প্রথম অংশের লিঙ্ক
তিন.
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর থেকে তানিয়া ছটফট করতে লাগল। লাইনগুলো মাথা থেকে সরছে না। ফেসবুক খুলে একটা মেসেজ লিখে পাঠালো - "শাহেদ ভাই, 'অদিতি' শব্দের মানে জানো? আর্জেন্ট"। মেসেজ পাঠানোর পর পরই তানি'র মনে হল, কাজটা একদম অনর্থক করা হল। শাহেদ ভাই নিশ্চয়ই এই মেসেজ চেক করবে দুই-তিন সপ্তাহ পর। সে ব্লগে আর ফেসবুকে নিয়মিতভাবে অনিয়মিত। (শাহেদ খান এই মেসেজের জবাব দিয়েছিল সতের দিন পর। দুই অক্ষরের জবাবটা ছিল "জানি না")
ঘরে একটা বাংলা ডিকশনারী না থাকাতে তানি'র এখন আফসোসের সীমা রইল না। সে পিসিতে পেইন্টিং'টা খুলে আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছয়টা তারা... আকাশের সিক্স সিস্টার্স বা কৃত্তিকা-মন্ডলের কিছু কি? না, ছয়টা তারা হয়তো যাস্ট এই ছয়টা পেইন্টিং-ই। তারা'র মত জ্বলজ্বলে ক্যানভাস। এত দামি সব ছবি - কার কার পেইন্টিং আছে ওখানে? ফ্রান্স থেকে কেনা, ইম্প্রেশানিস্ট'দের কারও ছবি থাকা কি খুব অস্বাভাবিক? ক্লদ মনে'? রেনোয়া? তানি'র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।
সে আবার কাগজটা বের করল:
কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া
নিখুঁত এবং বিস্তারিত
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত
বাংলো'র কম্পাউন্ডে কোথাও কৃষ্ণচূড়া গাছ নেই। ছবিতে কোথাও কি কৃষ্ণচূড়া আঁকা হয়েছে? তানি আবার খুঁটিয়ে দেখল - না; কোথায় কী! অথচ বলা হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া'র দীর্ঘ ছায়া সময় পেলেই ওদের এসে জড়িয়ে নিত। গাছের আবার সময়ের কী অভাব। তাহলে 'সময়' দিয়ে কী বোঝাচ্ছে - একটা নির্দিষ্ট সময়েই গাছটার ছায়া ওদের এসে জড়িয়ে নিত? মানে কী ! পেইন্টিংসগুলো নিশ্চয়ই গাছতলে ফেলে আসেন নি। ঠিক তখনই তানি'র মাথায় খেলে গেল, বনের মাঝে কোথাও কোনও কটেজ নেই তো ! হয়তো বাংলো'র সাথে লাগোয়া না ! তাই পুলিশের খেয়ালে আসে নি ! একটা কটেজ বা রুম, কোনও একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশে - তানি অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগল। জায়গাটায় যদি একবার যাওয়া যেত ! উফফ, এভাবে কী হয়? তাও আবার একা ! পাশে একটা কেউ থাকলেও কথায় কথায় হয়তো অনেক নতুন কিছু বের হয়ে আসতো। রাত হয়ে গেছে অলরেডী, পাপা নিশ্চয়ই ঘুম।
আগের রাতেও ভালমত ঘুমায়নি, তাই তানি'রও আস্তে আস্তে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে লাগল।
রাত প্রায় দুইটা পঁয়তাল্লিশের দিকে তানি ছুটে পাপা'র দরজায় জোরে আঘাত করতে লাগল ! "পাপা ! ওঠো ! পাপা !"
ওয়াদুদ ঘুম ভেঙে হতচকিত অবস্থায় ছুটে এলেন, "কি রে ! কী হলো?"
"পাপা, অদিতি মানে পৃথিবী ! দি আর্থ !"
"কী?", ওয়াদুদ চোখ কচলে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলেন, "কী হচ্ছে এখানে?"
"তোমার ওই ছবি'র ধাঁধাঁ ! অদিতি'র বুকে মানে পৃথিবী'র বুকে লুকানো !"
ওয়াদুদের ধাতস্থ হতে সময় লাগল। তানি চিরকালই শান্ত মেয়ে, তাকে এতটা অস্থির দেখে ওয়াদুদও অভ্যস্ত না। একটু সময় নিয়ে বললেন, "কী বলছিস, বুঝতে পারছি না। সবটা আবার বল তো?"
