somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীরের গজল থেকে -১

১০ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উর্দু কাব্যে সবচেয়ে সন্মানের আসন লাভ করা কবি গালিব লিখেছেন-

তুমি একাই উর্দু ভাষার উস্তাদ নও গালিব
লোকে বলে পুরা কালে মীর নামেও একজন ছিলেন । ।

মীর তকী মীর- উর্দু ভাষার প্রথম শক্তিমান কবি । উর্দু কবিতার জগতে মীর "খুদা এ সুখন"- তথা কাব্যেশ্বর নামে অভিহিত হয়েছেন, অষ্টাদশ শাতাব্দীর উজ্ঝ্বলতম কবি তিনি । তাইতো আরেক জায়গায় গালিব লিখেছেন-

সে নিজেই বেরসিক যে নিজে মীরের গুনমুগ্ধ নয় । ।

একদিকে প্রেমিক আকুল, অধীর, উদভ্রান্ত, দিশেহারা আর অন্য দিকে প্রেমাস্পদ সম্পূর্ণ উদাসীন- মীরের শেরের এই হচ্ছে মুল কথা ।
মীরের সময়কালে দিল্লী আগ্রা প্রভৃতি অঞ্চলে তবায়েফদের আবির্ভাব। তবায়েফ প্রেমের সোপান বেয়ে মীর উঠেছিলেন ঈশ্বর প্রেমের স্তরে ।

তোমার অবারিত করুনা দেখলাম আশা দিয়ে
খেলাচ্ছলে আশা ভঙ্গ করার নিষ্করুনাও দেখলাম,
ভালোই হল যে তোমার মন্দ দিকটাও
প্রত্যক্ষ জানতে পারলাম । ।

মীর তকীকে নারী প্রেমের কবি বলা যায় সঙ্গতভাবে, তবে সে নারীপ্রেমর সুরের মধ্যে মারফতী তথা ঈশ্বর প্রেমের অনুরনন ও শোনা যায় । গালিব কে বলা হয় মুশকিল পছন্দ (দুরুহতা প্রিয়) কবি, তুলনায় মীর কে বলা হয় গম-পছন্দ (দুঃখ প্রিয়) কবি । মীরের জীবন বৃত্তান্ত যতটুকু পাওয়া যায় তার উতস হল ' জিক্র ই মীর' অথবা মীর চর্চা । মুহম্মদ তকী তার লেখন নাম কিংবা তখল্লুস হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শুধু মীর । তবে আরেক সুপরিচিত কবি মীর দর্দ থেকে পৃথক করার জন্য তাকে উল্লেখ করা হয় 'মীর তকী মীর' নামে ।

মীরের জন্ম সাল ১৭২২ কিংবা ১৭২৩ এ আগ্রায়।
দরবেশ পিতা মৃত্যুর সময় বৈমাত্রেয় বড় ভাইকে তিনশ কিতাব দিয়ে গেলেও মীরকে বলে গেলেন তার তিনশত টাকা দেনা শোধ করার জন্য, দারিদ্রের সংসারে বহু কস্টে এই টাকা শোধ করে মীরকে আশ্রয় নিতে হল দিল্লীতে মোগল দরবারের আমীরের নিকট।নাদির শাহ দিল্লী আক্রমন করায় এই সুখ ও বেশীদিন কপালে জুটলনা। দিল্লী ত্যাগ করে পরে বাড়ি গিয়েও আবার তিনি ফিরেও আসেন, মন কস্ট নিয়ে লিখেন- ' এক সময় আমার পায়ের ধুলা যাদের চোখের সুর্মা ছিল এখন তারাই আমার জীবন এত অসহ্য করে তুলল যে আমি আবার দিল্লী চলে যেতে বাধ্য হলাম ' । তবে পেছনের কারন ভিন্ন- আঠারো বছর বয়সে মীর তার এক বিবাহিতা ঘনিষ্ঠা আত্মীয়ার প্রেমে পড়েন যা পরিবার পরিজনের জন্য অস্বস্তিকর ও অসন্মানজনক হয়ে দাঁড়ায় , ফলে সকলে তাকে উতপীড়ন করে আগ্রা ছাড়তে বাধ্য করে, উতপীড়নের মাত্রায় মীর একেবার উন্মাদ হয়ে যান !!!

সুস্হ হবার পর এই প্রতিভাবান যুবক কয়েক বছরের মাঝে সার্থক কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, ফলত অস্টাশী বছরের জীবনে তাকে আর জীবিকা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি, যদিও রাজধানীর জীবনের অস্হিরতা তার জীবনকেও অস্হির করে রেখেছিল।।শেষ বয়সে প্রানের দায়ে তাকে লক্ষৌতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, যদিও দিল্লী জীবন তিনি ভুলতে পারেননি।
আশ্রয় দাতার সাথে সামন্য ঝামেলা হলেই দেখা যেত মীর তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছেন, তেমনি একজনকে নিয়ে লিখেন-

কাল পথে হাঁটতে হাঁটতে পা পড়ে গেল
একটি মাথার খুলির উপর
দেখলাম খুলিটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে,
বলে উঠল, ওহে বেপরোয়া পথিক একটু দেখে পা ফেলো,
আমিও একদিন কারো দর্পোদ্ধত মস্তক ছিলাম । ।

