somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন চাষী নজরুল ইসলাম

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৬১ সাল।
পরিচালক ফতেহ লোহানী একটি সিনেমা বানাচ্ছেন, নাম "আছিয়া"। সিনেমা মানেই এলাহি কাণ্ড, ক্যামেরা ঠিক আছে তো লাইট ঠিক নাই, লাইট ঠিক আছে তো ক্যামেরাম্যান চা খেতে গেছেন- মাথা ঠিক রাখাই দায়! এমন সময় ২০ বছরের একটি ছেলে গুটিগুটি পায়ে, দুরুদুরু বুকে এসে পরিচালক কে সালাম দিয়ে বললেন "স্যার, আমি অভিনয় করতে চাই আপনার সিনেমাতে"। ফতেহ সাহেবের মাথা ইতিমধ্যে অর্ধেক নষ্ট হয়ে গেছিল শুটিং এর ঝামেলায়, এই "পুঁচকে" ছেলের কথা শুনে মাথা সম্ভবত পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেল! "এই কে তুই? ফাজলামি করিস আমার সাথে?" বলে খেঁকিয়ে উঠলেন। কঠিন বরফ ও একসময় ঠাণ্ডা হয়, ফতেহ সাহেব ও ঠাণ্ডা হলেন, বললেন "তোর জন্য বড় কিছু করতে পারব না, ছোট একটা রোল দিলাম, কালকে সময়মত চলে আসিস"। মাত্র কয়েক বছর আগেই বাবা হারানো পরিবারের বড় ছেলে এই ছোট রোলের কথা শুনেই খুশিতে পাগল হয়ে গেল, সেই রাতে ঘুম পর্যন্ত এল না ঠিকমতো! কিন্তু পরের দিন তার জন্য এর চেয়ে বড় "সারপ্রাইজ" অপেক্ষা করছিল। পরিচালক বললেন "তোর কোন রোল করা লাগবে না! আমার সাথে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ কর"। এভাবে অভিনয় করতে আসা ছেলেটার মাথায় কখন যে পরিচালকের পোকা ঢুকে গিয়েছিল, তা সে নিজেও জানতে পারল না।

১০ বছর পরের কথা, ১৯৭১ সাল।
সদ্য যুদ্ধফেরত দুই তরুন খসরু ও মাসুদ পারভেজ ( সোহেল রানা, রুবেলের বড় ভাই।হ্যাপির রুবেল না, নায়ক রুবেল, কুংফু জানা :P ) চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়টিকে সবার কাছে তুলে ধরতে। এমন একটি "মাধ্যমের" কথা তারা ভাবছিলেন যাতে করে একসঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে। তার সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি যেন একটি দলিল হিসাবে থাকে, এই চিন্তাও তাঁদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল দশ বছর আগের সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছেলেটার মাথায়, ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সিনেমায় কাজ করে সে হাত পাকিয়েছে, পরিচালক হওয়ার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভাগ্যদেবীর ইচ্ছায় এই তিনজনের দেখা হল এবং তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই মাধ্যমটি হবে "সিনেমা"। এভাবেই শুরু হয় "ওরা ১১ জন" সিনেমার কাজ। চার মাসের কঠোর পরিশ্রমের শেষে ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা।
ওরা ১১ জন সিনেমাটি অনেক দিক থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সিনেমা থেকে আলাদা। কীভাবে? এই সিনেমাতে যে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করছেন তারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই এগারোজন হলেন: খসরু, মুরাদ, নান্টু, আলতাফ, আবু, হেলাল, আতা, বেবি, অলিন, ফিরোজ ও মঞ্জু। ছবিটির সংলাপ লিখেছেন এটিমএম শামসুজ্জামান। তিনি রাজাকার চরিত্রে ছবিটিতে অভিনয়ও করেছেন। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত অস্ত্র-গোলা-বারুদ সবই ছিল সত্যিকারের- জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মস ও অ্যামুনেশন সরবরাহ করা হয়। জয়দেবপুর সেনানিবাসের সেনা সদস্যরাও অভিনয় করেছেন সিনেমাতে।