"শোনো, 'অদিতি'র একাধিক মিনিং আছে। রানা ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম। তার মাঝে একটা অর্থ হচ্ছে - পৃথিবী"
"রানা ভাইটা কে? সে এত রাতে এখানে কী করে?"
"উফফ পাপা ! গীতিকার রানা ভাই, দলছুটের গান লেখে। লোকটা শব্দ-শিল্পী। উনার ব্লগ থেকে জানলাম। আচ্ছা, এখন শোনো। ছবিগুলো অদিতি'র বুকে মানে মাটির বুকে লুকানো !"
ওয়াদুদ ঘড়ির দিকে তাকালেন, "কাল সকালে উঠতে হবে না?"
"না, কাল শুক্রবার ! তোমার এই অবস্থায় ঘুম আসছে কী করে?"
"আচ্ছা ঠিকাছে", ওয়াদুদ হাসলেন, "এখন বল, লোকটা পেইন্টিংগুলো মাটিতে পুঁতে রাখতে যাবে কেন? এ তো মধ্যযুগীয় স্টাইলে গুপ্তধন রাখা। ডাজ ইট মেক সেন্স? শহরে কোনও সেফটি ভল্টে রাখলেই পারতো।"
"এটাও ভেবেছি। ভুলে যাচ্ছো, উনি থাকতেন শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ী এলাকায়। শেষ দিকটায় নীল'কে সন্দেহ করতে শুরু করছিলেন। তাই হয়তো ছবিগুলো গাড়ি করে এতদূর আনার রিস্ক নিতে চান নি। কারণ নীল যদি টের পেয়ে যেত, পাহাড়ী নির্জন পথে ওই গাড়ি লুট করা হতো ওয়ান-টু'র ব্যাপার। তাই বাংলো'র আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে রাখলেন পেইন্টিংসগুলো"
"হুম, সো ইন এ ওয়ে, ইট মেক সেন্স"
"যাস্ট ইন আ ওয়ে, বাট আরেকটা ওয়ে থাকতে পারে। ঐ এলাকায় আশেপাশের বনে কোনও কটেজ আছে কি না বলতে পারো? যেখানে কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছও থাকতে পারে?"
"তাই তো ! কৃষ্ণচূড়া তো ক্লু-তে ছিল ! লোকটা দেখি ডেন্জারাস ক্লু রেখে গেছে !"
"হুমম", একটু থেমে তানি বলল, "তবে, 'অদিতি'র মিনিং জানার পর থেকে কটেজ'এর কথা আর ভাবছি না। বরং এটা কৃষ্ণচূড়া গাছের আশেপাশে কোথাও মাটিতে পুঁতে রাখা !"
"শাবাশ তানি ! দুই রাতে তুই অনেকদূর সলভ করে ফেলেছিস ! এখন ঘুমাতে যা। কাল সকাল-সকাল তোর সাথে এটা নিয়ে বসব। প্রমিজ", ওয়াদুদ হেসে তাকালেন।
"এসব ধাঁধাঁ'র সমস্যা কি জানো?", তানি চোখ তুলে তাকালো, "কনফিউজ করার জন্যে এর একাধিক মিনিং থাকতে পারে। হয়তো আমরা পুরো উল্টো পথে আগাচ্ছি ! হয়তো !"
"ডোন্ট ও'রি", ওয়াদুদ এসে তানি'র মাথায় হাত রাখলেন, "উল্টো পথটা যদি ঠিকমত আবিষ্কার করতে পারিস, সোজা পথ খুঁজে পেতেও তোর সময় লাগবে না। দেখবি।"
তানি হালকা হেসে রুমে চলে গেল।
আজ তার মোটামুটি গভীর ঘুম হল।
চার.
তূর্য প্রথমে পিসি স্ক্রীনে ছবিটার দিকে তাকালো, তারপর হাতের কাগজটা একবার দেখল, এরপর মুখ তুলল তানি'র দিকে, "কী মারাত্মক গল্প শোনালে তানি'পু ! এই সব রিয়েলি হচ্ছে ! ওয়াও !"