মোগল দের পতনোম্মুখ অবস্হা আর নানা বিপর্যরের মধ্য দিয়ে দিল্লী ছেড়ে জীবনের শেষ ২৮ বতসর তিনি লক্ষৌ এ কাটিয়েছিলেন, যদিও দিল্লী ছিল তার অন্তর জুড়ে। "আমার পোশাক দেখে গরীব মনে করছ! দুনিয়ার সেরা শহর দিল্লী, যা উজাড় হয়ে গেছে, আমি সেই শহরের লোক " ।
লক্ষৌ এর নাবাবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী কিছুদিন পর্যন্ত মীরের ভরনপোষন করলেও একসময় মীর বিস্মৃত হয়ে পড়েন দরবারে। পরে একদিন নতুন নবাব মীরের দুরাবস্হা দেখে সামান্য সাহায্য পাঠালে প্রত্যাখান করেন মীর, পরে আরেক কবির অনুরোধে নিলেও তিনি বলেন- এত দিন পরে ভৃত্য পাঠিয়ে আমাকে অপমান করা কেন ? তিনি তার রাজ্যের রাজা হতে পারেন, আমিওতো আমার রাজ্যের রাজা । দারিদ্য তার অহংকার কখনো কেড়ে নিতে পারেনি, একবার এক কবি নিজের কবিতা শোনানোর পর মীরের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন - মেয়েরা যেখানে হাড়িকুড়ি নিয়ে খেলাধুলা করে সেখানে তোমার কাব্য পাঠ করা উচিত, মীরের সামনে কবিতা পাঠ করতে তোমার লজ্জা করলোনা !!! কবিরা অনেকক্ষেত্রে আশ্রয় দাতার আগ্গাবহ হয়ে উঠলেও মীর থাকতেন ঔদ্ধত, নবাব আসিফউদ্দৌলার গ্রন্থাগারে বসে পাঠ করা রত অবস্হায় নবাব মীরকে বললেন- আপনার হাতের কাছের বই খানা একটু এগিয়ে দিবেন ? মীর নাবাবের দিকে না তাকিয়ে এক ভৃত্যকে দেখে বললেন- ওহে তোমার প্রভু কি চাইছে শোন !!
তবে মীর নিজের বদমেজাজ অসহিষ্ঞুতা এবং অহংকার বিষয়ে যথেস্ট অবগত ছিলেন, অকপটে আত্মভতসনার সুরে লিখেন-
সর্বক্ষন তোমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে
পৃথিবীতে তুমি বেখাপ, আসমানের সঙ্গে তোমার ঝগড়া । ।

পরক্ষনেই ফিরে আসে তার অহংকার-

" আমি যে কটা দিন শ্বাস নিচ্ছি, সে কটা দিনই তোমাদের মজলিসের শোভা " । ।


সবে তো প্রেমের শুরু , এখনই কাঁদছ ?
দেখো ক্রমে ক্রমে আরো কত কী ঘটে । ।


কাল সে তো অনেকক্ষন আমার দিকে চেয়েছিল ;
আমিই আমার হৃদয়ের সর্বনাশ তাকে দেখাতে পারলামনা । ।


এ বক্ষভূমি শস্য শ্যামলা হবেনা কোন দিন,
কেনইবা তাতে বাসনার বীজ বুনে যাচ্ছ ?


মনের মধ্যে কত কী আছে, হে দরদী বন্ধু,
কিন্তু কোন কথা ঠোঁট পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না । ।


বড় ব্যাকুল হয়ে তার কাছে যায় কিছু বলবার জন্য,
কিন্তু মনের কথা মনে নিয়েই চুপি চুপি ফিরে আসি । ।


বিরহের জ্বালা আর তো সইতে পারছি না,
আরও যন্ত্রনা এই যে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিনা । ।

করবো কী, হৃদয়ের কি কোন স্বাধীনতা আছে ?
মাটি কঠিন, আকাশ দূর । ।

হৃদয় থেকে বাস তুলল আর একটি বাসনা,
অকারনে তো চোখে জল আসেনা । ।


মন দিওনা কাউকে, তুমি কি শোন নি-
প্রেমে পড়ে মীরের কী দশাটা হল ?

১০
আমি যখন বললাম, বড়ো অতিষ্ঠ হয়ে গেছি, কী করি, নিজেকে মেরেই ফেলি ?
সেও বলতে লাগল- হাঁ , কিছু তো তোমার করা চাই !

১১
প্রেমকে আমি ছেলে খেলা ভেবেছিলাম,
আজ বড় আশ্চর্য লাগছে নিজের বোকামির কথা ভেবে । ।

১২
প্রতিমা প্রেম (সুন্দরী রমনীর প্রতি প্রেম) পরাধীন করে ফেলেছে
সেই হৃদয়কে যে ঈশ্বরের মতন স্বাধীন ছিল । ।

১৩
লোকে বলে আগের দিনে প্রতিমাদের (সুন্দরী রমনীদের) বুকে দয়া মায়া ছিল,
হায়, ঈশ্বরই জানেন ওরা কবেকার কথা বলছেন । ।



১৪
এক আমিই বঞ্চিত হয়ে চললাম, দুনিয়া থেকে,
নয়তো কালপ্রবাহ দুনিয়াকে কতই না দিয়েছে । ।

১৫
তাঁর উদাসীনতা তো আজকের কথা নয়।
কত কাল হল মীর , তিনি এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন । ।


চলবে....
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×