somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন প্রেসিডেন্টের ইমেইল এবং আমাদের নেগেটিভ মনোভাব

২০ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পশ্চিমে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি শব্দ হল ‘এপ্রেশিয়েট’। ভাল কাজের জন্য যে কতভাবে এটি প্রকাশিত বা উচ্চারিত হয় তা এসব দেশে না এলে বুঝতাম না। পছন্দ না হলে চুপ থাকে অথবা হু, হা করে, গালি দেয় না; আমাদের মত ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত বলতে গেলে গড়ায় না কখনও। পুলিশ টিকিট দিয়েও বলে ‘হ্যাভ এ ওয়ান্ডারফুল ডে’, টেক কেয়্যার’ ইত্যাদি জাতীয় মন ভাল করা সব বাক্যসমূহ। এদের নেগেটিভ দিকসমূহ নিয়ে আলোচনা আজ নাই বা করলাম। এক বেবি সেন্টারে গিয়ে দেখলাম ছোটমনিদের কিভাবে খুশী রাখা যায় তার ১০১টি সুন্দর সুন্দর কথা। ওয়ান্ডারফুল, এঞ্জেল, কিউটি, সুইটি, ইউ আর সো বিউটিফুল, ইউ আর সো স্পেশাল, ইউ আর রিয়্যালি সামথিং, তুমি সত্যিই এমন যা আর কারো মধ্যে নেই, তুমি কিন্তু এটি ভেবে বসো না যে আমি বানিয়ে বলছি অথবা সবাইকে আমি এমনটিই বলে থাকি ইত্যাদি। এসব দেখে আমার দেশের বাচ্চাদের প্রতি টিচার, ইমাম সাহেব অথবা মুরুব্বীদের ব্যবহার মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। মিলল না। আমাদের স্যারেরা উত্তরপত্র দেখার সময় যেখানে পাশের অল্প একটু উপর থেকে নাম্বার দিয়ে দয়া করেন, পশ্চিম গোলার্ধের স্যারেরা খাতা দেখার আগেই ধরে নেন তার ছাত্রটি পূর্ণ নাম্বার পেয়েছে। এরপর ভুল পেলে সেই পূর্ণ নাম্বার থেকেই তারা মাইনাস করতে থাকেন। আবহাওয়া কিংবা নিজেদের পোষা জীবজন্তুদের নিয়ে এরা মজা করে কথা বলতে পছন্দ করে, মানুষের কূকীর্তি নিয়ে আমাদের মত ঘন্টার পর ঘন্টা মনোযোগ সহকারে আলোচনা করে না। রাজনীতিবিদরা সম্মানরেখে চরমতম প্রতিদ্বন্ধীর সাথেও হাস্যরসে মেতে উঠেন। দুই ভিন্ন মেরুর দুইজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, পিতা বুশ ও বিল ক্লিনটনকে সুনামির প্রলংকরী তান্ডব একত্রিত করে ফেলে। প্রতিবেশী দেশের কথাই বলা যেতে পারে। নিজেদের মধ্যে কোন বিভক্তি বিদেশীদের সামনে দেখায় না। নিজেদের দূর্বল দিক নিয়ে নন-ইন্ডিয়ানরা আমাদের মত সরস নাতিদীর্ঘ আলোচনায় মেতে উঠে না। ‘এপ্রেশিয়েট’ এর ভাষা আমাদের মুখে আসে না, আবার চুপও থাকতে পারিনা, নিজেকেই বরং অন্যের চরিত্র হনণের মুখপাত্র বানাই!