"এবার তুই কী ভাবছিস সেটা বল"
"আমি ভাবার সময় পেলাম কোথায়? মাত্র তো গল্পটা শুনলাম !"
"হুম", তানি মাথা নাড়ল, "আমি এখন আবার শুরু থেকে প্রতিটা লাইন ধরে আগাচ্ছি। ছয়টা তারা এসে পৃথিবী'র বুকে লুকালো, মানে পেইন্টিংসগুলো; চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটল জুনের ২০-২১ তারিখের দিকে। তখন কোনও এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া খুব নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট একটা সময়ে ওদের এসে জড়িয়ে রাখল"
"সময়টা কিভাবে জানবি?", ওয়াদুদ হাতে করে বড় বাটিতে সরষে তেল আর পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে এনেছেন। চুলায় চায়ের পানি বসানো।
তানি মুখ তুলল, "সেটাই। উনি বলছেন - 'যখন সময় পাই - তখনই'। এখানে একটা গন্ডগোল আছে। উনি কথাটা বলেছেন ফার্স্ট পার্সনে - 'যখন সময় পাই'। যদি গাছটার সময় পাওয়ার ব্যাপারে বলতেন, তাহলে বলা উচিৎ ছিল -'যখন সময় পায়'। তা না করে নিজের সময় পাওয়ার কথা বললেন। সবটা আবার এলোমেলো লাগছে"
"তুমি এখানেও গ্রামার ভুল ধরবা? 'পায়' লিখতে গিয়ে 'পাই' লিখে ফেলসে হয়তো"
"তূর্য শোন, এটা আমাদের একমাত্র ক্লু ! এটা নির্ভুল ধরেই আপাতত আগাতে হবে। প্রতিটা শব্দই ইম্পর্ট্যান্ট"
"তাই বলে একটা 'পাই' আর 'পায়' নিয়ে এতটা ভাবতে হবে? আমার তো মনে হয় না এই 'পাই-পায়' নিয়ে এত ভাবার কিছু আছে"
ওয়াদুদ সেই মুহুর্তে চা-র ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলেন, "কী সব পাই-পাই করছিস ! কী পাচ্ছিস এত? আচ্ছা, তোদের পাই-পাই শুনে মনে পড়ল। 'লাইফ অফ পাই' মুভিটা চলছে হল-এ। থ্রি-ডি ! ইভনিং শো-তে কে কে যেতে রাজি?"
তূর্য একগাল হেসে হাত তুলল। দুজনই তানিয়ার দিকে তাকাল। তানি স্থানুর মত স্থির হয়ে আছে ! চোখের পাতা'ও নড়ছে না !
ওয়াদুদ হাসি থামিয়ে বললেন, "কীরে তানি, কেস সলভ না করা পর্যন্ত আমরা মুভিও দেখতে পারবো না?"
"পাপা !", তানি ফিসফিস করে বলে উঠল, "ইটস পাই !"
"মানে?"
"পাই, মানে পাওয়ার কথা বলা হয়নি। তুমি এইমাত্র যেমনটা বললে -'পাই' শুনে তোমার 'লাইফ অফ পাই' মনে পড়ল ! আসলে 'পাই' একটা আলাদা শব্দ। এর নিজেরই একটা ভ্যালু আছে !"
তূর্য আস্তে আস্তে বলল, "থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফোর?"
"ইয়েস ইয়েস !", তানি প্রায় চিৎকার করে উঠল, "সময় যখন পাই ! ইউ নো, মার্চের ১৪ তারিখ'কে পাই-দিবস বলা হয়। ৩টা ১৪ মিনিট : পাই-সময়। সময় যখন পাই - মানে সময় যখন সোয়া তিন'টার মত ! ঐ সময়ের ছায়া ফলো করতে হবে ! জুনের ২১ তারিখ সোয়া তিনটার সময়ের একটা নির্দিষ্ট ছায়া !"
ওয়াদুদ আর তূর্য দুজনেরই হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগল। ওয়াদুদই খানিক পর নীরবতা ভাঙলেন, "জানি না, তুই যেটা বলছিস সেটাই এই ধাঁধাঁ'র মিনিং কি না। তবে যদি সত্যি এটাই হয়, তাহলে এটা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট পাজল। আর তুই আমার দেখা সবচেয়ে ইনটেলিজেন্ট মানুষ !"
