somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ঃ ১৯৭৪ সালের একটি গল্প

২১ শে মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফযরের সময় মান্নান সাহেবের চোখে পড়ল ব্যাপারটা।নিচ তলার ভাড়াটিয়ার রান্না ঘরের ছাদ জুড়ে টুকরা কাপড়ের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন রকম কাপরের টুকরা। কোথাও স্তুপাকারে কোথাওবা ছড়ানো ছিটান। চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি। এত কাপড়ের টুকরা এলো কোত্থেকে? আনলোই বা কে? এগুলোর তলে কী আছে কে জানে? দিন কাল ভালো নয়। চারিদিকে ধরপাকড় শুরু হয়েছে।

নিচ তলায় মাকে নিয়ে ভাড়া থাকে জাসদের তরুন নেতা মসিউর রহমান । গত সপ্তায় ঢাকা থেকে মেজর জলিল, আ,স,ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজের মত নেতারা এসেছিলেন মসিউরের বাসায়। যশোরে মহা সমাবেশ হয়ে গেল। রক্ষীবাহিনী যে ভাবে জাসদের ছেলেদের ধরা শুরু করেছে! তারপ্অর থেকেই মনে হয় মসিউরের উপর নজর পড়েছে এদের। তিনি প্রায়ই ভাবেন মসিঊর কে ঘর ছেড়ে দিতে বলবেন।কয়েকদিন আগে স্ত্রী বলেছেন মসিঊর তার ছেলে মেয়ের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। প্রথমে তিনি বিষয়টার গুরুত্ব দেননি। কাল তার ছোট দুই ছেলেকে অদ্ভুত একটা ছড়া কাটতে দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়েছেন। খেয়েছে হোঁচট/হয়েছে খোড়া/ শেখ মুজিবের লাল ঘোড়া। দেশের একজন মহান নেতাকে নিয়ে এধরেণের ফাজলামো তার ভালো লাগলো না।। তিনি পাকড়াও করলেন ছেলেদের। জানা গেল এ গুলো ছড়া নয়, দেয়াল লিখন। মসিঊরের উতসাহে তারা লাইন গুলি মুখস্ত করেছে। তিনি মসিউরকে ডেকে পাঠালেন। এ ছেলেকে এক মাসের নোটিস দিয়ে বাড়ি ছাড়া করতে হবে। মসিউরের কাছ থেকে মাস গেলে শ’খানেক টাকা পাওয়া যায় বটে। তবে এসব নিয়ে ঝামেলা হলে নির্ঘাত রক্ষীবাহিনীর হাতে পড়তে হবে। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। মসিউর এসে যখন ‘ফুপাজি’ বলে সালাম দিয়ে দাঁড়াল তখন আর আসল কথাটা বলতে পারলেন না। ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল। তাঁকে সম্মান করে বেশ। সম্মান জিনিষ টা ধীরে ধীরে এদেশ থেকে উঠে যাচ্ছে।

কাপড়ের তলে আবার বোমা টোমা লুকানো নেই তো! মসিউরকে ফাসানোর জন্যে যদি কেঊ রেখে গিয়ে থাকে? তিনি আর ভাবতে পারছিলেন না।

বেগম মালেকা সাহানা ওজু করতে বেরিয়ে ছিলেন। স্বামীকে সাত সকালে ভাড়াটিয়ার রান্না ঘরের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে মান্নান সাহেব ইশারা করলেন রান্না ঘরের ছাদের দিকে। ব্যলকনির রেলিং টপকে অনায়াসে রান্না ঘরের টালির ছাদে যাওয়া যায়। প্রথমে কিছুই বুঝুতে পারলেন না মালেকা সাহানা। কাঁঠাল গাছের কতগুলি রোগা শোকা ডাল হালকা বাতাসে টালির ওপর দোল খাচ্ছে। পূর্ব আকাশ কেবল লাল হওয়া শুরু করেছে। হাত দশেক দূরে মজু মিয়ের পুকুরের পানিতে স্পষ্ট ছায়া পড়েনি ভোরের আকাশের। এত সকালে রান্না ঘরের ছাদে কী দরকার ভাবতে ভাবতে চোখ পড়ল টালির ছাদে। প্রায় আঁতকে উঠলেন তিনি “ছাদ ভর্তি এসব কী?” মান্নান সাহেব স্ত্রীর মুখ চেপে ধরে ফিস্ফিসিয়ে ঊঠলেন “আস্তে বল, শুনতে পাবে।“
- কে শুনবে?
- আহা কে শুনবে কী করে বলব! কাপড়ের নিচে কী আছে কে জানে? চারিদিকে খবর শুনছো না?
- কিসের খবর?
- ক’দিন আগে মোশারফ সাহেব কে ধরে নিয়ে গেল না? লাইসেন্স ছাড়া বন্দুক পাওয়া গেল বাড়িতে।
- এখানে বন্দুক আসবে কোত্থেকে?
- বোঝনা! এই ছাদে এত কাপড়ের টুকরার মানে কী? কেউ যদি মসিউর কে ফাসাতে চায়... বোমা টোমাও তো রাখতে পারে। মোশারেফ সাহেবের ছেলেটাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। শুনেছি একটা আঙ্গুলও নাকি কেটে ফেলতে হয়েছে।

