিও রাস্তার ফকিরনী, তবে মুখেও বেশ চটক আছে, আর ধুইয়া মুইছা নিলে একেবারে খারাপ লাগব না।
বিল্লাহ সাহেবের চোখ এইবার মুখ থাইকা নিচের দিকে নামতে শুরু করল, আর নিজের যুবক বয়সের কথা মনে পড়তে লাগল তার, আহা, কি আরামের দিনই না কাটাইছেন তখন। বিশেষ কইরা যুদ্ধের সময়টার কথা মনে পড়লে তো তার কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় সবকিছু। ফকিরনীডার দিকে তাকায়ে তিনি এইসব ভাবনায় আবার ডুইবা গেছিলেন, কিন্তু ফকিরনীডার তো এত কিছু দেখনের টাইম নাই, এই বিশাল জ্যামে যেই গাড়ীগুলি আটকায়ে পড়ছে তাদের সবগুলির কাছে একবার তার যাওয়া লাগব জ্যাম ছুটনের আগেই, তাই সে আবার কইল, ও সার, দেন না কিছু টেকা, দেন না সার?
আবার ধ্যান ভাংল বিল্লাহ সাহবের, তবে তিনি এইবার আর বিরক্ত হইলেন না, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির পকেট থাইকা টাইনা বার করলেন মানিব্যাগটা, তারপরে খুললেন। ভিতরে সাজান পাঁচশ আর হাজার টেকার নোট, একটা পাঁচশ টেকার নোট বার কইরা নিলেন তিনি, তারপরে নোটটা হাতে নিয়া আবার কি জানি ভাবলেন, তারপরে নোটটা ভিতরে ঢুকায়ে রেখে খুচরা ঘাইটা একটা পঞ্ছাশ তাকার নোট বের করলেন। মুখে একটা তেলতেলে হাসি ফুইটা উঠল তার, তারপরে ফকিরনীটার শরীরটা আরেকবার চোখ দিয়া চাইটা নিয়া নোটটা বাড়ায়ে ধরলেন তার দিকে।
নোটটা হাতে নিল ফকিরনীটা, তারপরে সরাসরি তাকাইল বিল্লাহ সাহেবের দিকে। এইবার শরীরটা বাদ দিয়া বিল্লাহ সাহেবও তাকাইলেন তার চোখের দিকে, চোখাচোখি হইল দুইজনের, এবং বিল্লাহ সাহেব দেখলেন যে ফকিরনীটার চোখে ঘেন্না ফুইটা উঠছে, কারণ সে বুঝতে পারতেছে বিল্লাহ সাহেবের এই দৃষ্টি আর বেশি টেকা দেওনের অর্থ। সে গলা পরিস্কার করার মত শব্দ কইরা একদলা থুথু আনল মুখে, তারপরে বিল্লাহ সাহেব কিছু বুইঝা ওঠার আগেই থুহহ কইরা থুথুটা ছিটায়ে দিল তার গাড়ির দিকে, তার মুখ বরাবর। গাড়ীর কাচ বেশিরভাগই ওঠানো ছিল, তাই থুথুটা লাগল না বিল্লাহ সাহেবের মুখে, কিন্তু থকথকে একটা ভাব নিয়া লাইগা থাকল তার দামি গাড়ির জানালায়, তারপরে আস্তে আস্তে গড়ায়ে নামতে শুরু করল নিচের দিকে।
বিল্লাহ সাহেবের মনে হইল থুথু না, তার গাড়ির দিকে কেউ একটা আগুনের গোলা ছুঁইরা মারছে, আর সেই আগুনের গনগনে আঁচ আইসা লাগতেছে তার গায়। মাথার ভিতর আগুন ধইরা গেল তার, আর গলার ভিতর থেকে বাইরায়া আসল একটা গো গো ধরনের আওয়াজ, কারণ কি বলবেন বুঝতে পারতেছেন না তিনি, কোন গালিটা দিবেন, নাকি গাড়ির কাচটা নামায়া ফকিরনীর গলাটা চাইপা ধরবেন ঠিক মাথায় আসতেছে না তার। তবে কিছু বলা লাগল না তার, কারণ থুথু দিয়াই ফকিরনী হাঁটতে শুরু করছে উলটা দিকে, আর রাস্তার লাল সিগন্যাল হয়ে গেছে সবুজ, ফলে মুরাদ মিয়া গাড়িটা চালাইতে শুরু করেছে সামনের দিকে।
প্রচণ্ড রাগ চাইপা বইসাই থাকেন বিল্লাহ সাহেব, আর তার পাশেই জানালার কাচে লাইগা থাকা থুথুর দলাটা অবিচল ভাবে গড়ায়ে নামতে থাকে নিচের দিকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