ওসব কোনও কথা তানি'র কানে যায়নি। সে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, "আমি জানতাম, এখানে সময়টাও লেখা আছে। আমি জানতাম... এত মারাত্মক একটা ধাঁধাঁয় বানান ভুল করে 'পাই' লেখার প্রশ্নই আসে না ! এত অল্প কয়েকটা লাইনে কোনও ভুল থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করিনি।"
বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা'র পর তূর্য বললো, "তাহলে কৃষ্ণ আর চূড়া'র মাঝে দেয়া হাইফেন-টাও নিশ্চয়ই ভুল করে দেয়া হয়নি। ওটারও নিশ্চয় মিনিং আছে?"
"কী বললি তুই?", তানি তূর্যের হাত থেকে কাগজটা প্রায় কেড়ে নিল।
তূর্য আমতা আমতা করে বলল, "আরে আমি তো এমনি বললাম। মাঝখানে হাইফেন দিয়ে তো কেউ কৃষ্ণচূড়া লেখে না..."
"গুড!", তাকে থামিয়ে দিয়ে তানি সোজা ওয়াদুদের দিকে তাকাল, "পাপা, এই পিসি স্ক্রীনে দেখে হবে না। আসল ছবিটা আবার দেখতে হবে। তোমার অফিসে চলো।"
ওয়াদুদ এক সেকেন্ড থেমে বললেন, "ওকে চল।"
তার ধারণা, তানি রহস্যটার সমাধানের কাছাকাছি চলে গেছে। এখন 'না' বলার প্রশ্নই আসে না।
পাঁচ.
ইনস্পেক্টর ওয়াদুদের টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে সমর সেনের শেষ পেইন্টিংসটা দেখছিল ওরা। ওয়াদুদ, তানি, তূর্য। সাব-ইনস্পেক্টর তারেকও ছিল আশেপাশে। এদের কথা শুনে আগ্রহী হয়ে এখন সেও এসে জুটেছে। সবাই ছবিটাতে কিছু খুঁজছে, কিন্তু ঠিক কী যে খুঁজতে হবে এই বিষয়ে কেউই আসলে নিশ্চিত না।
অনেকক্ষণ নীরবতার পর তানি আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, "সমর সেন শেষদিন পর্যন্ত এই পেইন্টিংস'টাকেই গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন সময় অল্প। হয়তো তার ধারণা ছিল নিজে এঁকে শেষ করতে পারবেন না। তাই চারুকলার এক শিল্পীকে দিয়ে তাড়াহুড়া করে ছবিটা আঁকিয়ে নিয়েছেন। পরে তিনি ডিটেইলসের কাজ করেছেন..."
তূর্য বলে উঠল, "কিন্তু সময় তো ছিল ! উনি এটা আঁকার জন্যে পরে আরও এক সপ্তাহ সময় পেয়েছেন..."
"আরে?", তানিয়া বিরক্ত চোখে তাকাল, "উনি কি জানতেন নাকি কোনদিন ডাকাত পড়বে? যেদিন রাতুল ছবিটা এঁকে এসেছিল ওই রাতেও তো ডাকাত-হামলা হতে পারত !" তূর্য চুপ হয়ে গেল, তানিয়া একটু শান্ত হয়ে বলতে থাকল, "শেষদিকে পুরো সময়টাতেই সমর সেন ঝুঁকি'র মধ্যে ছিলেন। এর মাঝে পেইন্টিংসটা শেষ করলেন। আর আরও ইম্পরট্যান্ট হল, উনি তারপর আলো-ছায়া নিয়ে আরও ডিটেইলস কাজ করলেন।"
সাব-ইনস্পেক্টর তারেক ওদের সকালের আলোচনার কথা জানেনা। সে অবাক বিস্ময়ে তানিয়ার কথা শুনতে লাগল। তানি বলে গেল, "কিন্তু ছবিটা এত সিম্পল, এখানে বিশেষ কোনও ছায়াই তো ধরতে পারছি না... কৃষ্ণ আর চূড়া আলাদা করে লেখার মানে টা কী? পাপা? কৃষ্ণ নামে কোনও গাছ আছে?"
