somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঝুম দ্বীপ -নিঝুম অরন্য

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কেন জানি হিসেবে মিল ছিলনা। যখনই প্ল্যান করি তখনই আবহাওয়া অফিস সতর্ক সংকেত প্রদান করে বসে। এইবার আমি অনড় যাবই যাবই। ঘূর্ণিঝড় মনে হয় ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল। ১৬ই ডিসেম্বর বিকালে শুরু হল যাত্রা- গন্তব্য হাতিয়া মাধ্যম লঞ্চ। সদরঘাট পৌঁছে দেখি ঘটনা অন্যরকম। সাড়ে পাঁচটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও সেটা আসলে ডিজিটাল সাড়ে ছয়টা হবে । এরপর থেকে পুরা ট্যুরে কোথাও আমরা ডিজিটাল সময়ের দেখা পাইনি, সবাই আগের নিয়মেই চলছে। এগারজন যাবার কথা থাকলেও যাত্রা শুরু করলাম ছয়জন, তিনজন নানা কারনে যেতে পারলনা আর দুইজন আরও এ্যাডভেঞ্চারের আশায় আগের দিন ভোলায় পৌঁছে গেছে।

হঠাৎ লঞ্চ থেমে যাওয়ায় আমাদের আড্ডায় ছেদ পরল, কুয়াশায় কিছু দেখা যায়না, মাস্টার ইনডিসিশনে, আমাদের একজন জিপিএস বের করে লোকেশন দেখে বলল কই আছি কোন দিকে যাব, ওনারা কি আর আমাদের কথা শুনেন, পুরাই এনালগ তারা।

সকালে ঘুম থেকে হিম হিম ঠান্ডায় ডেকে গিয়ে দেখলাম আমরা ভোলার দৌলতদিয়া ঘাটে, সেখান থেকে চর তমুজউদ্দীন হয়ে মনপুরা। এখান থেকে অগ্রবর্তী দল আমাদের সাথে যোগ দিবে। ফোনে জানাল একজন মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে, অভয় দিলাম ব্যাপারনা। গরম গরম ডিম ভাজা আর পরোটা নিয়ে তারা আমাদের সাথে যোগ দিল, তার আগেই পূর্ব আকাশে কুয়াশা ঘেরা সূর্যি মামার দেখা মিলল।



এমন সময় আমাদের অবাক করে দিয়ে আফজালের মোবাইলে এক লোক ফোন দিয়ে জানাল সে মানিব্যাগটা পেয়েছে কি করে দিবে জানতে চাইল। আমাদের অবাক করে দিয়ে সে যেন জানাল মানুষের উপর এখনও বিশ্বাস হারানোর সময় আসেনি।ঠিক হল তিনি সেটা ভোলায় কর্মরত আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দিবেন এবং করলেন ও তাই।



মনপুরাকে পাশ কাটিয়ে আমরা পৌঁছালাম হাতিয়ার তমরুদ্দীন ঘাটে। সেখান থেকে জীপে করে নলছিড়ি। তমরুদ্দীন থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া গেলেও কোন ট্রলার পাওয়া গেলনা। বাই রোডে প্রায় দুঘন্টা পর মোক্তারিয়া পৌঁছে নদী পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।

এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়। জেলেরা সাগরের বুকে জেগে উঠা এ চরের নাম দিলেন 'বাল্লারচর' বা বালুর চর। ওসমান মিয়া নামে এক বাথানিয়াও তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর ডিঙ্গিয়ে তার বাথানের শত শত মহিষগুলো নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। তার নামেই সে দ্বীপের নাম হয় চর ওসমান। সরকারী দলিল দস্তাবেজে চর ওসমান হিসাবে এটি এখন লিপিবদ্ধ আছে। সত্তর দশকে হাতিয়ার সংসদ সদস্য ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। তিনি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। বিষ্ময়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই অবলোকন করলেন এর শান্ত স্নিগ্ধ রূপ। তিনি এ দ্বীপের নাম দিলেন নিঝুম দ্বীপ। সে থেকে নিঝুম দ্বীপ হিসেবেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। নিঝুম দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৪৪ বর্গ কিলোমিটার ।



অবশেষে নিঝুমদ্বীপের পলি জমা চাঁদরে পা রাখলাম। ব্যবসায়ী মান্নান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে আগেই জানিয়ে রাখা ছিল তিনি যেন আমাদের জন্য বেবী ট্যাক্সীর ব্যবস্হা করে রাখেন, কারন অবকাশের পর্যটন হোটেল (সরকারী ডাক বাংলোকে ভাড়া নিয়ে বানানো) দ্বীপের অন্য মাথায় । আমরা দেখলাম একটা মাত্র ট্যাক্সী দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভার জানাল এই দ্বীপে একটাই আছে। কি আর করা বাকী চার জন রিক্সায় রওয়ানা দিল। সে এক ভয়ংকর রাস্তা। আইলায় বিধ্বস্ত সে রাস্তা দিয়ে ড্রাইভার যা চালালেন তাকে যে কোন ট্র্যাকেই নামিয়ে দিলে তিনি প্রথম হবেন নিশ্চিত। অবকাশের মনির ভাই আমাদের রুম দেখিয়ে দিলেন, এত ভাল হবে আমরা আশা করিনি।





