সত্তরের দশক পর্যন্ত যে দুজন মানুষ বাংলাদেশের জনগণকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর অন্যজন জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগের ঘোরতর সমর্থকরা আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে অন্য কারো নামের উচ্চারণ তাঁরা পছন্দ করেন না। তাঁদের জন্য বলে রাখি, আমি নিজেও বিশ্বাস করি, এ দুজনের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নন, বিশ্বের সর্বকালের সেরা নেতাদের অন্যতম আর জিয়াউর রহমান যতবড় নেতা তার চেয়ে বেশি ভাগ্যবান। তবে আমাদের বেড়ে ওঠার সময় জিয়াউর রহমানের একটি বিশাল প্রভাব ছিল এ দেশের মানুষের ওপর। জিয়াউর রহমানের নামে অনেক গল্পগাথা চালু ছিল। ওই বয়সে তার কতটুকু মিথ আর কতটুকু সত্যি তা বিবেচনা করার বোধবুদ্ধি ছিল না। আমি যে বছর (১৯৭৬) ক্যাডেট কলেজে ঢুকি, জিয়া তখন ক্ষমতায় নবাগত। দেশ থেকে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ইতিহাস অন্তর্হিত হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জিয়ার পোস্টার। ভালো ছাত্র হিসেবে স্কুলে আমার নাম থাকলেও ক্যাডেট কলেজের বিশাল লাইব্রেরি আমাকে ফাঁকিবাজের তকমা এঁটে দিয়েছে। আমার বন্ধুরা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কালেভদ্রে লাইব্রেরিতে আসে আর আমি বিভিন্ন অজুহাতে লাইব্রেরিতে পড়ে থাকি, ক্লাসের পড়া এগোয় না। সে সময় পত্রিকার বেশ উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে থাকত স্বাধীনতা ঘোষণাসহ জিয়ার আরো অনেক কৃতিত্বের কথা। স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়টি সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। তবে বিভিন্ন প্রচারণার কারণে এ সময়ই আমি প্রথম জিয়াউর রহমান নামটির সঙ্গে পরিচিত হই। তখন থেকে আমার লেখাপড়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ছিলেন জিয়াউর রহমান। ক্যাডেট কলেজ লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকাগুলো বাঁধাই করা থাকত। এই পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে আমি ১৯৭২ সালের দৈনিক বাংলার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যাটি পেয়ে চমৎকৃত হই। এ সংখ্যায় 'একটি জাতির জন্ম' নামে আমার প্রিয় নেতার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। লেখাটি এক নিঃশ্বাসে পড়তে গিয়ে আমার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার অবস্থা। কারণ তিনটি, প্রথমত,
জিয়া লিখেছেন, 'এল ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন।
দ্বিতীয়ত, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমার কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো।
আর তৃতীয়ত, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।'
জিয়ার এই নিবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি নতুন দিগন্ত আমার সামনে উন্মোচন করে দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার সময় সেটা নয়। আমি মনে মনে সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মেনে নিই। ৭ মার্চের ভাষণটিও আমার কাছে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে যায়। তবে বুঝতে পারি, স্বাধীনতা ঘোষণার প্রসঙ্গটি সঠিক ও তথ্যনির্ভর নয়। কারণ জিয়ার রচনায় এর কোনো উল্লেখই নেই।
সম্ভবত ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমি প্রথমবার জিয়াকে দেখি। কোনো একটি কারণে তিনি আমাদের ক্যাডেট কলেজ পরিদর্শনে এসেছিলেন। আমাদের কলেজে ভিআইপিদের স্বাগত জানানোর জন্য ছাত্রদের রাস্তার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা স্বাগতম করতে হতো না। তবে চাটুকারিতা সে সময়ও ছিল। জিয়া আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে জিয়ার দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা নকল করে দেখাতে বলা হয় উঁচু ক্লাসের একজন বড় ভাইকে। জিয়া খুব সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দিয়ে বিদায় নেন। আমার কাছে একজন রাষ্ট্রপতিকে চাক্ষুষ দেখার চেয়ে সে ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
জিয়াকে দ্বিতীয়বার দেখি ১৯৭৯ সালের ১ ডিসেম্বর উলশী যদুনাথপুর প্রকল্পের খাল খনন অনুষ্ঠানে । জিয়ার খাল খনন কর্মসূচির বিপ্লবের সূচনা এখানেই। প্রতিটি ক্লাসের তিনজন করে ছাত্র পাঠানো হয়েছিল আমাদের কলেজ থেকে। আমাকে কেন পাঠানো হলো, আমি জানি না। কলেজে বাগান করার সময় মাটি কোপানো ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বিরক্তির কাজ। খাল কাটার কাজে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। তবু খালকাটা দলে নিজের নাম দেখে উল্লসিত হলাম।
কারণ এই অজুহাতে অন্তত ক্যাম্পাসের বাইরে যাওয়া হবে। যদুনাথপুর যাওয়ার পর মনটা অন্য রকম হয়ে গেল, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে শুধু নয়, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ জড়ো হয়েছে অনুষ্ঠানে। অনেকের আসার কারণ রাষ্ট্রপতিকে একনজর দেখা। তিনি হেলিকপ্টার থেকে নেমে বেশ খানিকটা পথ হেটে পৌঁছান অনুষ্ঠানে। আমাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সম্ভবত ক্যাডেট কলেজের ইউনিফর্ম পরে কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই ড্রেস পরে কা জ করতে পারবে? আমরা ১৮ কিশোর বিপুল উতসাহে অনেকটা মাটি খুঁড়ে ফেলি। খাল খনন নিয়ে পরবর্তী সময় অনেক সমালোচনা এবং নিষ্ঠুর রসিকতা হয়েছে। তবে অনেক পরিবেশবাদী মনে করেন, খাল খনন কর্মসূচি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সেচব্যবস্থা নিয়ে কৃষককে দুশ্চিন্তা করতে হতো না।