"আমার জানা মতে নেই", ওয়াদুদ বললেন। তারেকও মাথা নাড়ল।
"অথবা... অথবা", তানি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, "ওনার কাছে কৃষ্ণ নামে কোনও ভাস্কর্য ছিল? আর্ট কালেকটর ছিলেন, ভাস্কর্যও তো জমাতে পারেন... লম্বা কোনও মূর্তি যেটা হয়তো এই ছবিতে নেই..."
ওয়াদুদ একটু দ্বিধায় বললেন, "এই ছবি'র বাইরের কোনও কিছুর ছায়া যদি বোঝাবেন, তাহলে এই ছবির গুরুত্বটা কী?"
"হয়তো ছবিটা যাস্ট একটা ক্যামোফ্লাজ; হয়তো এটা কোনও ক্লু-ই না, শুধু ছড়াটাই ক্লু ! উফফ পাপা !", তানি টেবিলে মুখ ঢেকে বসে পড়ল, "আমি আর পারছি না..."
ওয়াদুদ আস্তে করে তানি'র মাথায় হাত রাখলেন, "তোকে কেউ জোর করছে না, মা। তুই শান্ত হ।"
"আপনি যতদূর এগিয়েছেন, আর কেউ এতটা ভাবেও নি", ওপাশ থেকে তারেক বলে উঠল।
তানি মাথা নিচু করে রইল, আর অপেক্ষা করতে লাগল তূর্য যেন এখন বোকার মত কিছু একটা প্রশ্ন করে বসে। প্রায় সময়ই তূর্য হঠাৎ হালকা প্রশ্ন করে ওঠে আর তাকে বোঝাতে গিয়ে তানি তখন আবার নতুন করে ভাবতে পারে।
ঠিক ঠিক তূর্যই প্রশ্ন করে উঠল, ছবি'র একদম বামপাশে আঙুল তুলে, "এখানে এটা লম্বা কিসের ছায়া?"
সবাই সেদিকে তাকালো। মাঠের বামপাশে, সবুজ ঘাসের মাঝে সরু আর দীর্ঘ একটা ধুসর অংশ। বাংলো থেকে শুরু করে সরলরেখায় মাঠের এক কোণে চলে গেছে। তানি একবার তাকিয়েই বলল, "ওটা ছায়া না, সম্ভবত পায়ে চলা পথ"
"হুম..."
"অথবা", তারেক মাঝখান থেকে বলে উঠল, "হয়তো ওটা ছায়া-ই..."
"এত লম্বা এটা কিসের ছায়া?", সবাই তারেকের দিকে তাকাল।
তারেক হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "হয়তো বাংলো'র চিমনি'র? স্টুডিও থেকে চিমনি'টা দেখা যাওয়ার কথা না, তবে মাঠের ওপর ছায়া তো দেখা যাবে..."
"চিমনি?", তানি প্রায় চিৎকার করে উঠলো, "বাংলো'তে চিমনি আছে?"
"হুম", তারেক বলে চললো, "লোকটা অদ্ভুত সৌখিন ছিল। একপাশে ফায়ারপ্লেস, আরেক প্রান্তে সুইমিংপুল, কী ছিল না বাংলো'তে?"
"পাপা? চিমনি'র কথা তো আগে বলোনি !"
"ইয়ে মানে, বাংলো'র ডিটেইলস নিয়ে তো কখনও কথা উঠেনি..."
"আচ্ছা, চিমনি'টা কেমন বর্ণনা করতে পারবে?"
ওয়াদুদ তারেকের দিকে তাকাল। তারেক এক সেকেন্ড পরেই বলে উঠল, "তা পারব। তবে বর্ণনা'র চেয়ে ছবি দেখালে বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে..." তারেক তার ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে ছবি এনে দিল।
ছবি'র দিকে তাকিয়ে তানি অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, "দেখতে পাচ্ছো পাপা?"
তূর্য বলল, "হুম, সুন্দর বাংলো"
"বাংলো না গাধা", তানি ধমকে উঠল, "চিমনি'র চূড়া'টা কালো মেটালের। ব্ল্যাক-টপ ! কৃষ্ণ-চূড়া !"
"গুডনেস !", ওয়াদুদ নিঃশ্বাস ফেললেন।
"এখন বুঝতে পারছি কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া", তানি বলে চলল, "উনি ঠিকই নিখুঁত এবং বিস্তারিত এঁকেছেন, কিন্তু চিমনি'টার কথা জানতাম না বলে ওটা যে কোনও কিছু'র ছায়া সেটাই বুঝতে পারিনি আগে !"