সাহস করে সত্যিকারের অস্ত্র তো ব্যবহার করলেন, কিন্তু এর জন্য ঝামেলা কম পোহাতে হয়নি। একটি দৃশ্য ছিল এমন- একটি মেয়েকে পাকিস্তানী হানাদাররা তাড়া করবে এবং গুলি ছুঁড়তে থাকবে কিন্তু মেয়েটির গায়ে কোন গুলি লাগবেনা। যেহেতু গুলি ছিল আসল, তাই গুলি গায়ে লেগে আহত বা নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। চিত্রগ্রাহক আব্দুস সামাদ "আমি সিনেমার অংশ হতে এসেছি, মানুষের মৃত্যুর অংশ হতে আসিনি" বলে বেঁকে বসলেন। শেষ পর্যন্ত খসরু গুলি ছোড়ার দায়িত্ব নিলেন। দৃশ্যটি ধারণ শুরু হল। মেয়েটি দৌড়াচ্ছে আর খসরু একে একে ৩০টি গুলি ছুঁড়লেন। গুলি মেয়েটির খুব কাছ দিয়ে চলে গেল, কয়েকটা জামাও স্পর্শ করল কিন্তু একটাও শরীরে লাগলনা। সফলভাবে এই কঠিন দৃশ্য ধারণ শেষে সবাই আনন্দে খসরুকে জড়িয়ে ধরলেন!
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দেই, এই সিনেমাতে সত্যিকারের পাকিস্তানি সৈন্যরাও অভিনয় করেছেন। দৃশ্যটি ছিলো ধরা পড়ে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যকে মেরে ফেলার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আটকে পড়া দুই পাকিস্তানি সৈন্য তখন চলচ্চিত্রটির ইউনিটের কাছে বন্দী ছিল। তাদেরকে তখনও বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। এই দুই সৈন্যকে দিয়েই দৃ্শ্যটিতে অভিনয় করানো হয়। এরপর তাদেরকে সেনানিবাস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এত সব ঝক্কি ঝামেলা করে যেই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সিনেমা বানালেন, তার নাম চাষী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবি একজন পরিচালক। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সাহিত্য থেকে সিনেমা নির্মাণেও ছিল তার জুড়ি মেলা ভার। শরৎচন্দ্রের ক্লাসিক "দেবদাস" নিয়ে নিয়ে দুই সময়ে দুইটি সিনেমা বানিয়েছেন, একটিতে ছিলেন প্রয়াত বুলবুল আহমেদ, একটিতে শাকিব খান। রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে "শাস্তি" আর "সুভা" নামক দুইটি সিনেমা বানিয়েছেন। শাকিব খানের হাতেগোনা মনে রাখার সিনেমার মাঝে সুভা একটি- এই কৃতিত্ব যতটা না শাকিব খানের, তার চেয়েও বেশি সম্ভবত এই মেধাবি পরিচালকের। তিনিই একমাত্র পরিচালক, যার সিনেমাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অভিনয় করেছিলেন, সিনেমার নাম "সংগ্রাম"। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে বানিয়েছেন "হাঙর নদী গ্রেনেড", যেখানে নিজের মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তার মা পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেন- এই দৃশ্য ভোলার নয়। শুধু সাহিত্য আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই পড়ে থাকেন নি, লেডী একশন সিনেমা "লেডী স্মাগলার" ও বানিয়েছেন।

আরেকটি তথ্য শেয়ার করি। নায়ক ফারুক তার প্রযোজনায় সিনেমা বানালেন, পরিচালক হিসেবে নিলেন চাষি কে। সিনেমার নাম "মিয়াভাই"। সাতটি ট্রলার নিয়ে ১০০ জনের বিরাট দল রওনা দিল আউটডরে, শুটিং এর জন্য। যেই আনন্দ করে ফারুক গিয়েছিলেন, সেই আনন্দ তার থাকল না, তিনি জানতে পারলেন, সিনেমার স্ক্রিপ্ট হারিয়ে গেছে, এও জানতে পারলেন এই কারণে পরিচালক ভয়ে তার কাছে আসেননি তিনদিন। মেজাজ খারাপ না করে চাষিকে কাছে ডেকে বললেন- টেনশনের কিছু নাই, গল্প আপনে জানেন, আমিও জানি, জাস্ট লিঙ্ক ধরে শুটিং করে ফেলব, তবে একটা শর্ত- আর কেও যেন না জানে! সৃষ্টিকর্তা আর দুইটি মানুষ ছাড়া কেও জানতেও পারল না, স্ক্রিপ্ট ছাড়া একটা সিনেমার শুটিং এত ভালভাবে শেষ হয়ে গেল।

এত গুণী মানুষটাকে আমরা ধরে রাখতে পারলাম না, মৃত্যু তাকে গত ১১ জানুয়ারি তাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেল। একে একে সব গুণীজনেরা লাইন দিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর তাঁদের মৃত্যুর পড়ে তাঁদের নিয়ে বিরাট এক একটা লেখা দেয়া আর স্মৃতিরোমন্থন করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকছে না। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কি অবস্থা, সেটাও আমরা জানিনা বা জানার চেষ্টা করি না। চাষী নজরুল ইসলাম কে আমরা একটা একুশে পদক আর দুইটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। গুগলে এই লোকটার শুধু বৃদ্ধ বয়সের ছবি পেয়েছি খুঁজে, অনেক খোঁজার পরে তার যৌবনকালের একটা ছবি পেলাম, এটাই দিলাম, কারণ আমার কাছে তিনি তার কাজের মতই চির যৌবন থাকবেন। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

(তথ্যের জন্য ঋণী- উইকিপিডিয়া, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো আর নিজের সংগ্রহে থাকা সিনেমার কিছু বই। উপস্থাপনার ভঙ্গি সম্পূর্ণ আমার নিজের :) )

৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×