চোখ বড় হয়ে গেল মালেকা সাহানার। প্রথম চিন্তা বড় ছেলেকে নিয়ে। এম এম কলেজের বিএসসির ছাত্র সে। কালও রাত করে বাড়ি ফিরেছে। পুলিশ যদি আসে! রক্ষী হলে তো কথাই নেই। ছাদে বোমা থাকা মানে ফিরোজ শেষ। মসিউরকে ধরতে পারবে না পুলিশ। সে পলিটিক্স করে। চালাক চতুর ছেলে। পালাতে পারবে। কিন্তু ফিরোজ?
তিনি ফিরোজের ঘরে ছুটলেন। ঘুম থেকে উঠিয়ে কোথাও পাঠাতে হবে। বাড়িতে রাখা যাবে না।
এত সকালে ঘুম ভাঙ্গানোয় মন খারাপ হয়ে গেল ফিরোজের।আজ কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা মানে নায্য মূল্যের দোকানে লাইন ধরা। চালের লাইন, তেলের লাইন অথবা নিদেন পক্ষে লবনের। তাও যে প্রতিদিন পাওয়া যাবে তা নয়। গত সপ্তায় কলেজ কামাই দিয়ে তেলের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। দেড় ঘন্টা পর যখন দোকানের নাগাল পাওয়া গেল, তখনই ঝাঁপ ফেলে দিল ডিলার। তেল শেষ।

রাতে অনেক ধকল গিয়েছে তার উপর দিয়ে। পাড়ার ছেলেরা রিলিফ পাঠাবে রংপুর তার যোগাড় যন্তর, বাঁধাই ছাদাই করতে করতে সাড়ে এগারো। বাসায় ফিরে কোন মতে দুটি রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। স্বাধীনতার পর তার ভেতো বাঙালি বদনামটা ঘুঁচতে বসেছে। রাতে রুটি এখন ধরা বাঁধা।
মায়ের ধাক্কা ধাক্কিতে কোন মতে চোখ মেলল ফিরোজ। মালেকা সাহানা বললেন, “তোকে একটা কাজ করতে হবে এখনই”
“এখনও ঘুমই ভাংলো না, আর একটু ঘুমোতে দাও”, ঘুম জড়ান গলায় বলে পাশ ফিরে শু্লো ফিরোজ। “তাড়াতাড়ি ওঠ, একটা সমস্যা হয়েছে”। এবার তাড়া লাগালেন মা।
- এই সাত সকালে কী সমস্যা?
- মসিউরদের রান্না ঘরের ছাদে কে যেন বোমা রেখে গেছে।
এবার ধড়মড়িয়ে উঠলো ফিরোজ। বল কী! বোমা! তুমি দেখেছো?
- না দেখি নি। ছাদ ভর্তি টুকরা কাপড়ের গাঁদা, তার মধ্যে লুকানো থাকতে পারে
- ও, ... চলো দেখি। দরোজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল ফিরোজ।
তার কথা ঠিক ধরতে পারলেন না মালেকা সাহানা। “কোথায় যাবি?” জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
- দেখতে হবে না আসলে কিছু আছে কী না? ছাদে গিয়ে দেখি
- তোর কী মাথা খারাপ? ছাদে যাবি, যদি ফুটে টুটে যায়?
মা’র কথা বলার ধরণ দেখে হাসি পেল ফিরোজের। “তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি বোমা। আব্বা কই?” মসিয়ার ভাই কে বলেছো?
- তোর বাপ তো ব্যলকনি থেকে লক্ষ রাখছে। মসিউর কে বলা হয় নি।

দ্রুত বিছানা ছেড়ে স্যন্ডেলে ক্কোন মতে পা গলিয়ে ফিরোজ রওনা হল ছাদের দিকে। মান্নান সাহেব ছেলেকে দেখে একটু স্বস্তি পেলেন। কী করা যায় বলতো, থানায় খবর দেব? বাসায় ফোন নেই। থানা অবশ্য খুব দূরে নয়। বড় জোর তিনশ’ গজ। কিন্তু খবর দিতে যাবে কে? পুলিশ কে বিশ্বাস নেই। পুলিশ যদি সন্দেহ করে? কাজেই থানার কথা মনে এলেও তিনি খুব ভরসা পাচ্ছিলেন না। আর রক্ষীবাহিনীর কথা মনে হতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। এরা যা ইচ্ছে করতে পারে। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে নাকি একটা একটা করে হাত পায়ের আঙ্গুলও কেটে ফেলতে পারে। মান্নান সাহেবের গ্রামের এক ছেলে আছে রক্ষীবাহিনীতে। তার কাছে শুনেছেন এই কাটা কুটিকে তারা বলে “চপিং অফ অপারেশন”। তিনি আবার বললেন
- ফিরোজ থানায় খবর দেব?
- আগে দেখিনা কী আছে
- বলিস কী! খবরদার রান্না ঘরের ছাদের দিকে যাবি না।

অসমাপ্ত
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×