"তাহলে এখন?", ওয়াদুদ জানতে চাইলেন, "পুরো ধাঁধাঁটার অর্থ কী দাঁড়ালো?"
"অর্থ দাঁড়ালো - জুনের ২১ তারিখ দুপুর সোয়া তিন'টার দিকে এই চিমনি-চূড়া'র ছায়া ঠিক যেখানে গিয়ে পড়বে - সেখানে কোথাও মাটিতে ছবিগুলো পুঁতে রাখা আছে।"
তারেক চোখ বড় বড় করে এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তূর্য হঠাৎ বলে বসল, "রাত সোয়া তিনটা হতে পারে না?"
"না !", তানি কড়া চোখে তাকালো, "অবশ্যই দুপুর ! রাত তিনটায় তুই ছবির মত এমন ছায়া পাবি কোথায়?"
ওয়াদুদ উঠে দাঁড়ালেন, "তাহলে এত ছায়ার অপেক্ষা করে লাভ কী? মাঠের ওদিকটা পুরো চষে ফেললেই হয়"
"না পাপা !", তানি মাথা নাড়ল, "ছবিগুলো কী অবস্থায় আছে আমরা জানি না। বেকায়দায় খনন করলে নষ্ট হয়ে যাবার চান্সও থাকে। আবার এমন সম্ভাবনাও আছে, হয়তো ছবিগুলো ওখানে নেই। ওখানে গেলে নেক্সট ক্লু'টা পাব শুধু..."
"কী বলিস !"
"যাস্ট বললাম। হতেও পারে। তাই বলছি, সবটা অনর্থক না খুঁড়ে শুধু ছায়াটা যেখানে গিয়ে পড়বে ওখান থেকেই শুরু করা উচিৎ হবে। যেহেতু সূত্রটা - নিখুঁত এবং বিস্তারিত।"
সবটা শোনার পর সবাই মুগ্ধ-বিস্ময়ে খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল।
"শাবাস তানি", ওয়াদুদ পিঠ চাপড়ে দিয়ে নীরবতা ভাঙলেন, "জানিনা এটাই ঠিক উত্তর কিনা। তবে যা দেখালি, সেটাও ক'জন পারতো?"
একটু ইতস্তত করে তারেক প্রশ্ন করল, "আজকে জুলাইয়ের সাতাশ তারিখ। তাহলে ওই 'নিখুঁত এবং বিস্তারিত' লোকেশন'টা পাওয়ার জন্যে আমাদের কী আগামী বছর জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?"
"আমারও একই প্রশ্ন", তূর্যও মাথা নাড়ল।
তানি হালকা হেসে বলল, "না, অফিসার। মাত্র তো মাসখানেক হল। উত্তর গোলার্ধে এখনও গ্রীষ্মকাল। জুনের একুশ তারিখ সোয়া তিনটায় সূর্য যে অবস্থানে ছিল, জুলাই'র সাতাশ তারিখে দুপুর ঠিক কয়টায় সূর্যটা মোটামুটি আবার সেই একই পজিশনে ছায়া ফেলবে - এটা আমি দু'তিন লাইনের অঙ্ক করে বের করে দিতে পারব।"
তানি বাবা'র টেবিল থেকে প্যাড আর কলম টেনে নিল।
"ওহ গ্রেট !", ওয়াদুদের মুগ্ধতা কাটার মত না। তারেকের দিকে তাকিয়ে বলল, "ছবিগুলো পাওয়া গেলে তো হইচই পড়ে যাবে ! আমাদের দেশে তো পেইন্টিংস নিয়ে এতবড় কেলেংকারী আগে কখনও হয়নি বোধহয়, কী বল?"
"না পাপা", তানি খানিকটা আহত কন্ঠে আবার মুখ তুলল, "আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মিউজিয়াম থেকে তাঁর ১৭টা অমূল্য পেইন্টিংস চুরি হয়ে গিয়েছিল ১৯৮২ সালে। পরে ৯৪ সালে দশ'টা উদ্ধার করা হয়। বাকিগুলো'র আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি কখনও"
"কী বলিস ! জানতাম না তো !"
"ওটাই তো দুঃখজনক। আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, আর তার পেইন্টিংস হারানোর কথা আমরা অনেকেই জানিও না। অবশ্য যে পেইন্টিংসগুলো আছে, সেগুলো দেখতেও আমরা ক'জন যাই?"
