
কাছরাপট্টি বেশ্যাপাড়া ! সরকারি খাস জমি। শহরের বুকে কম করে হলেও বিঘে দুই জায়গা। দিনের বেলায় সাধারণ মানুষ এই দিকটাই আসলে নাক উঁচা করে। বিবমিষা উগরে আসে। পবিত্র পোশাক অপিবত্র হয়। কিন্তু তাদের অনেকে রাতের অন্ধকারে এই দিকটায় কুঁই কুঁই করে কি যেন খুঁজতে আসে। ইমাম সাহেব নালতের বয়ান করেন, ঠাকুর মহাশয় ভৎসনা করেন- না সমাজটাকে বাঁচানো গেলনা। উচ্ছনে গেল সব। কিন্তু মেয়র সাহেব কিছুই বলেন না। তিনি শুধু দেখেন। দিন আর রাত, তার দৃষ্টি একি রকম। সে দৃষ্টিতে কাছরাপট্টির প্রতি কোন ঘৃণা নেই। আছে কেবলি ভালবাসা। কাছরাপট্টির দিকে তাকালে তার চোখ জ্বল জ্বল করে।
মোমেনা নাছোড় বান্দা। লুলা জব্বার যতই ধমকায় ততই সে বলে মন্ডলের বড় পোলা জগলু তার পেটের সন্তানের বাবা। মায়ের সাথে মন্ডল বাড়ি কাম করতে গেলে জগলু মোমেনারে তার ঘরে নিয়ে যায়, তারপর.......। কিন্তু মন্ডল পরিবারের অনুগত গ্রাম্য সালিশ সে কথা মানবে কেন? গরিবের নালিশ মানতে তারা বাধ্য নয়। "ফকিন্নির বাচ্চারা বড় লোকের সর্বনাশ করতে সব কিছুই পারে। মোমেনা একটা নষ্টা মেয়ে। ওরে গ্রাম থেইক্কা বের কইর্যা দেও জব্বার" বুড়ো আসির উদ্দিন রায় দেয়। এভাবে হাঁসুয়াকান্দি গ্রামের মন্ডল বাড়ির বড় ছেলে জগলু মন্ডল কে নিজের পেটের সন্তানের পিতা দাবি করে নষ্টা মেয়ের তকমা নিয়ে ঘরছাড়া হয়েছিল মোমেনা। এটা ১৫ বছর আগের কথা।
১৫ বছরে পদ্মা মেঘনার বুক চিরে বহু জল গত হয়েছে। মোমেনার গরিব মা বাপ দু'জনে পটল তুলেছে। হাঁসুয়া কান্দির মানুষ মোমেনার কথা ভুলিয়া গিয়াছে। মন্ডল পরিবার শহরের বিশাল আলিশান বাড়িতে জা্যগা করে নিয়েছে।
রাত দিপ্রহর । মেয়র জগলুল হোসেন মন্ডল তার বিশেষ কামরায় বসে ঘামছেন। মোমেনা বেঁচে আছে। বিকেলের দিকে লুলা জব্বার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিস ফিস করে বলে গেল " মোমেনা এই শহরে আছে। কাছরাপট্টিতে গতর বেইচ্চা খায়। সে নিজের চোখে দেইখ্যা আসছে " রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন্ডল অস্থিরতা। সুন্দরী রক্ষীতা আর মদের বোতল আজ রাতে তাকে টানছেনা। তার মাথায় শুধু ঘোরপাক খাচ্ছে একটা ভয় - একটা পরিকল্পনা-মহা পরিকল্পনা। এক ডিলে দুই পাখি ! শুধু ভোরের প্রতিক্ষা। রাত পোহাবার কত দেরী??
ভোর হতে না হতেই প্রবল সামাজিক জোয়ার তেড়ে আসে কাছরাপট্টির জমিনে। ভেসে যায় বেশ্যামাগি-দের খুপড়ি ঘরগুলো । জোয়ারের পানিতে ভেসে উঠে কতগুলো মৌসুমি টুপি। একটা ব্যানার ভেসে উঠে "অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি'' মেয়র সাহেব, মসজিদের ইমাম সাহেব, মন্দিরের ঠাকুর মশায়, গির্জার ফাদার সবাই আছেন জোয়ারের সন্মুখ ভাগে। আহা বেশ!বেশ!! এই না হলে জনপ্রতিনিধি!! এই না হলে সভ্য সমাজ !! ।
তারপর অপার্থিব পবিত্রতায় খাঁ খাঁ করে জেগে উঠে কাছরাপট্টির জমিন।যেন পদ্মার বুকে জেগে উঠা সোনালী চর।
আহা পবিত্র নগরী। জগলু মন্ডলের আলো জ্বলমলে রেষ্ট হাউজ। মুর্খ লোকেরা বলে কাছরাপট্টি হোটেল।তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। কারও বিবমিষা হয়না। মাওলান সাহেব- ঠাকুর মশাই আর কথা বলেন না। রাত গভীর হলে হাই হিলে হিপ দুলিয়ে সুন্দরী ললনরা আসে। টুপি- ধুতি লুকিয়ে সেদিনের অনেক সমাজ বিপ্লবীও আসে। সাংবাদিক- উকিল মোক্তার সবাই আসে। তারপর হুইস্কির চনমনে গন্ধে আদিম উল্লাসে জেগে থাকে পবিত্র নগরীর প্রতিটি নেশাতুর রাত।
কেবল অলিতে গলিতে তখনো গুমোট অন্ধকারে গুমরে কাঁদে কতগুলো ভাসমান পেটের অসামাজিক ক্ষুধা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





