এক.
মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে রাজিব রায়হান তার বুদ্ধিমত্তার শেষ নিদর্শনটা রেখে গেলেন। তার খুনিরা তখনও তার লিভিংরুমে, একে একে তাদের উপস্থিতি'র সব আলামত ধ্বংস করছে। বোঝা যাচ্ছে, এরা প্রচন্ড প্রফেশনাল আর সতর্ক। তাকে এমন কোনও সুত্র রেখে যেতে হবে যেটা এরা ধরতে পারবে না, কিন্তু পরে হয়তো কেউ এসে বুঝে নেয়ার সম্ভাবনা থাকবে। অবিরাম রক্ত ঝরছে, রাজিব রায়হান পরিস্কার বুঝতে পারছেন, তার হাতে সময় খুব কম।
খুনি দুইজন আসলেই অতিরিক্ত সতর্ক। দুজনই মুখোশধারী, কথা বলছে ভারী গলায়, আর একজন আরেকজনের নাম ধরে ডাকছে না; ডাকছে নাম্বার দিয়ে - নাম্বার ওয়ান আর নাম্বার টু; রুমে কোথাও টেপ রেকর্ডার থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারপরও রাজিব রায়হান একজনকে স্পষ্টই চিনতে পেরেছেন। নাম্বার টু পুরো রুমে শেষবার চোখ বুলিয়ে হঠাৎ রায়হানের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। সতর্ক গলায় বলল, "নাম্বার ওয়ান, টার্গেট স্টিল মুভিং"। নাম্বার ওয়ানও চোখ ফেরাল।
রাজিব রায়হান তার রিডিং টেবিলে মাথা রেখে স্থির। চেয়ার গড়িয়ে এখন তার রক্তে কার্পেট ভিজে যাচ্ছে। শুধু তার হাতের আঙুল কাঁপছে, রক্ত দিয়ে টেবিল-ক্লথের উপর কিছু লিখছেন। দুজনই দ্রুত এগিয়ে গেল।
নাম্বার টু হাত বাড়ানোর আগেই ওয়ান তার হাত ধরে থামিয়ে দিল, "ওয়েইট..."। সে চোখ সরু করে রাজিবের লেখা পড়তে লাগল~
I kill Judas’ mam
ধীরে ধীরে সে নাম্বার টু'র দিকে তাকাল, "এই শালা তো মনে হয় আগে মার্ডার করসে। মরার আগে স্বীকার করে যাচ্ছে..."
রাজিব রায়হান লিখে চলেছেন,
Jami kill Masud
FeS2
নাম্বার টু প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল। নাম্বার ওয়ান খনিকক্ষণ ভেবে তারপর বলল, "এই জিনিস থাকুক। তার স্বীকারোক্তিও হলো, আর পুলিশের চোখও অন্যদিকে সরে যাবে..."
"কিন্তু ঐ FeS2-টা কী?"
"সেটাই ভাবতেসি। ওটা রিস্কি কিছু কি না... কিন্তু ওটা সরাতে গেলে টেবিল-ক্লথটা সরাতে হবে। আমি চাইতেসি টেবিল-ক্লথটা থাকুক। পুলিশ এই জামি-মাসুদ নিয়ে থাকুক কয়েকদিন..."
রাজিব রায়হানের হাসার মত অবস্থা নেই, থাকলে তিনি এখন ঠোঁট বাঁকা করে হাসতেন। তিনি অতি কষ্টে সামনের দিকে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করলেন। এর কয়েক সেকেন্ড পরই বুকশেল্ফের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দু'টা চিরতরে স্থির হয়ে গেল।
দুই.
ভোর ছয়টা। ইনস্পেকটর ওয়াদুদ যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন। শুক্রবার এত সকাল সকাল তিনি তানিয়া'র ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে চান না। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখলেন এই সমস্ত সতর্কতা একেবারে অনর্থক করা হল। তানিয়া সোফায় বসে স্থির হয়ে আছে।
"কিরে মা, ছুটির দিন এত সকালে উঠে গেলি?"
"পাপা তুমি জানো না, আমি রোজ সকালে মেডিটেশন করি?"
