somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হায়দার- অসাধারণ এক সিনেমা :)

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সিনেমার নাম- Haider (হায়দার) (রিলিজ- ২০১৪)

যত ধরনের সিনেমা পৃথিবীতে তৈরি হয়, তার মাঝে সবচেয়ে কঠিন সম্ভবত সাহিত্য থেকে সিনেমা নির্মাণ। কারণ কি? কারণ মোটামুটি দুই ধরনের বলা যায় -
১- আপনি এক জগতের(সাহিত্য) জিনিস যদি আরেক জগতে(সিনেমা) বানাতে চান, "হুবুহু" করে, তখন প্রশ্ন উঠবে যে আপনি কতটা যথার্থভাবে সাহিত্যের মতো অনুরূপ করে বানাতে পেরেছেন।
২- "হুবুহু বাদ, আমি আমার মতো বানাব তবে সাহিত্যের ছাপ থাকবে"- এই যদি থাকে আপনের ইচ্ছা যাকে হয়তো "বিনির্মাণ" বলা যায়, তাহলে আপনাকে হয়ত সবচেয়ে বেশি শুনতে হবে- "তোরে এত মাতুব্বরি করতে কইছে কে?"

পরিচালক বিশাল ভারদ্বাজ দুই নাম্বার কাজটি করেছেন সাহস করে এবং বলা বাহুল্য তিনি ভালো করেছেন এক নাম্বার প্রসেসে না গিয়ে। কিছু না করে নির্ভুল থাকার চেয়ে মনে হয় সাহসিকতার সাথে কিছু ভুল করা ভালো। শেক্সপিয়ার এর হ্যামলেট কে অ্যাডাপ্ট করেছেন তিনি ভারতের কনটেক্সট এ। ভয় নেই, এই সিনেমা দেখার জন্য আপনাকে হ্যামলেট না পড়লেও চলবে। হ্যামলেট না পড়লে তো ভালো লাগবেই, হ্যামলেট পড়ে এই সিনেমা দেখলেও আপনি মুগ্ধ হবেন।
নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়াতে ভালো লাগা থেকেই হোক বা সিলেবাসে থাকার কারণে পরীক্ষায় পাশের অজুহাতেই হোক- হ্যামলেট আমাকে পড়তে হয়েছে- তাই লেখায় হয়তো কিছু সাহিত্য এর শব্দ(টার্ম) এর কথা থাকতে পারে। ভয়ের কিছু নাই- এগুলো ভয়ংকর কিছু না :P (পরীক্ষার আগের রাত ছাড়া!)

হ্যামলেট এ শেক্সপিয়ার দেখিয়েছেন ডেনমার্ক এর কাহিনী, সেটা হায়দারে এসে হয়ে গেছে কাশ্মির। ডেনমার্ক আর নরওয়ে এর যুদ্ধ এখানে হয়েছে কাশ্মিরের স্বাধীনতা বিতর্ক।কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের চিকিৎসা করার অপরাধে হায়দারের ডাক্তার পিতাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুম করে। বাবাকে খুঁজতে এসে হায়দার জানতে পারে, সেনাবাহিনী তার বাবাকে হত্যা করেছে। আরো জানতে পারে, এই ষড়যন্ত্রের পিছনে আছে স্বয়ং তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী চাচা। তার চাচা সেনাবাহিনীর সহায়তায় জনগণের সাথে বেইমানি করে ক্ষমতায় বসে, বিয়ে করে হায়দারের মাকে। এমন সময় সিনেমাতে আসেন একজন বিচিত্র ব্যক্তি। তার ব্যক্তিত্বের মত তার নামটাও বিচিত্র – “রুহদ্বার”। সে হায়দার এর সাথে দেখা করে তাকে জানায়- হায়দার এর বাবা আর নিখোঁজ নেই, তিনি এখন মৃত। যারা হ্যামলেট পড়েছেন। তারা জানেন যে এই চরিত্রে নাটকে একটি আত্মার কথা বলা হয়েছে, সিনেমাতেও আপনি এই আত্মার রেফারেন্স পাবেন নামের মাধ্যমে- রূহ মানে আত্মা বা soul.

ষোড়শ শতাব্দির ডেনমার্কের কাহিনী ২০১৪ তে কাশ্মিরে এসে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার প্রধান কারণ সম্ভবত Vishal Bhardwaj এবং Basharat Peer এর চিত্রনাট্য লেখনী। আর বিশালের ডিরেকশন নিয়ে বলার কিছু নাই নতুন করে, তার আগের দুইটি সিনেমা যেগুলো শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের অবলম্বনে বানানো- ওমকারা আর মকবুল- সেই দুটোকে তিনি হায়দার দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন।