গুরুজনেরা, পন্ডিতমানুষেরা মাথার উপরে থাকলে অনেক উপকারে আসে। মনের ভিতর থেকে কথা বলে চমৎকার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেন। কর্মক্ষমতা সীমিত থাকলেও বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সুন্দর একটা আবহ তৈরিতে সাহায্য করেন। সেজন্যই আমরা দীর্ঘদিন ধরে শয্যাসায়ী বাবা-মাকেও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে দিতে চাইনা। আর প্রকৃতির অমোঘ বিধানে তারা চলে গেলেও বলি বটবৃক্ষের ছায়া থেকে বঞ্চিত হলাম। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশকে একসাথে এত পন্ডিত কখনো শাসন করেন নাই। এদিক থেকে আমরা বেশ ভাগ্যবানই বলতে হবে। আইএ, বিএ, এমএ থেকে শুরু করে অনেক ব্যরিস্টারদেরকে একসাথে দেখলেও, আমরা এত ডক্টরকে শাসন ক্ষমতায় বা গুরুত্বপূর্ন পদে কখনো দেখিনি। তুলিতে আকা আলপিনের বিড়ালের অমুসলমানিত্ব সম্পন্ন করার পর, হিজাব পড়া মেয়েদের ভোটের জন্য কানের রিং ও মাথার চুলের একাংশ দেখানোর আজব নিয়ম বহাল রেখে আবার কোন পন্ডিত ডক্টরকে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা অনুষ্ঠানে দেখলে জাত যাবে।
উপমহাদেশের পার্লামেন্টারী গনতন্ত্রের তিনটি প্রতিবেশী দেশেরই প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতা মোটামুটি একই রকম। পন্ডিত হলেও নির্জীব, নির্লীপ্ত থাকা, বটবৃক্ষের মত শুধু ছায়া প্রদান করা। ফোস করে না উঠলে বোঝাই যায় না সাংবিধানিক এসব বটবৃক্ষের শিকর কত গভীরে প্রোথিত! ফারুক লেঘারী ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে পর পর দু’বার ফুসে উঠে দুটি পার্লামেন্ট ভেঙ্গেছিলেন। গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দুই প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে বেনজীর ও নওয়াজ শরীফকে রাস্তায় পাঠিয়েছিলেন। নিরীহ, মিতভাষী মানুষ আমাদের আব্দুর রহমান বিশ্বাসও কিন্তু ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রেগেমেগে একজন সেনাপ্রধানকে নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলেছিলেন। সিংহাসনে উপবিষ্ট রাষ্ট্রের সবচেয়ে দামী ও গম্ভীর মানুষগুলো কেতাদুরুস্ত পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে ফিতা কাটা, সার্টিফিকেট বিতরন, মোনাজাত, মাজার জিয়ারত বা পুস্পমাল্য অর্পনের পাশাপাশি মাঝে মাঝে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে জনগনের দায়িত্বানুভূতিও সৃষ্টি করে থাকেন। আমেরিকা বা পশ্চিমের প্রেসিডেন্ট ও প্রফেসররা যেখানে টি শার্ট বা জগিং করে হেলেদুলে কথা বলে কাউবয় হওয়ার জন্য ব্যস্ত, উপমহাদেশ বা এশিয়ার মান্যবররা মুখ বন্ধ করে কে কত বেশী গম্ভীর অন্যভাবে বললে কে কত বড় ব্যক্তিত্বশীল, তা প্রমানের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ঢাকার শপিং মলে হঠাৎ দেখা পাওয়া ক্লাশের কোন টিচারকে যদি কেউ বলে উঠে ‘হেই মাই টিচার ইজ হিয়ার’, ‘আর ইউ ক্রেজি’ ইত্যাদি; পরদিনের ক্লাশ রুমে তার পরিনতির কথা ভাবতেই ভয় লাগে।