এই বিষয়টা জানতেন কিনা ওয়াদুদের মনে পড়ছে না। অথচ একটা সময় এই মেয়ের সমস্ত কিছু তিনি পরম যত্নে খেয়াল রাখতেন। কবে থেকে রাখা হয় না?
"পাপা? তুমি এত ভোরে বের হয়েছিলে? সিরিয়াস কিছু?"
"হুম, মার্ডার।"
"পলিটিক্যাল?"
সাত-সকালে আদরের মেয়ের সাথে গল্প করার জন্যে 'মার্ডার-কেস' খুব একটা উপযুক্ত বিষয় না। তিনি কথা পাল্টে বললেন, "মা, কফি বানাবি?"
"যাচ্ছি পাপা", তানিয়া হাসিমুখে উঠে কিচেনে চলে গেল। ওয়াদুদ সোফায় বসে ভাবতে লাগলে, তানি যত বড় হচ্ছে, তার সাথে কথা বলার জনতে বিষয়ের তত অভাব-বোধ হচ্ছে। তানি'র মা বেঁচে থাকলেও কি এই সমস্যা হত? কে জানে। তিনি হাতের খামটা টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন।
হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখেন, ড্রয়িংরুমে কাঁচের টেবিলে তার কফি অপেক্ষা করে বসে আছে।
"পাপা, লোকটা কে?", তানিয়া তার খাকি খামের ভেতর থেকে মার্ডার স্পটের ছবিগুলো দেখছে। তিনি কড়া কিছু বললেন না, তানিয়া মাঝে মাঝেই এসব দেখে অভ্যস্ত।
"রাজিব রায়হান। বিজনেসম্যান।"
"পলিটিক্যাল মার্ডার?"
"জানি না, হতেও পারে। ভদ্রলোক সরাসরি পলিটিক্স করতেন না, তবে সরকারি দলের একজন প্যাট্রোনাইজার ছিলেন"
"লোকটা কিসের দিকে তাকিয়ে আছে?"
এটা ওয়াদুদ'ও খেয়াল করেছিলেন। ভিকটিমের মাথাটা স্বাভাবিক অবস্থানে ছিল না। মনে হচ্ছিল অনেক কষ্টে তিনি সামনের কিছু দেখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ওদিকটায় কী ছিল এটা খেয়াল করে দেখা হয়নি।
"পাপা, লোকটা যেদিকে তাকিয়ে আছে ওদিকটায় কী ছিল?", তানি আবার প্রশ্ন করল। এই মেয়ের দেখার চোখ ভাল, ওয়াদুদ মনে মনে ভাবলেন।
"মনে নেই মা, হয়তো আলমারি, বা টিভিও হতে পারে।"
তানি অবাক হয়ে তাকাল, "হয়তো? লোকটা মারা যাওয়ার আগে এত কষ্ট করে কী দেখতে চাইল, সেটা দেখবে না?"
ওয়াদুদ কফিতে চুমুক দিয়ে হাসলেন। সবাই ডেড-বডিটাই দেখল, ডেডবডি'র দৃষ্টিপথের খবর কে রাখে।
"পাপা, টেবিলে এসব কী লেখা? উনি লিখেছেন?"
"হুম, এটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। লোকটা মারা যাওয়ার আগে রক্ত দিয়ে টেবিল ক্লথের উপর কী সব লিখে গেল। এসবই এখন একমাত্র লিঙ্ক। খুনিরা আর কোনও সূত্র রেখে যায়নি। হাইলি প্রফেশনাল"
"অথচ এটা রেখে গেল? এতবড় একটা সূত্র?"
"সেটাই। এই জুডাস'টা কে সেটা জানা দরকার। ভিকটিম বলছে সে জুডাসের ম্যাম'কে খুন করেছে। এটা প্রতিশোধমূলক কিছু হতে পারে। আর ঐ জামি আর মাসুদ কারা - এটাও খোঁজ করা হচ্ছে।"
"হুম", তানি অনেক্ক্ষণ চুপ থেকে বলল,"জুডাস নামে আসলেও যদি কেউ থাকে, তাহলে সে বা তার লোকেরা প্রতিশোধ নিতে এসে খুন করে এতবড় সূত্র রেখে যাবে না। তার উপর তুমি বলছ ওরা হাইলি প্রফেশনাল। এটা রেখে গেছে তোমাদের বিভ্রান্ত করতে..."