বিশাল ভারদ্বাজ এর সংগীত পরিচালনায় ছবির গান এবং আবহ সংগীত- দুটিই দারুণ। মূল নাটকে হ্যামলেট একটি মঞ্চ নাটকের আয়োজন করে- সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে- Play within a play (নাটকের ভিতরে নাটক)। জিনিসটা এমন- আপনার চোখের সামনে আপনার কৃতকর্ম একটি নাটকের মাধ্যমে দেখানো হবে- সেটা দেখে আপনার মুখের ও মনের অবস্থা কি হয় তা জানার জন্য। এই জিনিসটা সিনেমাতে এসে হয়ে গেছে "বিসমিল" নামের এক গান। ভারদ্বাজ এই গানের সংগীতায়োজনে মধ্যপ্রাচ্যের সংগীত এর আশ্রয় নিয়েছেন। এই কারণে গানটি লোকগানের একটি আবহ তৈরি করেছে। গুলজার লিখেছেনও "মাশাল্লাহ" লেভেলের। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই গানের সাথে শহিদ কাপুরের নাচ- এরকম নাচ বলিউডের কোন সিনেমাতে এখনও দেখি নাই। গানটা কেমন জানি একটা দম আটকে যাওয়ার মতো অনুভূতি দেয়। বিখ্যাত “Grave-Digging Scene” এ গোরখুঁড়েদের গাওয়া “সো যাও” গানটি সম্ভবত প্রতিটা মানুষকে মৃত্যুর কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিবে- গা ছমছমে একটা অনুভূতি দেয় গানটা।

শহিদ কাপুর সম্ভবত তার জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন। ক্যারেক্টারকে তিনি যেন কার্পেটের মতো নিজের শরীরে মুড়িয়ে নিয়েছেন। হয়তো তিনি ঋত্বিক বা রনবিরের মতো এত বড় সুপারস্টার নন, কিন্তু অভিনয় তিনি যা করেছেন- তাতে বোঝা যায় তিনি আরেক বিখ্যাত অভিনেতা পঙ্কজ কাপুরের যোগ্য সন্তান। এই সিনেমার জন্য তিনি এক রুপিও পারিশ্রমিক নেন নাই, নট অ্যা সিঙ্গেল রুপি- ইহাই মনে হয় ডেডিকেশন।
সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন টাবু- এতটা অসাধারণ উপস্থিতি স্ক্রিনে তার- চোখ সরানো দায়। কে কে মেনন আধুনিক "ক্লডিয়াস" এর চরিত্রে- বেশি জোস। তবে সব মিলিয়ে স্ক্রিনে মাত্র ১০ মিনিটের মতো থেকে ইরফান খান প্রমাণ করলেন- তার তুলনা শুধু তিনি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই তার অভিনয় প্রতিভা দেখলে। শ্রদ্ধা কাপুর বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করলেও কেন জানি মনে দাগ কাটেনি তেমন।

সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক সম্ভবত এর ভারসাম্যতা- চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রে। সব জিনিস অনেক মাপা- যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু- এক ইঞ্চি বেশি না, কমও না। নমুনা দেই একটা, হ্যামলেট নাটকে "ইডিপাস কমপ্লেক্স" নামক একটা জিনিস আছে। "এইটা আবার কি সাকিব ভাই?!" বলে হা হুতাশের কিছু নাই, সহজ ভাষায় বলার চেষ্টা করছি- বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক ফ্রয়েড এর মতে- মায়ের প্রতি ছেলের যে আকর্ষণ, বিপরীত লিঙ্গ হওয়ার কারণে, তাকেই ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে। ("আস্তাগফিরুল্লাহ"- বলে লাফ দেয়ার কিছু নাই, এটাকে জাস্ট একটা পড়ার বিষয় হিসেবে নেয়ার চেষ্টা করেন, আর এমন না যে এটা আপনাকে মানতেই হবে!) মজার ব্যাপার হল এই জিনিসটা পরিচালক তার সিনেমাতে দেখিয়েছেন- কিন্তু অনেক নিয়ন্ত্রিতভাবে- কারণ বিশাল জানেন- তার সিনেমার দর্শক কারা, তারা কতটুকু সহ্য করতে পারবে। সিনেমেটোগ্রাফি দারুণ সিনেমার- কাশ্মিরের সৌন্দর্য নতুন করে আবিষ্কার করা যায়।

কাশ্মিরের অবস্থা দেখে অনেক খারাপ লাগে, সিনেমাতে যা দেখেছি- বাস্তবে না জানি কতটা খারাপ অবস্থা। স্বার্থের জন্য "দুনিয়ার ভূস্বর্গ" নামের এই অসাধারণ রূপের জায়গাটার কি অবস্থা করেছে স্বার্থপর আর "সৃষ্টির সেরা জীব" খ্যাত(!) মানুষ! মন থেকে চাই এই হানাহানি কেটে যাক, স্বজন হারানোর কষ্টের সাথে পৃথিবীর অন্য কোন কষ্টের তুলনা হয়না। আশার ব্যাপার হল- হায়দার হিট হয়েছে। আইএমডিবি রেটিং এখন পর্যন্ত কোন হিন্দি সিনেমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি- 8.8- এবং এটা প্রাপ্য। হায়দার ব্যবসাসফল না হলেও মনে হয় খুব একটা সমস্যা হত না- যেই জিনিস মন জয় করে নেয়, সেটা বক্স অফিস জয় না করলেও খুব একটা সমস্যা নেই। ইটস অ্যা মাস্টারপিস- কোন যুক্তিতেই মিস করার মতো সিনেমা হায়দার না। :)
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×