আমেরিকার সামনে বছরের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে ফ্রন্ট রানারদের অভিজ্ঞতা নিয়ে মজার মজার কথা বাজারে আসছে, যারা কিনা বর্তমানে কেউ গভর্ণর, সিনেটর, মেয়র, কংগ্রেস সদস্য ইত্যাদি। মাইক হোকাবি (Mike Huckabee) আজো কোন স্টোরে ঢুকতে গিয়ে দরজা খুলতে গ্লাসে হাত দেন না। কারন টিনএজ বয়সের পেনিতে কাচে আঙ্গুলের দাগ মোছার কষ্টকর চাকরির কথা এখনো ভুলেননি। মিট রোমনি (Mitt Romney) স্যুয়েজ পাইপের ফ্লো বন্ধ করতে রেন্‌চ নিয়ে কাজ করতেন। হিলারী ক্লিনটন চামচ দিয়ে মাছের নাড়িভুরি আলাদা করতেন। রিপাবলিকান ফ্রেড থমসন (Fred Thomson) জুতার ফ্যাক্টরীতে কাজ করতেন। ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামার (Barack Obama) সবচেয়ে অড জব হলো বাসকিন-রবিন্সে আইসক্রীম তোলা, কারন তিনি তুলতে গিয়ে খেতেন বেশী। রিপাবলিকান রুডি গিলিয়ানি (Rudy Giuliani) ল’ পড়তে যাওয়ার আগে যাজক ছিলেন আর ঔষধ বেচতেন। আমাদের দেশের মান্যবরদের নিয়ে বাজারে এসব কথা বেরুলে তা লজ্জার সীমা থাকবে না বৈকি! আবশ্যি দিন এখন অনেক বদলেছে।
যাহোক, আমরা ইন্ডিয়ার এইতো গেল প্রেসিডেন্ট চপ্পল পড়া, পরমানুবিজ্ঞানী ডঃ এ.পি.জে. আব্দুল কালামের কথা বলছিলাম। মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে হায়দারাবাদে একটা বক্তৃতা দেন এবং নিজেই ইমেইলে সেটি বিশ্বব্যাপী ইন্ডিয়ানদের মাঝে ছড়িয়েও দেন। বর্তমানে হাইস্কুলের ছেলেপুলেরা ইমেইল আর চ্যাট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বাংলাদেশের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা নাকি এর প্র্যাক্টিস তেমনটি করেন না। কথাচ্ছলে দূর্মুখেরা একটি কৌতুক ছড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের কোন একজন দামী মানুষ অষ্ট্রেলিয়ায় বা কোন এক দেশে নাকি গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে। ব্রেক টাইমে কফির ফাকে অন্যান্য দেশের ডেলিগেটরা জানতে চেয়েছিলেন আমাদের দেশের মাননীয় প্রতিনিধির ইমেইল এড্রেস। উত্তরে তিনি নাকি বলেছিলেন, আমি এটি এখনো পাইনি। সেক্রেটারীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে পরে আপনাদেরকে দিব। সব কৌতুকেই যেমন শেষের উত্তরটি জানা যায়না। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উত্তর শুনে ভিন্ন দেশের ডেলিগেটরা কি মন্তব্য করেছিলেন সেটি আর কৌতুকে নেই। নিন্দুকদের স্বভাবই তো নিন্দা করা, আমরা না হয় তাদের কথা বিশ্বাস নাই বা করলাম।