"তুই দেখছি আমার কফি শেষ হওয়ার আগেই কেস সলভ করে ফেলবি", ওয়াদুদ হাসলেন, মেয়ের বুদ্ধিতে তিনি আনন্দিত। যদিও এসব কথাই তার মাথায় এর আগেই এসেছে। তবু, মেয়েটা সবকিছু যুক্তিতে বিচার করছে, এটা তার ভাল লাগছে। হঠাৎ তানিয়ার কথায় তিনি কান খাড়া করলেন-
"পাপা, এখানে আয়রন সালফাইডের ভূমিকা কী?"
"কী বললি? আয়রন সালফাইড?"
"হুম, দেখছো না, নিচে একটু আলাদা করে লেখা - এফ ই এস-টু।"
ওয়াদুদ আবার তাকালেন,
I kill Judas’ mam
Jami kill Masud
FeS2
FeS2 তিনি দেখেছিলেন, তবে এর মানে বুঝতে পারছিলেন না। ভাবছিলেন, কোনও কিছু'র নামের ইনিশিয়াল, এখন দেখছেন একটা মেটালের সংকেত। ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে গেল।
ভুরু কুঁচকে ওয়াদুদ আবার নতুন করে সবটা ভাবতে বসলেন। মৃত্যুর আগে এটা কী ধাঁধাঁ লিখে গেলেন রাজিব রায়হান? কী বের হয়ে আসবে এর উত্তর থেকে?
তিন.
সেই সকালেই ইনস্পেক্টর ওয়াদুদ'কে আবার ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে পড়তে হল। সরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চাপ আসছে। এই তদন্ত টপ প্রায়রিটি দিয়ে দেখতে হবে। রাজিব রায়হান সরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী'র কাছের মানুষ ছিলেন। ওয়াদুদ আবার গেলেন মার্ডার স্পটে। এবার আরও অনেক কিছু খেয়াল করতে হবে। ভিকটিমের সামনের দিকে কী ছিল, আর আয়রন সালফাইডের যোগসূত্রও বের করতে হবে। এর মাঝে তানিয়ার কাছে জেনে এসেছেন, আয়রন সালফাইড ধাতুটাকে Fools Gold-ও বলা হয়, কারণ দেখতে অনেকটা স্বর্ণ বলে ভুল হয় ! খুনি'রা কি তাহলে স্বর্ণ মনে করে দামি কিছু চুরি করতে এসেছিল? জুডাস-জামি-মাসুদ-বোকার স্বর্ণ -- সবটা কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে...
তানিয়া'র সারাদিন কোনও কাজ নেই বাসায়। সকাল থেকে বিভূতিভূষণের উপন্যাস পড়ছিল। এখন অলস দুপুরে হঠাৎ পাপা'র সকালের কেস-টা নিয়ে ভাবতে বসল। ভাবা'র মত তেমন বেশি কিছু নেই অবশ্য। শুধু ওই তিনটা লাইন,
I kill Judas’ mam
Jami kill Masud
FeS2
লাইন তিনটা একটা কাগজে লিখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। হঠাৎ উপরের দুই লাইনের দিকে তাকিয়ে তানি স্থির হয়ে গেল ! আবার দেখল, কোনও ভুল হচ্ছে না তো? না। এতবড় একটা জিনিস কাকতালীয়ও হয় কি করে? তানি ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে তূর্য'কে ডাকতে গেল।
তূর্য'রা তানি'দের নীচতলায় থাকে। তূর্য ক্লাস এইটে পড়ে - তানি'র চেয়ে এক বছরের ছোট। সে-ই দরজা খুলল, "তানি'পু? পাগল হয়ে গেছো নাকি? এত জোরে দরজায় নক করছো?"
"তূর্য, কুইক আমার ঘরে আয়। দেরী করবি না ! জলদি !"
