somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২৯ শে এপ্রিল। আজ সেই ভয়াল দিন ।।

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল থেকে গুরিগুরি বৃষ্টি হচ্ছিল ।গতকাল ও আকশের আচরন এমন ই ছিল। মাঝেমাঝে দমকা হাওয়া সহ বৃষ্টি ।স্কুল ছিলনা । আমি আর তুহিন গল্প করছিলাম । আব্বুর ছাত্র লিটন দা এসেছিলেন ।আমি আর তুহিন ওনার সাথে গল্প করতে করতে হাঁটা শুরু করলাম ওনার বাড়ির দিকে ।কাছেই ছিল ।বাড়ির সামনে আম্লকির মত দেখতে (নামটা মনে করতে পারছিনা কিছুতেই) ফলের গাছ । অসংখ্য ফল ধরে আছে । আমরা ইচ্ছা মতন পেরে পলিথিনের ব্যাগে নিয়ে নিলাম ।ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে ছাদে বসে সেই ফল দুই ভাগ করলাম।

বিকালে কোন খেলা হলনা ।আমি তুহিন খোকন জাভেদ ঘুরে ঘুরে ভাবছি কি হতে পারে, আসলেই কিছু হবে কিনা। সন্ধ্যা হতেই বাসাই ফিরে এলাম। আজ পরার কথাও কেও বলছেনা।
আব্বুর সন্দীপ কলেজে অধ্যাপনার কারনে আমরা তখন সেখানে। ছোট ভাইটির বয়স তখন মাত্র আট মাস। বাসাই আমি আম্মু আব্বু আর ছোট বোনটিও আছি। খেতে বস্তেই কারেন্ট চলে গেল। আব্বু খতে খেতে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা বললেন।

রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। প্রচন্ড বাতাস বইছে। ভয়ভ্য লাগছে।আমরা সবাই বেড রুমে। রাত দুটার দিকে ভয়ঙ্কর বাতাস শুরু হল।১০ নং সতর্ক সংকেত ছিল সকাল থেকেই। প্রচন্ড বাতাস এ হঠাৎ করেই আমাদের বেড রূমের উওর দিকের জানালাটা বলতে গেলে উড়েই চলে গেল। টেবিল ক্লথ দিয়ে জানালাটা ঢাকা হল।তবুও বৃষ্টির পানি ঢুকে যাচ্ছিল। ঐ রুমে আর থাকা যাচ্ছিলনা।আমরা সবাই পাশের রুমে চলে গেলাম। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল।শেষ সংবাদ ছিল ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করছে।বিকট শব্দে বাতাস বয়ে চলেছে। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বেডরুমের দরজাটি ভয়ংকর শব্দ করে দুটুকরা হয়ে গেল।

আমাদের বাসার সামনে ছিল বিশাল খেলার মাঠ।সন্দ্বীপ উপজেলা কমপ্লেক্স।মাঠের পরে রাস্তা তারপর দোকান পাট।জানালার প্রায় সব কাঁচই প্রায় ভেঙ্গে গেছে।বিজলীর আলোয় দেখা যাচ্ছিল দোকানের টিন গুলো উড়ে যাচ্ছে।আম্মু ছোট ভাইটিকে বুকে জড়িয়ে বসে আছেন।আমরা গুটিসুটি মেরে পাশেই।দোতালা বিল্ডিং।তেমন ভয়ের কিছু নেই।আব্বু বিভিন্ন জায়গায় থাকা আত্মীয়দের কথা ভাবছেন।একসময় তান্ডব থামল।আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালসকাল উঠে পড়েছিলাম।শৈশবের প্রিয় খেলার মাঠটিতে হাঁটু পানি।উপজেলা কমপ্লেক্স হারামিয়া গ্রামে।সন্দ্বীপের ঠিক মাঝখানে বলা চলে।তারমানে এখানে যেহেতু এত পানি , পুরা সন্দ্বীপ ই প্লাবিত হয়েছে।
একতালায় নামতেই সিঁড়িতে বড় সাইজের চারটি কৈ মাছ দেখলাম।বাসা থেকে মগ এনে চারটাই ধরলাম।এতবড় কৈ এরপর আর কখনো দেখিনি।
মাঠের পাশের জাভেদের পুকুরটি নোনা পানিতে থৈ থৈ করছে। তখনও বিপর্যের কোন খবর জানিনা।
নয়টার দিকে মিজান আঙ্কেলের সাথে তার রেডক্রসের কার্যালয়ে গেলাম।তিনি বেতার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।প্রায় চারদিন সন্দ্বীপ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
আম্মুর সহকর্মী আমার শিক্ষিকা বেবী আপাদের বাড়ী বিধ্বস্ত হওয়ায় তারা আমাদের বাসায় এসে উঠলেন।বেবী আপার সাথে ওনার শ্ডশুর বাড়ী গেলাম।পথে যেতেযেতে দেখলাম লোকজন দুটি লাশ কবর দেবার জন্য নিয়ে চলেছে।চারিদিকে পানি আর পানি।ঐ বাড়ীতেও একটি শিশু মারা যাবার কথা শুনলাম নিউমোনিয়ায়।