ডঃ এ.পি.জে. আব্দুল কালামের ইমেইলের বিষয়বস্তুর সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত প্রায় মিলে যায় হেতু আমরা একটু আলোচনা করতেই পারি। তিনি ফেলো ইন্ডিয়ানদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, আমাদের মিডিয়া এত নেগেটিভ কেন? আমরা কেন আমাদের নিজস্ব শক্তি, অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে লজ্জা পাই? তারপর তিনি বলে গেলেন, আমরা এক মহান জাতি। আমাদের রয়েছে অনেক অভাবনীয় ও চমৎকৃত করা সাফল্যের কাহিনী। কিন্তু আমরা নিজেরাই এর স্বীকৃতি দিতে প্রত্যাখান করি। কেন?? দুধ উৎপাদনে আমরাই প্রথম। রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইটে আমরাই নাম্বার ওয়ান। গম উৎপাদনে দ্বিতীয়, চাল উৎপাদনেও তাই। ডঃ সূদর্শনের দিকে তাকান, যিনি এক অজপল্লীকে স্বনির্ভর ও স্ব-চালিত গ্রামে রূপান্তরিত করেছেন। এরকম উদাহরন লাখ ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের মিডিয়া কেবলই ব্যস্ত খারাপ খবর নিয়ে, ব্যর্থতা আর দূর্দশার করুন চিত্র নিয়ে। তিনি বলেন, আমি তেল আবিবে বসে একদিন নিউজপেপার পড়ছিলাম। দিনটি ছিল, হামাস কর্তৃক মূহুর্মুহ বোমা আক্রমন ও অগনিত হত্যাযজ্ঞের পরেরদিন। কিন্তু নিউজপেপারের প্রথম পুরো পাতা জুড়ে ছিল এক জুইশ ভদ্রলোকের সাফল্যের কাহিনী। যিনি কিনা পাচ বছরের মাথায় তার নিজের মরু জমিকে পরিনত করেছেন দর্শনীয় ফুল আর বৃহত ভূট্টা খামারে। এ এমনই এক চিত্র যা প্রত্যেককে জাগাতে পারে। রক্তাক্ত ঘটনাসমূহ যেমন, হত্যা, খুন, বোমা বর্ষন ইত্যাদির খবরগুলো ছিল ভিতরের পাতায় অন্যান্য খবরের সাথে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আর ইন্ডিয়ায়? প্রতিদিনই আমরা পড়ি মৃত্যুর খবর, রোগ-শোক, অপরাধ আর সন্ত্রাসের খবর। কেন আমরা এত নেগেটিভ? আরো একটি প্রশ্ন, কেন আমরা জাতিগতভাবে বিদেশী জিনিসের প্রতি মোহগ্রস্ত? চাই বিদেশী জামা, প্যান্ট, বিদেশী টেকনোলোজী, বিদেশী সবকিছু।
তিনি জনগনের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা কি এটা বুঝিনা যে, আত্ম-সম্মান আসেই আত্ম-নির্ভরতা থেকে? হায়দরাবাদের যখন আমি এই বক্তৃতাটি দিচ্ছিলাম, একটি চৌদ্দ বছরের মেয়ে এসে আমার অটোগ্রাফ চাইল। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? মেয়েটি জবাব দিল, উন্নত ইন্ডিয়ায় বাস করতে চাই। মেয়েটির জন্য, আপনার জন্য এবং আমার জন্যই উন্নত, ধনী ইন্ডিয়া বানাতে হবে।
তিনি দেশের মানুষের কাছে দশমিনিট সময় চেয়ে নিয়ে বলেন, আপনি বলছেন ইন্ডিয়া উন্নয়নশীল গরীব দেশ। আসুন দেখি এটি উন্নত দেশ কিনা। যদি মিনিট দশেক সময় আপনার থাকে তাহলে তো আমার সাথে থাকুন, আর না থাকলে আপনার ইচ্ছা।
আপনি বলছেন, আমাদের গভর্ণমেন্ট অদক্ষ।
আপনি বলছেন, আমাদের আইনগুলো সেকেলে।
আপনি বলছেন, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটি ময়লা পরিষ্কার করেনা।
আপনি বলছেন, আমাদের ফোনগুলো কাজ করেনা, আর রেইলওয়ে তো হল মস্তবড় জোক। এয়ারলাইন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে জিনিস, ডাকবিভাগের চিঠি তো কখনো গন্তব্যেই পৌছেনা।
আপনি বলছেন, আমাদের দেশটাই হলো কুকুরদের খাবারের জন্য, চারিদিকে নোংরা যত সব আবর্জনা!
আরও আরও অনেক...............।
এবার তিনি জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন, এবার দেখুন আপনি নিজে কি করছেন?