তূর্য একটু অবাক হল। তানি'পু মাঝে মাঝে একটু পাগলামি করে, কিন্তু কখনও তাড়াহুড়া করে না ! আজ তো তার গলা রীতিমত কাঁপছে। কোনও ঝামেলা হল নাকি? সে দ্রুত তানিয়ার পেছন পেছন উপরের তলায় উঠে গেল।
"তূর্য চুপচাপ বস্। এখন যা বলব খুব খেয়াল করে শুনবি!"
"কী হইছে? তুমি লুকায় বিয়ে করে ফেলসো?"
"উফফ, বললাম চুপচাপ শুনবি !" ধমক শুনে তূর্য চুপ হয়ে গেল।
"শোন, কাল মাঝরাতে একটা ব্যবসায়ী খুন হইসে। মারা যাওয়ার আগে লোকটা শুধু তিনটা লাইন লিখে যেতে পারসে। লাইন তিনটা দেখ", তানিয়া কাগজটা তূর্য'র হাতে দিল।
"আমি বুঝতে পারছি না, এসব তুমি কোথায় পেলে?"
"পাপা'র কেস ফাইল থেকে"
"কী বল এসব? আঙ্কেল তোমাকে মার্ডার-কেস সলভ করতে দিসে?" তূর্য চোখ বড় বড় করে বলে উঠল !
"উফফ, তুই এত কথা বলিস কেন? একটা মিনিট চুপচাপ শুনতে পারিস না? পাপা দেয় নাই। আমি নিজেই ক্লু'টা নিয়ে ভাবতেসিলাম, এখন মনে হচ্ছে একটা লিঙ্ক ধরতে পারছি। তোকে ডাকলাম ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে"
তূর্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল - এই মেয়ে এসব কী বলে। তারপর আস্তে আস্তে বাঁকা হেসে বলল, "তানি'পু? তুমি ফেলু'দি হবা?"
"তূর্য", তানি মুখ শক্ত করল, "তুই যদি সবটা ফাজলেমি মনে করিস, তাহলে এখন বের হ এখান থেকে"
তূর্য কথাটা বলেছিল শুধু তানিয়াকে রাগিয়ে দিতে। তানিপু'কে রাগলে আরও সুন্দর দেখায়। তানিপু সেটা জানে না। সুন্দরী মেয়েরা যখন তাদের সৌন্দর্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে, তখন সেটা ভয়াবহ সুন্দর একটা ব্যাপার হয় ! তানিপু'র জামাই নিশ্চয়ই ওকে ঘন্টায় ঘন্টায় রাগাবে।
তূর্য সোফায় বসেই কাগজটা টেনে নিল, "আচ্ছা দেখছি।"
অনেকক্ষণ লাইনগুলো'র দিকে তাকিয়ে সে মুখ তুলল। তানিয়া উৎসুক চোখে তাকিয়ে বলল, "কি বুঝলি?"
"বুঝলাম, লোকটা জুডাসের ম্যাডাম'কে খুন করসে; ওদিকে জামি খুন করসে মাসুদকে। আর লোকটা শেষে নিজের নাম সাইন করসে FeS2। জামি আর এই FeS2 লোকটা কী একই দলের ছিল? FeS2 যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে মনে হচ্ছে শুধু জামি বেঁচে আছে। ওকে ধরা দরকার"
তানিয়া হা করে রইল, "এই বুঝলি তুই?"
"পরিস্কার"
"অন্য কিছু মনে হচ্ছে না?"
"কী মনে হবে?"
"শোন, FeS2 মানে আয়রন সালফাইড। আধঘন্টা আগে পাপা ফোন করসিল এই আয়রন সালফাইড বিষয়ে জানতে। কারণ জুডাস, জামি, মাসুদ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি যাদের সাথে রাজিব রায়হানের কোনও যোগসুত্র ছিল।"
"তাহলে মরার আগে এদের নাম কেন লিখবে?"
"সেটাই তো ইন্টারেস্টিং !"
"তানি'পু আমি কিছু বুঝতেসিনা। প্লিজ তুমি কী বুঝছো আমাকে বলো। নাহলে আমি গেলাম"
"আচ্ছা শোন। আমার মনে হচ্ছে, আসলে নামগুলা ইম্পরট্যান্ট না, পুরো লাইনটাই ইম্পরট্যান্ট"
"পার্থক্যটা কী?"