চারদিন পর বেতার মেসেজ এল একটি হেলিকপ্টার আসছে সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে।এই খবর ছড়াতেই প্রায় শতাধিক লোক মাঠে জড়ো হয়ে গেল।কিছু সময় পর তার দেখা পাওয়া গেল।দুতিন চক্কর দিয়ে সে নেমে এল। সেনা কর্মকর্তা নেমে এলেন সঙ্গে এনেছেন ১৭ বস্তা চিড়া আর গুঁড়ের দুটি বাক্স। এটা তিনি রেডক্রসের হাতে দেবেনা কারন এটা সরকারী সাহায্য। সরকারী কর্তা হওয়ায় এটা তিনি আব্বুর জিম্মায় দিয়ে উড়াল দিলেন।

আব্বু ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে খবর পাঠালেন। রাতে ঘটেগেল আমার জীবনে দেখা অন্যতম কুৎসিত ঘটনা।হারামিয়া গ্রামে তেমন কোন ক্ষতিই হয়নি। এলাকার ষন্ডাপান্ডারা এল তাদের হাতে পাঁচ বস্তা চিড়া গুঁড় দিতে হবে। অনেক তর্ক বিতর্কের পর আব্বু এক বস্তা দিতে রাজি হলেন এই শর্তে যে তা সবার সামনে এই মাঠেই বিলি করতে হবে। তাই হল আর ঘটে যাওয়া তিক্ততা আমাদের সন্দ্বীপের সবচেয়ে বাজে স্মৃতি হয়ে রইল।সারারাত কেটেছিল ভীতির মাঝে।পরদিন এসব বিলি করে দিয়ে তবেই স্বস্তি এসেছিল। পরের খবর ছিল চিড়া গুলো চেয়ারম্যানরাই মেরে দিয়েছন।

প্রায় লাখো প্রানহানি হয়েছিল সেবার দেশে। ১০-১২ দিন পর দুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী এল ত্রান তৎপরতায়।উপজেলা মেসে সৈনিক আর আমাদের স্কুল ভবনে অফিসাররা। আব্বুকে অন্যতম সম্বনয়ক এর দায়িত্ব দেয়া হল।এলাকার ষন্ডাপান্ডারা এখন মাথা নিচু করে হাটছে।দুতিনজন সেনাদের উপর মাতবরি করতে গিয়ে টের পেলেন আর্মি কি।
উপসাগর যুদ্ধ শেষে আমেরিকান সেনারাও যোগদিল ত্রান তৎপরতায়।তাদের টিম ওয়ার্ক ছিল মুগ্ধ চোখে দেখার মত।নানান দেশের কপ্টার এল ত্রান তৎপরতায়। এত টাইপের কপ্টার দেখেছি বলার মত নয়।লেখাপড়া বন্ধ।একটাই কাজ কপ্টার দেখা।সাথে বিশাল যন্ত্রনাও।ছোটভাইটি ঘুমাতে পারেনা।আম্মু সারাক্ষন তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন।সন্ধ্যা পর্যন্ত এই কাজ।
সেনাদের সম্পর্কে বিশাল আগ্রহ তৈরী হল এই সময়।নিয়ম এবং শৃংখলা এই তাদের জীবন। পরে ধীরে ধীরে আমার মাঝে কাজ করল এটা উল্টা হয়ে।ধূর এত নিয়ম আর শৃংখলায় চলে নাকি।

