(সারা রাত জাগা হাসনাহেনা'র ভেজা গন্ধ এ কাব্য জুড়ে)
কোনও এক সাঁঝে, তোমাদের মাঝে - যেতে চাও কেউ গাঁয়ে?
গোধুলীর শেষে রাত নেমে আসে যেথা গুটি গুটি পায়ে,
চাঁদ উঠে আসে মেঘের ওপাশে, মেঘ ভেসে যায় দূরে
লক্ষ হীরা জ্বলে ওঠে নীল আকাশের বুক জুড়ে।
নীলচে আলোর মায়ায় ভরা নক্ষত্রের রাতে
পাড়াময় যেন রূপালী জোছনা ছায়ার খেলায় মাতে
গাছের ছায়া, পাতার ছায়া - কালচে নীলাভ ছায়ায়
কুটিরখানিরে রেখেছে যে ঘিরে, কোন সে অবুঝ মায়ায় !
সেই ছোট নীড়ে, পর্ণ কুটিরে, এইটুকু আঙিনায়
রাজপুত্তুর-রাজকন্যা'রা প্রতিদিন আসে যায় !
দাদীমা'র পাশে, গোল হয়ে বসে, শিশুরা সেসব শুনে
রাজপুত্তুর এক কোপে ক'টা রাক্ষস মারে গুনে;
দুনিয়ার যত রাজা - সব ছিল দাদীমা'র পরিচিত
একটা সোনার মোহর-ও যদি বোকা দাদী চেয়ে নিত !
আর এক পাশে, সারি বেধে বসে, যতেক ছেলের দল
বই-খাতা খুলে, একই সুরে তুলে পাড়াময় সোরগোল,
হ্যারিকেন আর পিদিমের সাথে জ্ঞানের আলো এসে মেশে
গড়ছে তাদের, ভাবী মুখ যারা - এ গাঁয়ের, এই দেশের।
দেউরি'র কাছে, পাটি পাতা আছে, সেথা অভ্যাসবশে
তামুক-ছিলিম সাজায়ে পাড়ার মর্দ্দ'রা সব বসে
ছোট কুপি নিয়ে, পুঁথি উল্টিয়ে পড়ে কোনও বিদ্বান
তার চারপাশে, গভীর আবেশে, শুনে সবে সে বয়ান।
দরাজ কন্ঠ, কাঁপা কাঁপা স্বর, কাহিনী উঠেছে জমে
পিতা-পুত্রের সে কী যুদ্ধ - "সোহরাব-রোস্তমে"
হাসিয়ে-কাঁদিয়ে কাহিনী আগায় - একটানা সেই সুরে
আকুল বাতাসে মন ভেসে যায় দূর থেকে আরও দূরে
ডাব্বা-হুঁকা এক হাত থেকে আরেক হাতে ঘোরে
'গুড়ুক গুড়ুক' শব্দে বধু'র বাপজী'রে মনে পড়ে
ক্লান্ত বধু'র দুই চোখে নামে উদাস স্মৃতির ঘোর
গাঙের ওপারে ফেলে আসা তার শৈশব-কৈশোর
হাওয়া সুর তোলে পৃথিবী'র কোনও আদিরূপ শিষ-গীতে
বনফুলগুলো পড়ে যেন নুয়ে - জোনাকীর বৃষ্টিতে;
বাঁশঝাড় আর ধানক্ষেত ফেলে আরও পূবে যাও যদি
দেখবে সেথায় টলমল জলে - আমাদের ছোট নদী।
বাঁশঝাড়টা তো চিরটাকালের অলক্ষুণে ভারী
শিমুল গাছটা পেরোলেই সেথা লক্ষীপেঁচা'র বাড়ি,
বাদ দাও ওসব - এই রাত্তিরে নাম নেয়াটাও ভূল
পেঁচাও কিভাবে 'লক্ষী' হয় - তা পাইনা যে ভেবে কূল !
উত্তর কোণে, যেন এক মনে, বাঁধানো পুকুর ঘাটে
টলটলে জলে, গা ভিজাবে বলে, চাঁদ নেমে আসে পাটে
ঘাটের কিনারে, যেন অভিসারে, ছোট্ট মাছের বহর
দুষ্টুমীছলে নিতে আসে বুঝি - ডাঙা'র খবরাখবর !
একই চাঁদ তো শহরেও আসে - ফিলিপস বাতির মত
সন্ধ্যা হতেই উঠে বসে থাকে, রাতে জ্বলে অবিরত
নেমে আসতে দেখেছ কি তাকে শহুরে শপিং মলে?
যেভাবে সে আসে, গা ভিজাবে বলে, ছোট্ট পুকুর জলে?
পুকুর পেরিয়ে 'কবর' - সেথায় শুয়ে আছে চিরসুখে
গ্রামখানি গড়ে ঘুমায়েছে যারা এই গাঁয়ের-ই বুকে;
কত পিতা-মাতা, কত ভাই-বোন, কত আদরের দাদু
ঘুমায় ঘুমায় সোনার ছেলেরা, কত না বুকের যাদু!
যারা যায় তারা চলে যায়, যারা বেঁচে থাকে অবেলায়
বাকীটা জীবন, প্রতি সাঝেঁ তারা, হারায় স্মৃতির মেলায়।
থুত্থুরে বুড়ো, কাসেম খুড়ো'র মন ভরে ওঠে ব্যাথায়
তোরাব, সগীর, আলম - সবাই ঘুমায়ে রয়েছে সেথায়
সারা জীবনের সঙ্গীরা সব সুগভীর ঘুমে বুঁদ
'তাদের সবারে বেশ্ত নসিব করিও, ইয়া মা'বুদ'
রাত বেড়ে চলে, তারা'রাও জ্বলে, চাঁদ হেলে পড়ে ধীরে
বাতাসও ভাসে ফুলের সুবাসে, পুরো গ্রামখানি ঘিরে
রাত বেড়ে চলে, রাত বুড়ো হয়, গ্রাম হাসে অমলিন
শত বছরের পুরোনো এ গাঁথা -- এ-ই রবে চিরদিন !!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