"দেখ দু'টা লাইনেই গ্রামারে সমস্যা। প্রথম লাইনে 'I killed' না লিখে সে লিখসে 'I kill'। আর পরের লাইনে হওয়ার কথা 'Jami kills' বা Jami killed'..."
"একটা লোক মারা যাওয়ার আগে ২-৩টা লাইন লিখসে, তুমি সেখানেও গ্রামার ভুল ধরবা?"
"ভুল ধরতেসি না ! আমি বলতেসি ভুল'টা ইচ্ছে করে করা ! নাম ভুলে যা। লাইন গুলো পড়। প্রতিটা শব্দ। প্রতিটা অক্ষর..."
"অক্ষর?", তূর্য হাত তুলল, "দাঁড়াও দাঁড়াও ! প্রথম লাইনে যে অক্ষরগুলা আছে, সেকেন্ড লাইনেও সেই একই অক্ষরগুলা !"
"এক্সাক্টলি !", তানি খুশিতে লাফ দিয়ে উঠল !
"এখানে খুশি হওয়ার কি আছে?"
"গাধা, বুঝছিস না, এটা একটা অ্যানাগ্রাম ! এই জন্যে লোকটা গ্রামার ভুল করেও এমনভাবে লিখসে যেন অক্ষরগুলা ঠিক থাকে"
"কিন্তু এটা কী সম্ভব? তুমি আমাকে খুন করলে আমি সেই মুহুর্তে তোমার নামের অ্যানাগ্রাম করতে পারব?"
"হুম, এই পয়েন্ট'টাই শুধু ভাবাচ্ছে। তবে, হতে পারে ভিকটিম আগে থেকেই খুনিকে চিনত। সে আগে থেকেই পরিচিতদের নামের অ্যানাগ্রাম করতে পছন্দ করত। অথবা, সে অসাধারণ বুদ্ধিমান কেউ ছিল, যে সেই মুহুর্তে এটা করসে। অনেক কিছু হতে পারে। সব ভুলও হতে পারে। কিন্তু লোকটা শুধু ২টা লাইন লিখে গেসে, আর সেই ২লাইনের সব অক্ষর একই - এটা কাকতালীয় ভাবতে কষ্ট হচ্ছে !"
"তা ঠিক। আর আয়রন সালফাইড?"
"ওটাই তো মজা !" তানি মুচকি হেসে বলতে শুরু করল... তূর্য প্রায় অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সবশেষে তানি একটা শাদা কাগজ এগিয়ে দিল, "চল, এবার অ্যানাগ্রাম সলভ করতে শুরু করি"
দুই কিশোর-কিশোরী কাগজে লিখতে লিখতে একসময় উত্তেজনায় তাদের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসল !
চার.
সন্ধ্যা'র আগে ইনস্পেক্টর ওয়াদুদ বাসায় এলেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবেন বলে। সারাটা দিন টিমের সবাই মিলে জোর তদন্ত করে যাচ্ছে, কোনও অগ্রগতি নেই। জুডাস-জামি-মাসুদ নামে কারও যোগসাজশ পাওয়া যায়নি। একজনকে পাঠিয়েছেন পুরোনো ফাইল ঘাঁটতে - 'মাসুদ হত্যাকান্ড' নামে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে। তিনি নিজে রাজিব রায়হানের ডায়েরী আর সাম্প্রতিক অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিস্ট নিয়ে এসেছেন, স্টাডি করার জন্যে। জুডাস নামটা তার খুব মনে ধরছে। এটা বিদেশী কারও নাম হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। তবে সকালে তানি'র কথা শুনে মনে হয়েছে এটা নাম না হয়ে সিম্বলিক কিছু'ও হতে পারে। যীশু'র সহচরদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা করে যে যীশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল, তার নাম ছিল জুডাস। তাই 'জুডাস' শব্দটা 'প্রতারক' অর্থেও ব্যবহার হতে পারে। 'আয়রন সালফাইড' আর 'জুডাস' ২টা তথ্যই তানি'র কাছ থেকে পাওয়া। ১৪-১৫ বছর বয়সের এই মেয়ের এত কিছু জানার দরকারটা কী?