ধরুন, একজন লোক সিংগাপুরে যাচ্ছেন। লোকটির নাম দিন। আপনার নামটাই দিন। একটি চেহারাও দিন। সেটিও আপনার। আপনার সাধের দেশের বাইরের এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আপনি এবার হাটছেন। আপনি সিংগাপুরে সিগারেটের বাট এখন রাস্তায় ফেলছেন না, স্টোরে কিছু খাচ্ছেনও না। আপনি তাদের পাতাল ট্রেন লাইন নিয়ে গর্ব করছেন। আপনি সিংগাপুরে কিন্তু বলছেন না ‘আপনি কে’। আপনার সাহস নাই রোযার মাসে দুবাইতে জনসম্মুখে দিনের বেলায় আহার করা। আপনি জেদ্দায় হেড স্কার্ফ ছাড়া বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। লন্ডনে আপনার সাধ্য নাই টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কোন কর্মচারীকে ৬৫০ রুপি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবেন যে, লোকাল ও আইএসডি বিলটি অন্য জনের নামে চালিয়ে দাও। আপনি সাহস পাবেন না ওয়াশিংটনের রাস্তায় ঘন্টায় ৫৫ মাইল বেগে গাড়ি চালাতে। আর যদি পুলিশ ধরেই ফেলে, বলতে পারবেন না , ‘জান্তা হেই মে কৌন হু (তুমি কি জানো আমি কে?)। আমি অমুক, অমুকের ছেলে।
আপনি অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডের বীচে গিয়ে নির্ধারিত জায়গার বাইরে ময়লা ফেলেন না। আপনি কেন টোকিওর রাস্তায় পানের পিচকি ফেলেন না? আপনি কেন বোস্টনে নিজের বদলে অন্যজনকে পরীক্ষার হলে পাঠান না বা ভূয়া সার্টিফিকেট কেনেন না? আমরা কিন্তু এখনো একজনকে নিয়েই কথা বলছি, ‘আপনি’। আপনি বিদেশী সিস্টেমকে সম্মান ও মেনে চলতে পারেন, নিজের দেশেরটা পারেন না। ইন্ডিয়ার মাটিতে পা পড়া মাত্রই আপনিই, হ্যা আপনিই, কাগজ,সিগারেট রাস্তায় ছুড়ে ফেলেন। আপনি বন্ধুদেশে গিয়ে যা করেন, যেভাবে সেদেশের নাগরিকদের এপ্রেশিয়েট করেন, ইন্ডিয়াতে তা করেন না। কেন?
এক ইন্টারভিউতে বোম্বের সাবেক নামকরা মিউনিসিপ্যাল কমিশনার মিঃ টিনাইকার বলেছিলেন, ধনী মানুষেরা রাস্তায় কুকুর নিয়ে হাটেন, আর কুকুরের বিষ্ঠা যত্রতত্র ছড়িয়ে এক নোংরা অবস্থার সৃষ্টি করেন। সেই একই মানুষেরা কর্তৃপক্ষকে দোষেন নোংরা রাস্তা সাফ না করার জন্য, সমালোচনা করেন সরকারের অদক্ষতার। অফিসারদের কাছে তারা কি আশা করবেন? একটা ঝাড়ু আর পটি নিয়ে কুকুরদের পিছনে ছুটবেন আর নজর রাখবেন তাদের কুকুরের কখন বাউল মুভমেন্ট হয়?