সবাই ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসের।মেজর রবিন ছিলেন কমান্ড়িং এ।তার ভয়ে সবাই কাঁপত।তার পাশে বড় বেমানান মেজর শাহ আলম।বড় ঠান্ডা মেজাজের অবসরে মাছ ধরা তার শখ।তুহিনের বাবার হুইল নিয়ে দীঘিতে বসে পড়তেন।সাথে আমি আর তুহিন।কোনদিন মাছ ধরতে পেরেছেন বলে মনে পড়েনা।ডাঃ ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন নামটা মনে পড়ছেনা।লেঃ রবিউল।বেচারা, স্যার স্যার করতে করতে জীবন শেষ।
সৈনিকদের সাথেও আমরা গল্প করতাম।নানা অস্র নিয়ে যুদ্ধ নিয়ে।কি হলে কি করতে হবে এইসব।

আমাদের লোভ ছিল আমেরিকানদের সাথে গল্প করাতে।অল্প ইংরেজীতে যা হয় আরকি। আমেরিকান চকলেট ছিল অন্যতম কারন। একদিন এল একদল বিদেশী সাংবাদিক।এক মেয়ে আমাদের বাসায় এল।ভাঙ্গা দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে আমাদের ছবি নিল। এরমধ্যে একদিন এলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।রাস্তা ভাল না থাকায় তিনি ও বেশী দূর ঘুরতে পারলেননা।
কোরবানীর ঈদ এসে গেল।জৌলুসহীন।শূন্যতার মাঝে অন্যরকম ঈদ।

পরিস্হিতি একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।একদিন বাক্সপেটরা গুটিয়ে সেনারা চলে গেল।পুরো এলাকাটি হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল।প্রতিদিন হাজারও লোক আসত মাঠের চারদিকে গোল হয়ে কপ্টার উঠানামা দেখতে। সাধারন লোকদের সরাতে গিয়ে কপ্টারের ব্লেডের আঘাতে এক সৈনিক মারা গিয়েছিল।ঐ কপ্টারেই তার ফিরে যাবার কথা ছিল ছুটিতে।ফিরে গিয়েছিল তবে লাশ হয়ে।এ দৃশ্য অনেকদিন মুছতে পারিনি।
সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে এটা বোঝানোর জন্য অবশ্য তাদের চলে যাওয়ায় প্রয়োজন ছিল। শতশত লোকের চিকিৎসা আর আশ্রয় ও সুষ্ঠ ত্রান কার্যক্রম শেষ করে গিয়েছিল তারা।

স্কুল খুলল।আবার যারযার গন্তব্য খুঁজে নেবার সংগ্রাম শুরু হল। হারানোর বেদনা , তিক্তকর অভিজ্ঞতা সব পেছনে ফেলে জীবন ফিরে এল তার নিজস্ব ধারায়।৬ষ্ঠ শ্রেনীতে চিটাগং কলেজিয়েট এ ভর্তি হয়ে আমাদের ও সন্দ্বীপের পাট চুকাল।
মাঝেমাঝে মনে পড়ে যায় সেই স্মৃতি। চট্টগ্রাম বন্দরকে যখন তিন নং সংকেত দেয়া হয় ভয় পেয়ে উঠি।কামনা করি হে আল্লাহ এ সংকেত যেন আর না আগায়।উপকূল বাসীকে তুমি এ ধরনের বিপদে আর ফেলোনা ।

২৯ শে এপ্রিল। এই দিনেই ঘটেছিল সেই দানবীয় ভয়ংকর তান্ডব ।

সেইদিন হারিয়ে যাওয়া সকলের আত্মার শান্তি কামনায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ বিকাল ৩:২৯
২৬টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×