ওয়াদুদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ের বন্ধু-বান্ধব খুব বেশি নেই যাদের সাথে হইচই করে বেড়াবে। তিনিই ছিলেন কাছের বন্ধু। তিনি যত ব্যস্ত হয়েছেন, তানি ততই বইয়ের দিকে ঝুঁকেছে। অতিরিক্ত বইপাগল মানুষের বন্ধু-বান্ধব কম হওয়াটা মনে হয় স্বাভাবিক।
ওয়াদুদ দরজা খুলতেই তানি ছুটে এল, "পাপা, আসছো? আমি এখন তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম!"
"কি রে মা?"
"লোকটা মারা যাওয়ার সময় কিসের দিকে তাকিয়ে ছিল?"
ওয়াদুদ কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। "মা, তুই শান্ত হ। এটা নিয়ে এত ভাবতে হবে না।"
"কেস সলভ হয়ে গেছে?"
"না, হয়নি", ওয়াদুদ হাসলেন, "এত সোজা নাকি। বাট ইয়াং লেডী, ইউ শুড কাম ডাউন নাউ। সারাদিন কী এই নিয়ে ভাবছিলি নাকি?"
"পাপা?", তানিয়া সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করল, "লোকটা কি বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে ছিল?"
ওয়াদুদ এবার সিরিয়াসলি তাকালেন। তানিয়ার এটা জানার কথা না। ওয়াদুদের চোখ দেখে তানিয়া জবাব'টা বুঝে নিল। সাথে সাথে বলল, "পাপা, স্পটে এখন তোমার কোনও অফিসার আছে?"
"তারেক আছে হয়তো। এতক্ষণে বেরিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু... কী ব্যাপার বল তো?"
"তুমি ওই তারেক'কে ফোন করে বলো ঐ বুকশেলফের কাছে যেতে", তানিয়ার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে।
ওয়াদুদের মাথায় কিছু ঢুকছে না। তিনি নিজেও টের পেলেন না, কখন তারেকের নাম্বার ডায়াল করে কথা বলতে শুরু করেছেন।
"দেখতে বলো, শেলফে The Silence Of The Lambs নামে কোনও বই আছে কি না", তানি বলে চলেছে।
"কী হবে ঐ বইয়ে?"
"তুমি দেখতে বলো তো?"
"তারেক, একটু খুঁজে দেখো তো ওখানে The Lambs - কী যেন বললি - ওহ The Silence Of The Lambs নামে কোনও বই আছে কি না?"
তারপর অনেকক্ষণ নীরবতা। তারেক যখন কথা বলতে শুরু করল, তখন ওয়াদুদের মুখের রং পাল্টে যেতে শুরু করেছে ! তিনি হতচকিত চোখে তানি'র দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঐ নামে বই নেই, তবে একটা ডিভিডি বক্স পাওয়া গেছে। শেলফের একদম সামনের দিকে। তানি, কী হচ্ছে এসব?"
"পাপা, তুনি ফোন রাখো।", তানি কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, "আমি শিউর ছিলাম এটা অ্যানাগ্রাম, তবু শিউর হওয়ার জন্যে বইটার কথা জানতে চাইলাম।"
"অ্যানাগ্রাম?"
"হ্যাঁ, এবার বলো, জাকিউল ইসলাম নামে কেউ আছে ঐ ভিকটিমের সাথে পরিচিত? মোহাম্মদ জাকিউল ইসলাম?"
ওয়াদুদ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রাজিব রায়হানের গত সপ্তাহের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিস্টে জাকিউল ইসলাম নাম'টা তিনি দেখেছেন। তানি এসব কোত্থেকে কী বলছে?