আমেরিকায় ডগ বা জীবজন্তুদের মালিকেরাই তাদের ময়লা সাফ করেন। জাপানেও তাই। ইন্ডিয়ার সিটিজিনরা কি এটা করবেন? আপনি ঠিকই বলছেন। আমরা নির্বাচনে ভোট দিয়ে পছন্দের সরকার নির্বাচিত করি এবং সব দায়িত্ব বেচারা সরকারকেই দিয়ে দেই। আমরা কোন অবদানে শরীক না হয়ে ইজি চেয়ারে বসে আরাম করে আশা করি সরকারই আমাদের জন্য সব করে দিবে। আমাদের গভর্ণমেন্ট সব আবর্জনা পরিস্কার করবে, কিন্তু আমরা যেখানে সেখানে কাগজের টুকরা, ময়লা ফেলানো বন্ধ করব না। আমরা রেইলওয়ের বাথরুমগুলো ক্লিন চাইবো, কিন্তু শিখতে চাইবো না কিভাবে তা ক্লিন রাখতে হয়। আমরা ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স ও এয়ার ইন্ডিয়াতে ভাল খাবার ও প্রসাধনীতে ভরপুর চাইব, কিন্তু ভ্রমনের ক্ষেত্রে পছন্দের তালিকায় ওই এয়ারলাইন্সগুলো থাকবে সবার নীচে। সমাজ দরূদী সেজে নারীর অধিকার, যৌতুক প্রথা বিলোপ, কন্যা সন্তান ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে উচচস্বরে কথা বলি। কিন্তু নিজ ঘরে তার উল্টোটা। আমাদের অজুহাত? বলি, পুরা সমাজ ব্যবস্থাই বদলাতে হবে, আমি একা আমার ছেলের জন্য যৌতুক না নিলে কি হবে? কিন্তু আপনি বলুন, কে এই সিস্টেমটাকে বদলাবে?
দেড় পাতা জুড়ে জনগুরুত্বসম্পূর্ণ আরো অনেক কথা তিনি লিখেছেন। বলেছেন, নিউইয়র্ক যখন আপনার জন্য অনিরাপদ, আপনি দৌড়ান ইংল্যান্ডের দিকে। ইংল্যান্ড যখন আপনাকে চাকরি দেয় না, আপনি দৌড়ান মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে যখন আপনি আটকা পড়েন, আপনি চান নিরাপত্তা, এবার আপনি চান ইন্ডিয়ান গভর্ণমেন্ট আপনাকে বাড়ীতে নিয়ে আসুক। বাইরে সবাই আমরা দেশটার মর্যাদাহানিতে লিপ্ত, কেউ এগিয়ে আসি না কিভাবে সিস্টেমটাকে রপ্ত করা যায়। আমাদের চেতনা শুধুমাত্র অর্থের নিকট বন্ধক।
ডঃ আব্দুল কালাম বক্তৃতা শেষ করেছেন আমেরিকার জনগনের প্রতি জন এফ. কেনেডির বিখ্যাত উক্তিটিকে ইন্ডিয়ানদের উপলক্ষ্য করে নিজের মত করে বলে। আমরা না হয় সেভাবেই আজকের এই আলোচনাটিও শেষ করব। তার আগে উপরুক্ত আলোচনার বাইরে অল্প আরো একটু নজর দিই আমরাই বা কেমন?
বুয়েটের তিন কৃতি সন্তানের বুড়িগঙ্গায় মর্মান্তিক মৃত্যুর ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে লীড নিউজ করা হয়, কিন্তু তাদের কৃতিত্বের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়না। একবিংশ শতাব্দীতে হেলিকপ্টার দিয়ে ত্রাণ ছিটিয়ে সিডরের প্রলয়ংকরী আঘাতে বিপর্যস্ত বনি আদমের খাবার নিয়ে কবুতরের মত কাড়াকাড়ি, হুড়াহুড়ির দৃশ্য তৈরি করা হয়, তাদের ঘুরে দাড়ানোর জন্য প্রাণশক্তি সঞ্চারনে তেমন ভূমিকা রাখা হয়না। যে বাঘা মানুষগুলো আপনজনদের ছিন্নভিন্ন লাশগুলো গাছের উপর থকে নামিয়ে, ক্ষেতের ভিতর থেকে কুড়িয়ে এনে দাফন সেরে আবারো ছেড়া জাল নিয়ে মাছ ধরতে নতুন ভাগ্য গড়তে নদীতে নামেন, তাদের খবর আমরা ফলাও করে প্রচার করিনা। শতাব্দীর নামকরা তান্ডবে দশ হাজারেরও কম মানুষের প্রানহানীতে গোটা বিশ্ব যেখানে দূর্যোগ মোকাবেলায় অভিজ্ঞ বাংলাদেশকে ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ বলে বাহ্‌বা দেয়, স্থানীয় প্রশাসন লোক সামলাতে হিমশিম খায়, আমরা সেখানে কোন কাজে অংশগ্রহন না করে শুধু সমালোচনাই করি।
ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এক্সামিনেশন্সের (সিআইই) জুন ২০০৭-এর ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে তিন সাবজেক্টে বিশ্বের শীর্ষ স্থান অর্জনকারী বাংলাদেশের সেরা তিন সন্তান ইব্রাহীম মোহাম্মদ জুনাইদুর রহমান, নাবিল তারিক হোসেন এবং সাজ্জাদ খান মৌসুমকে নিয়ে গর্ব করেন সিআইইর ডিরেক্টর গাই লেন। যাযাদি ছাড়া ‘তিন কৃতী ছাত্রকে অভিনন্দন’ জানিয়ে এডিটোরিয়াল লিখতে আমাদের হাত কেউ যেন জাপটে ধরে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমেরিকান আরেক ছাত্র হলেন মোহাম্মদ রহমান। আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটি ও ইন্ডিয়ার টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের একটি যৌথ আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি করছেন। আবিস্কার করলেন অভাবনীয় প্যাটেন্ট, 'ওরাল ক্যান্সারের স্ক্রিনিং ডিভাইস' -এর উপর গবেষণা কাজে the portable screening system (PS2) নামক একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যা কম খরচের ও ব্যাটারি চালিত। এটি মুখের নরম্যাল ও প্রি-ক্যান্সার টিস্যুর মধ্যে পার্থক্য ধরার মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয় করতে সক্ষম। তাকে নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এম. ডি’র প্রফেসররা গর্ব করছেন। ইয়াবা সুন্দরী নিকিতা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে লিড নিউজ হয়, অথচ মোহাম্মদ রহমানদের খবর খুব বেশী নিউজপেপারের শীর্ষে আসেনা। কৃতিত্বের, সফলতার এরকম হাজারো উদাহরন আমাদেরও আছে। আমরা শুধু ব্যস্ত আছি পচে ফুলে উঠা গবাদিপশুর সাথে হতভাগা মানুষের লাশের ভেসে যাওয়া চিত্র, আর রোগ-শোক ও সন্ত্রাস নিয়ে।
এবার আসুন উপরের ইমেইলটিতে আমরা কল্পনায় তিনটি কাজ করি। ডঃ আব্দুল কালামের নামে বসাই ডঃ ইয়াজ উদ্দিনের নাম, ইন্ডিয়ার জায়গায় বসাই বাংলাদেশ। আর ফেলো আমেরিকানদের প্রতি জন. এফ. কেনেডির মহামুল্যবান বাক্যটি যেভাবে ডঃ আব্দুল কালাম ইন্ডিয়ানদের উপলক্ষ্য করে বলেছিলেন, আমরাও কল্পনায় ডঃ ইয়াজ উদ্দিনের মুখ থেকে সেভাবে শুনিঃ
Ask what we can do for Bangladesh and do what has to be done to make Bangladesh what America and other western countries are today (বলুন তাই-ই যা আমরা বাংলাদেশের জন্য করতে পারি এবং করুনও তাই যা করা দরকার বাংলাদেশকে আজকের আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পর্যায়ে নিতে)।

* লেখাটি যায়যায়দিন ২০শে ডিসেম্বর, ২০০৭ এ ছেপেছে।

[কৌতুহলী পাঠকদের জন্য ইংরেজীতে পড়তে নিউ নেশনের এড্রসেটা দিলাম। লিংক দিতে গিয়ে এরর মেসেজ আসছে।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১৭
৫৭টি মন্তব্য ১২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×