ততদিনে জিয়ার সুনামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমালোচনাও ডালপালা মেলেছে। সার্কের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে বাংলাদেশের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠলেও দেশে অন্তর্ঘাত বেড়েছে। শাহ আজিজুর রহমানের মতো একজন চিহ্নিত রাজাকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরা ডানা বিস্তার করতে শুরু করেছে। সামরিক বাহিনীতে একের পর এক বিদ্রোহ ঠেকাতে ঠেকাতে নিষ্ঠুর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন জিয়া। ১৭টি বিদ্রোহ দমনের পর শেষ পর্যন্ত ১৮ বারে তিনি নিহত হলেন ৩০ মে ১৯৮১ সালে।
বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও ঈরসণীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন জিয়া। এদিকে জিয়ার উত্তরসূরি রাষ্ট্রপতি সাত্তার সেই লগ্নেই বুঝতে পেরেছিলেন বিএনপিতে জিয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন মাপের দলছুট নেতার সমন্বয়ে গড়া বিএনপিতে ভাঙন ঠেকাতে একসময় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে টেনে আনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার ব্যতিক্রম হওয়াটাই হতো অস্বাভাবিক।নতুন প্রজন্মের নেতা এবং তাদের মেন্টরদের যোগ্যতার ঘাটতি পুরনের জন্যেই তারা বারবার জিয়াকে বিতর্কে টেনে এনেছে।জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকার করলেও হীনমন্য কয়েকজন নেতার পরামর্শে তারা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছে।একই ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার গৌরবময় অবদানকে খাটো করার আওয়ামী প্রচেস্টা এখনও অব্যহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যেমন বিশ্বাসঘাতক জেনেও পাকিস্তানিদের সাথে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংলাপ চালিয়ে যেতে হয়েছিল, জিয়াকেও তেমনই পাকিস্তানি অধিনায়কের আদেশ মেনে সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসের কাজে রওনা হতে হয়েছিল।(সূর্যাস্তরে আগে এই দায়িত্ব ছিল মেজর মীপ শওকত আলীর)।পথিমধ্যে ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালিকুজ্জামানের মুখে পাকিস্তানিদের ক্র্যাকডাউনের কথা শুনে তিনি প্রতিকুল পরিবেশেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। বিদ্রোহ করেছিলেন সে রাতেই। কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৭ মার্চ ১৯৭১। এটি স্বাধীনতার কত নম্বর ঘোষণা তা নিয়ে বাহাস করা যেতে পারে। তবে এই ঘোষণা যে মুক্তি যোদ্ধাদের সংগঠিত করার পাশপাশি মুক্তিপাগল জনতাকে অকুতোভয় করে তুলেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
জেড ফোর্সের ব্রিগেড মেজর এবং জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর অলি আহমদকে দেওয়া একটি পারফরম্যান্স এপ্রাইজাল (সামরিক বাহিনীতে প্রচলিত Annual Confidential Report)কিছুদিন আগে আমার হাতে আসে। তৎ কালীন কর্নেল মীর শওকত আলী অলি আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন : His achievements during war was commendable- he in fact was the first officer who took risk and on his own initiative informed General Ziaur Rahman regarding declaration of Independence on night 25/26 March, 1971. অর্থাৎ যুদ্ধের সময় তাঁর (অলি আহমদের) অর্জন প্রশংসনীয়। বস্তুত তিনিই (অলি আহমদ) প্রথম অফিসার যিনি একাত্তরের ২৫-২৬ মার্চ মধ্যরাতে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন।
এই প্রতিবেদনের শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনকারী হিসেবে জিয়াউর রহমান স্বয়ং স্বাক্ষর করেছেন। এরপর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকে কি? এই ডকুমেন্টটি দেখার পর আমি বুঝতে পারি, একটি জাতির জন্মে তিনি কেন স্বাধীনতা ঘোষণার কথা লেখেননি। জিয়ার এই পরিমিতি বোধের জন্যই অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও জিয়াকে আমি শ্রদ্ধা করি।
পাদটিকাঃ
বছর দুই আগে একটি অনুষ্ঠানে অলি আহামেদকে এই এসিআরের প্রসঙ্গে জানতে চাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন। কথার মানে এই নয় যে আমি অন্য কোথাও স্বাধীনতা ঘোষণা শুনেছিলাম। আসল কথা হচ্ছে আমি তাঁকে আমাদের বিদ্রোহের খবরটা রেডিয়োর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। জিয়াকে ফাঁসির ঝুঁকি মাথায় নিয়েই স্বনামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হয়েছিল। বলেছিলাম তিনিতো একটি জাতির জন্মে এ বিষয়ে কিছু লেখেন নি। অলি বললেন সে জন্যেই তো তিনি জিয়াউর রহমান।তাঁর হাতে স্থাপিত কয়টি ভিত্তি প্রস্তরে তার নাম লেখা দেখাতে পারবেন? তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন নামের বদলে পদের নাম লিখতে। আজকাল স্কুল ক লেজে বাস উপহার দিলেও লেখা হয় হাসিনা কিম্বা খালেদার উপহার। তখন লেখা হত রাস্ট্রপতির উপহার।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৭:১৩