তানি হাতের কাগজটা ওয়াদুদের সামনে রাখল, "পাপা দেখো, ভিকটিমের লেখা দুইটা লাইনেই হুবহু একই অক্ষরগুলা আছে। প্রায় পারফেক্ট অ্যানাগ্রাম, গ্রামারে কিছু ভুল আছে। আমরা ঐ অক্ষরগুলা উল্টে পাল্টে যতগুলা অর্থবোধক নাম বা লাইন বানানো যায়, চেষ্টা করেছি। পুরোপুরি মিলে গেছে, এমন প্রথম নামটা হল - Md Jakiul Islam"
ওয়াদুদ নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাগজটা দেখতে লাগলেন। পুরো কাগজে এই কয়েকটা অক্ষর ব্যবহার করে অসংখ্য লাইন লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ওতে Sami, Jamal, Kislu, Alam - এরকম অনেক নাম দিয়ে পুরোটা মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শেষটায় Md Jakiul Islam নামটা হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে স্টার চিহ্ন দিয়ে রাখা।
"পাপা, এই নামে যদি কেউ না থাকে তবে আরও চেষ্টা করা যাবে। তবে অ্যানাগ্রাম ব্যাপারটা নিশ্চিত হলাম ঐ 'আয়রন সালফাইড' আর The Silence Of The Lambs বইটা ওখানে থাকায়।"
"মানে?"
"লোকটা মারা যাওয়ার আগে শেষবারের মত ঐ ডিভিডি'টা দেখিয়ে গেল, আর লিখে গেল 'আয়রন সালফাইড' ! এর একটাই কারণ, এটা একটা সুপারহিট মুভি, একটা ক্ল্যাসিক ! বেশিরভাগ লোকেরই এটা দেখা থাকার কথা। আর এই মুভি'তে 'আয়রন সালফাইড' কথাটা ব্যবহার করা হয়েছিল অ্যানাগ্রাম হিসেবে, পুলিশকে বোকা বানানোর জন্যে ! তাই এই রাজিব রায়হান এই ২টা ক্লু'তে পরিস্কার বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও অ্যানাগ্রাম ব্যবহার করছেন। আর এই Md Jakiul Islam হল সেই অ্যানাগ্রামের প্রথম সম্ভাব্য জবাব। যদি আরও ট্রাই করা যায়..."
"তানি !", ওয়াদুদ এসে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন ! তার কেসে এই প্রথম একটা জোরালো লিড তিনি পেয়ে গেছেন !
********************************************************************
পরবর্তী সংবাদ: অ্যাপয়েন্টমেন্টের সূত্র ধরে মোহাম্মদ জাকিউল ইসলাম আর তার সহযোগী সোহরাব হোসেন'কে ধরা গেল পরদিন দুপুরের পর। তারা খুনের পর তাদের এলাকা ছেড়ে পালানোর কোনও প্ল্যান করেনি। কারণ তাদের পরিকল্পনা ছিল একদম নিখুঁত, কোনও সূত্র তারা রেখে আসেনি ! দুজনই সারাক্ষণ গ্লাভস পড়ে ছিল, পায়ের মাপের চেয়ে ২ সাইজ বড় জুতা পড়ে ছিল, কথা বলেছে কন্ঠ পালটে, নাম ব্যবহার করেনি, সব আলামত ধ্বংস করে এসেছে। তাই পালানোর কোনও কারণ ছিল না। বরং ভিকটিমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লিস্টে থাকা ২জন লোক খুনের পরদিন থেকে শহর ছেড়ে গেলে সেটাই হত সন্দেহজনক।
পরিকল্পনায় তারা যথেষ্ট স্মার্ট ছিল, তবে রাজিব রায়হানের বুদ্ধিমত্তার কাছে সেটাও দেখা গেল অপর্যাপ্ত।
আর, তানিয়া নামের কিশোরী মেয়েটার কথা কারও জানা হয়নি। কোনও সংবাদ মাধ্যমে আসে নি। তদন্ত যখন এগোচ্ছিল, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে একসময় অ্যানাকোন্ডা'র ছায়া প্রকট হতে শুরু করল। রাজিব রায়হান হত্যাকান্ড ছিল একটা ধারাবাহিক নাশকতা'র ধাপ মাত্র। এর পেছনে বেশ বড় চক্রের দেখা মিলতে শুরু করল। ইন্সপেক্টর ওয়াদুদ তার মেয়েকে কোনও চক্রের টার্গেট বানানোর ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না।
হয়তো কোনও একদিন যখন চক্রের গোড়ায় হাত দেয়া যাবে... হয়তো... ফলো-আপ নিউজে তখন তানি'র এই চমকপ্রদ গল্পটা লোকে জানবে। হয়তো বা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৩ ভোর ৫:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