ওয়াদুদ মাথা নামালেন, "হুম। অথচ ওয়েস্টে জন্মালে এ শিল্পী কী পরিমাণ সমাদর পেতেন..."
"এখনও পান তো !", তানি খানিক খুশিতে বলে উঠল, "জানো পাপা, বুধ গ্রহের একটা আগ্নেয় জ্বালামুখের নাম রাখা হয়েছে 'আবেদীন' ! আমাদের শিল্পাচার্যের নামে ! আমাদের আগুন-পাখি !"
"তাই নাকি? কবে এটা?"
"২০০৯-এর দিকে বোধহয়"
"এ তো খুব আগের কথা না ! আমরা কেউ এ নিউজ জানি না কেন?"
"হয়তো আমরা তখন গম-চুরি, টিন-চুরি'র নিউজ জানায় ব্যস্ত ছিলাম... আচ্ছা বাদ দাও...", তানি মাথা নিচু করে হিসাব করতে বসল। ওয়াদুদ কেমন উদাস চোখে দূরে তাকিয়ে রইলেন। আর নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বললেন, "আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, ক্ষমা কোরো।"
********************************************************************
পরের ঘটনা সামান্য। সেদিন বিকালের মাঝে বাংলো'তে পৌছাঁনো সম্ভব ছিল না। ওয়াদুদ পরদিন তার ফোর্স নিয়ে সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলেন। চিমনি'র ছায়াটা যেদিকটায় নিয়ে গেল, ওখান থেকেই মোটামুটি জঙ্গলের শুরু, তাই ওদিকটা কেউ মাড়ায় না। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানা গেল, ডাকাতির সপ্তা'দুয়েক আগে বাগানে মাটি ভরাট করার জন্যে ওদিক থেকে মাটি খোঁড়া হয়েছিল। হয়তো খনন শেষে কোনও এক নির্জন সময়ে সমর সেন তার অমুল্য সম্পদ'টা ওখানে মাটিচাপা দিয়ে এসেছিলেন - এখানের কেউ সেটা জানত না।
তানি যে সময়ের হিসাব দিয়েছিল, ওয়াদুদ তার প্রায় একঘন্টা আগে থেকেই লোকেশন আন্দাজ করে খনন শুরু করার নির্দেশ দেন, অধৈর্য হয়ে। এতে অবশ্য ছবি'র ক্ষতি হয়নি, তবে তাকে আশেপাশের বেশ অনেকটা জায়গা খুঁড়তে হল।
পেইন্টিংসগুলো একটা তুলনামূলক কম ওজনের মেটাল বক্সে ছিল। ৫জন শিল্পী'র ৬টা ছবি। প্রতিটা ছবির সাথে ক্রয়ের রশিদ আর দরকারি কাগজপত্র সব ছিল। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের কারও পেইন্টিংস ওখানে ছিল না, অন্তত তানি যাদের নাম জানত - এমন কেউ ছিল না। সে আশা করেছিল, একেবারে ক্লদ মনে', রেনোয়া বা পিসারো না হোক, অন্তত বার্থ মরিসে' বা বাযিলে'র ছবি তো একটা থাকতেই পারে। কেউ ছিলেন না। তবে তার চেনা-জানার মধ্যে প্রি-ইম্প্রেশনিস্ট সময়ের আরেক গ্রেট 'গুস্তাভ ক্যুরবে'র এটা ছোট আর্টওয়ার্ক পাওয়া গেল ! তানি ওতেই আনন্দে আত্মহারা !
আর সবশেষে, এই পেইন্টিংস উদ্ধারের গল্পে তানি'র নাম পত্রিকায় এসেছিল; তবে... ছয় নম্বর পাতায়। সেদিন পেপারের প্রথম চার পাতা জুড়ে ছিল দুই রাজনৈতিক দলের সহিংসতা, লাগাতার হরতাল, মারপিটের বিশাল সব ছবি। আর পঞ্চম পাতা ভরে গিয়েছিল এক সাবেক সংসদ সদস্যের দূর্নীতি'র বিশাল ফিরিস্তি নিয়ে ফলো-আপ নিউজে।
নিঃসন্দেহে ওসব ঢের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





