দামী দামী পোশাক, রঙ্গিন জামা, হরেক রকম সুস্বাদু খাবার আর নানা ধরণের আনন্দ-উৎসবের নামই কি ঈদ? ধনী গরিবকে এক কাতারে নামাজই শুধু নয় তাদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা ঈদের অন্যতম উদ্দেশ্য৷ ঈদের উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ তা’আলা নিন্মোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন:
‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ঈদের উদ্দেশ্য হল দুটি:
১) আল্লাহর বড়ত্ব মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা।
২) আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
ইসলামপূর্ব যূগেও বিভিন্ন জাতি বিভিন্নভাবে উৎসব পালন করতো। তবে সেগুলো ছিল শুধু আনন্দ-ফুর্তি আর খেলা-ধুলা। যেমনটি আবু দাউদ শরিফের বর্ণনায় এসেছে- মদীনায় যাওয়ার পর নবীজি (স) দেখলেন, সেখানকার লোকজন দুটি দিনকে উদযাপন করে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে। নবীজি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুদিনের কী তাৎপর্য আছে? তারা বললো, আমরা জাহেলী যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন : আল্লাহ এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দু’টো দিন ছিল আল্লাহ তায়ালা তা পরিবর্তন করে এমন দু’টো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়, তাঁর স্মরণ ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হবে। হযরত ইবনে জারীর রাদি আল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে রাসূলুল্লাহ (স.) প্রথম ঈদ পালন করেছেন।
আল্লাহ ও তাঁর দেয়া বিধান অনুযায়ী যদি আমরা ঈদ উদযাপন করি তবে একদিকে যেমন ঈদের অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে আমাদের জীবন অন্যদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে ধন্য হবে আমাদের পরকালীন জীবন।
কিন্তু ঈদ উৎসবটির সত্যিকার তাৎপর্য যদি বুঝতে হয়, তাহলে নবীজি (স.) এবং সাহাবাদের ঈদ উদযাপন দেখা। তারা কীভাবে ঈদ উদযাপন করেছেন। আসুন, আমরা দেখি নবীজি এবং সাহাবাদের জীবনে ঈদ কেমন ছিল।
প্রিয় নবী (সা.) এর ঈদ উদযাপন
ঈদের দিন সকাল বেলায় নবীঘর ও তার চার পাশে সবকয়টি জায়গায় ঈদ আনন্দের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এ সব কিছুই হচ্ছিল প্রিয় নবী (সা.) এর চোখের সামনে। প্রত্যেকে ঈদ আনন্দে নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করছিল। তারা সকলেই চাইত তাদের নিজ নিজ অনুষ্ঠান সম্পর্কে যাতে বিশ্বনবী (সা.) অবগত হন। প্রিয় নবী (সা.) এর ভালোবাসা ও সম্মানের খাতিরেই তারা এসব করেছিল।
এদিকে আখেরী নবী মুহাম্মদ (সা.) এর ঘরের অবস্থা সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : আখেরী নবী মুহাম্মদ (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল। তাদের দেখে প্রিয় নবী (সা.) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন।
ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) আমার ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির কাছে শয়তানের বাশি? প্রিয় নবী (সা.) তার কথা শুনে বললেন : মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও। অতঃপর যখন প্রিয় নবী (সা.) অন্য মনস্ক হলেন তখন আমি মেয়ে দুটিকে ইশারা করলে তারা বের হয়ে গেল।
অন্যদিকে হুজরা শরিফের খুবই নিকটে আরেকটি অনুষ্ঠান চলছিল, যেটির বর্ণনাও দিয়েছেন আয়েশা (রা.) এভাবে দিয়েছেন : ঈদের দিন আবি সিনিয়ার কিছু লোকজন লাঠি-শোঠা নিয়ে খেলা-ধুলা করছিল। প্রিয় নবী (সা.) হযরত আয়েশা (রা.) কে ডেকে বললেন : আয়েশা তুমি কী দেখতে চাও? আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি আমাকে তাঁর পিছনে দাড় করিয়ে দিলেন, আমার গাল তাঁর গালের উপর রাখলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন: হে বনি আরফেদা, তোমরা শক্ত করে ধর। এরপর আমি যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন তিনি বললেন, তোমার দেখা হয়েছে তো? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন: তাহলে এবার যাও। (বুখারী, মুসলিম)
নবীজির হুজরার সন্নিকটে আরেকটি স্পটে ঈদ উপলক্ষে আরেকটি অনুষ্ঠান শুরু হল। কতগুলো বালক নবীর শানে উচ্চাঙ্গের ও মানসম্পন্ন কবিতা আবৃতি করতে লাগল।
আয়েশা (রা.) বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন, ইত্যবসরে আমরা বাচ্চাদের চেচামেচি শুনতে পেলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দেখলেন হাবশিরা খেলা-ধুলা করছে আর ছোট ছোট শিশুরা তাদের চারদিকে হৈ চৈ করছে। তিনি বললেন : আয়েশা এদিকে এসে দেখে যাও। অতঃপর আমি এসে আমার থুতনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গর্দানের উপর রেখে তার পিছনে থেকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন: তুমি পরিতৃপ্ত হওনি? তুমি কী এখনও পরিতৃপ্ত হওনি? আমি তখন তার নিকট আমার অবস্থান পরীক্ষা করার জন্য বলতেছিলাম না এখনও হয়নি। হঠাৎ ওমর (রা.) এর আগমন ঘটল। সাথে সাথে লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন: আমি দেখলাম জিন ও মানুষ শয়তানগুলো ওমরকে দেখে পালিয়ে গেল। (তিরমিজি)
ওরা যে কবিতাগুলো আবৃতি করছিল সেগুলো অর্থ বুঝা যাচ্ছিলনা, কেননা সেগুলো ছিল তাদের নিজস্ব ভাষায়। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কবিতাগুলোর অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। মুসনাদ ও সহীহ ইবনে হিব্বানে আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, হাবশিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এমন কিছু পাঠ করতেছিল যা তিনি বুঝতেছিলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কী বলছে? সাহাবাগণ বললেন, ওরা বলছে : মুহাম্মদ সৎ ও নেককার বান্দা।
ইসলামে ঈদ একটি সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ প্রতীক। যা দেহ ও মনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। মাহে রমজান ও হজের মাসসমূহের ইবাদত বন্দেগির বাহক হিসাবে ঈদের আগমন ঘটে। ঐ সকল মাসের সব কয়টি ইবাদতই রূহের খোরাক যোগায়। এরশাদ হচ্ছে : তুমি বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। (সূরা ইউনুস : ৫৮)
আর শরীরের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে খেলা-ধুলা ও আনন্দ ফুর্তি ইসলামে বৈধ করা হয়েছে। আর এ কারণেই ঈদের দিনগুলোতে সিয়াম সাধনা হারাম করা হয়েছে। কেননা রোজা রেখে খানা-পিনা ছেড়ে দিয়ে ঈদ উদযাপন করা আদৌ সম্ভব নয়। সাহাবী আনাস (রা.) এর বর্ণনায় এর ইঙ্গিত বহন করে- তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখলেন ইহুদিরা দুটি দিন খেলা-ধুলা ও আনন্দ ফুর্তি করে। তখন তিনি বললেন : আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এর চেয়েও উত্তম দুটি দিন নির্ধারণ করেছেন, তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। (আবু দাউদ, নাসায়ী)