আসলেই নিঝুম চারপাশ, কোন হৈ হল্লা নেই। শুরু হল আমাদের প্রথম দিনের জঙ্গল সাফারি। সাগর কিনারা ধরে হেঁটে আমরা একটা খালের কাছে পৌঁছে দেখি পার হওয়ার উপায় নৌকা। কিছু সময় অপেক্ষার পর প্রশিক্ষনরত দুই কিশোরের বৈঠায় ভর করে আমরা পার হলাম, তারা হয়ে গেল আমাদের গাইড। শেষ বিকালের আলোয় ঘন জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক পাল হরিণের দেখা পেলেও তারা ছুটে পালাল। প্রথমদিন মনঃপূত হলনা হরিণ দর্শন যদিও সাঁঝবেলায় অল্প কিছু দেখা গেল। তারপর থেকে বাকী ট্যুরের পুরাটাই যেন খাবার গল্প, কি খাব এই নিয়েই যেন সব আয়োজন।

ঐ অঞ্চলের মহিষের দই বিখ্যাত। উদর পূর্তি করে খাওয়া হল মহিষের দই, তারপর রাতে ইলিশের দোপেঁয়াজা সাথে কোরালের ঝোল। আমাদের অবাক করে দিয়ে আসার পথে যে নায়িকাকে দেখছিলাম সেও সেখানে হাজির। নায়িকা আরেক সখী সহ অবকাশের সামনে খালি জায়গায় চক্কর খাচ্ছে, আমরা দোতালায় উঠার সিঁড়িতে বসে আছি। নায়িকা খালি চক্কর খায়, ব্লগার পাথুরেত চোখ বড় বড় করে নায়িকা দেখতাসে, এমন সময় নায়িকার জামাই আইসা কয় তোমার হাতে লাঙ্গল ধরাইয়া দিলেত পুরা জায়গাটা এতক্ষনে ধান লাগানোর জন্য রেডী হইয়া যাইত ;)

বারটায় জেনারেটর বন্ধ হওয়ায় ঘুমাতে গেলাম। সকালে ভরপেট ডিম-ভাজি পরোটা সাবাড় করে ঢুকে গেলাম ম্যানগ্রোভ বনে।

এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, সুন্দরবনে বাঘের ভয়ে যেটা করা সম্ভব হয়নি। বের হয়ে থাকা শ্বাসমুল গুলোকে বড্ড সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেতে হয়। দুই গাইড ডিজে রাহাত আর নায়ক রিয়াজ কি নিশ্চিন্তে হেঁটে চলেছে, আর আমাদের দফারফা।


অনেক দূর ভিতরে ঢুকে হরিণের দেখা মিললেও আমাদের আগমনে তারা খুব একটা খুশি হয়নি বুঝা গেলো নিমিষেই চোখের আড়াল হওয়াই। আমরাও ছুটে চললাম, হঠাৎ দেখা পাওয়া যায়, আবার পালায়। তিন ঘন্টার কস্টকর সাফারি শেষে বসলাম কাঁকড়া আর চিংড়ি ভাজা নিয়ে।

বিকালে শুরু হল মূল অভিযান- টার্গেট হরিণের কাছাকাছি যাওয়া, তারা নাকি আবার নিজের পেটের গুটগুট শব্দেই ভয় পাই। একটা খাল ধরে শুরু হল আমাদের পথ চলা। আমরা আগাই পাখীর ঝাক উড়ে যায় , শিরোনামহীনের গানটি মনে পড়ে যায় - ইচ্ছে হলে ভালবাসিস, না হয় থাকিস যেমন থাকে স্নিগ্ধ গাংচিল।


দুপাশে দুটি চর, একটাতে হরিণের দল অলরেডী বের হয়ে গেছে, আমাদের দেখলে আর ওমুখো হবেনা, তাই অন্যটিতে আমাদের অবতরণ। জঙ্গলের ভিতরে আমরা আস্তানা গেঁড়ে বসলাম যেমন বসে আততায়ীর দল।

অনেক অপেক্ষার পর একটা একটা করে তাদের বের হয়ে আসা দেখলাম, দলে দলে তাদের বিচরন শুরু হল দ্বীপের চড়ায় ঘাষ খাওয়ার জন্য।



এভাবে ক্রলিং করে দেখতে আর ভাল লাগছিলনা, ভাল করে ছবিও তুলতে পারছিনা। সন্তর্পনে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বেশ কাছাকাছি যেতেই তারা টের পেয়ে গেল- শুরু হল তাদের রুদ্ধশ্বাস দৌড়, অভূতপূর্ব এক দৃশ্য, এক দল দৌড়ায়, আরেক দল দেখে তাকিয়ে, তারপর দে দৌড়। কিছুটা ব্যর্থ মনোরথেই আমাদের ফিরতি পথ ধরতে হল।



শুরু হল ট্যুর ডিনারের আয়োজন- বারবিকিউ , আবারও .......।


সকালে বেড টির ব্যবস্হা না হলেও আফতাব ভাই (খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব ওনার ছিল ) জগ ভর্তি খেজুরের রস হাজির করলেন। তারপর হাজির হল চিকন চালের খিচুড়ী সাথে হাঁসের মাংস। প্রশংসা করতে বলে বসলেন এটা শক্ত হাতের না নরম হাতের রান্না ;)

ফিরতি পথ, সাগরে যেন অতিথি পাখির মেলা বসেছে, সে মেলা দুপাশে রেখে আমরা ফিরে চলেছি- আমি যাব চলে, দূরে বহুদূরে, গান শুধু রবে, আমার স্মৃতি নিয়ে - --আফসোস আমি গাইতে পারিনা !!!!













৬৪টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×