খবরের কাগজ কেনা হয়না অনেকদিন। বাসে কিংবা ফুটপাথে শিশু-নারী-যুবক-মাঝবয়সী-বৃদ্ধ হকার বিক্রয় বাসনা নিয়ে আসে পাশে ঘুর ঘুর করলেও স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে তাদের কে নিরাশ করি। পকেটের টাকা দিয়ে এসব খুন-খারাবির খবর কিনে পড়ার কোন মানে আমার কাছে নেই।
কিন্তু আজ আমার একটা পত্রিকা খুব দরকার। বহুদিন পরে হৃদয়ের খুব গভীরে লুকিয়ে থাকা নিউজপ্রিন্টের চেনা গন্ধ আমাকে উতলা করে দিচ্ছে। সাইন্স ল্যাব থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত হাঁটলাম। চর্ম চক্ষু এদিক -ওদিক সমানে চালনা করেও কোথাও একটা পত্রিকার দোকান পেলাম না। ব্যাপার কি? পত্রিকাওয়ালারা আবার হরতাল করে বসেনিতো?
আমার একটা সিরিয়াস সমস্যা আছে। যখনই কোন জিনিস মন থেকে চাই বা দরকার হয় তখন সেটা কোন এক অজ্ঞাত কারণে গায়েব হয়ে যায়। অথচ অন্য সময় সেটা আমার চোখের সামনে হাজার বার পড়বে। জুতা রং করা খুব দারকার পড়ছে ব্যাস অমনি মুচির বংশ গায়েব। একবার তো কাকলী থেকে বনানী দুই চক্কর মেরেও মুচি বেটার দেখা পাইনি। অথচ অন্য সময় মামা মামা করে আমাকে চরম কুঞ্জুস প্রমাণ করতে আধা জল খেয়ে নামে এরা।
যাই হোক অবশেষে নিউ মার্কেটেটের ঠিক আগে পেয়ে গেলাম চার পায়ার উপর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা পত্রিকার দোকান। বুড়ো করে একটা লোক বসে আছে। আমাদের বাজারের সিরাজ হকারের কথা মনে পড়ল। সিরাজ মিয়া আমাকে চিনতো। আমি কি পত্রিকা পড়ি সেটাও জানতো। তিনি আমার জন্য পত্রিকা লুকিয়ে রাখতেন। আমাদের গ্রামে তখন এই পত্রিকাটির স্টক চট জলদি শেষ হয়ে যেত।
-চাচা একটা ভোরের কাগজ দেন !
চাচা মিয়া ভোরের কাগজ বের করে দিলেন। উনার হাতে দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ভিতরের পাতা থেকে পড়া শুরু করলাম। অন্তরবাদ্যি, অনুগল্প, কবিতা আর আড্ডার সচিত্র খবর। আহ ! পাঠক ফোরাম। কতদিন পর সে পুরণো গন্ধে বিমোহিত হলাম। এতক্ষন দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার ক্লান্তি যেন আনন্দের পায়রা হয়ে ডানা মেলে দিল দুরের নিলয়।
বন্ধু সরফরাজের হাত ধরে পাঠক ফোরামের জগতে পা রেখেছিলাম। তারপর প্রাণের আয়োজনে ডুবে ছিলাম হলুদ কাকাতুয়ার গল্পে। নিজে তেমন কিছুই লিখতাম না। ছিলাম মুগ্ধ পাঠক। সরফরাজ, বোরহান, সালাম ফারুক, ভোলানাথ পোদ্দার,অরুনাভ শিমুল,রশিদা আফরোজ, মরিযাদ হারুণ, মর্জিনা মতিন কবিতা, আরিফ জেবতিক, আতিক দর্জি, ইন্দ্রনীল তাঁতী কত শত শব্দ কারিগরের নাম। দিনের পর দিন এদের বুনে রাখা আসবাবে ঘুনপোকা হয়ে বিচরণ করেছি আর খেয়েছি শব্দের শাস। হঠাৎ সময় দুষ্ট বালক হয়ে ঢিল ছুঁড়ে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল বিশাল বটবৃক্ষের হৃদয় থেকে। আমরাও অনিবার্য শুন্যতায় ডুবে ছিলাম কিছুটা বেলা।
কিন্তু বটবৃক্ষ বলে কথা। পাখিরা আবার ফিরে এসেছে। হাতে হাতে রেখে পণ করেছে আবার গাইবে গান, ভাসিয়ে দিবে শব্দ ডিঙা উত্তংগ জোয়ারে। আবার জমবে মেলা....। বিদগ্ধ মাঝি রিপন ইমরান হাল ধরেছে শক্ত করে। এবার ছলাৎ ছলাৎ করে ছুটে যাবে মন পবনের আদম্য নৌকা।
তাইতো আজ থেকে আবারো কেনা শুরু করলাম ভোরের কাগজ। পড়তে শুরু করলাম পাঠক ফোরাম। ফিরে যদি আসে আমাদের সোনালী দিনগুলো, মস্তিস্কের পাললিক নিউরন যদি কলমে ঝর্ণা হয়ে নেমে ভিজিয়ে দিয়ে যায় যাপিত জীবনের শুকিয়ে যাওয়া সময়গুলো তবে মন্দ কি বলো?
পড়তে পড়তে উল্টো দিকে চলে এলাম অনেক দুর। হকার চাচার কাছে আমার যে পাঁচ টাকা পাওনা আছে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়তেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি এসে মিশে গেল হেমন্তের নরম রোদে।
মেলা মেলা দিন পর হৃদয়ের বন্ধ দুয়ারে এলেমেলো আলোর প্রক্ষেপণ। লিখলাম প্রিন্ট মিডিয়ায়। আজকের ভোরের কাগজে আমার হিজিবিজি লিখা। নষ্টালজিক। চোখ বন্ধ করে ফিরে যাওয়া চৌদ্দ পনের বছর আগে......।
ভাবছি নিয়মিত লিখবো। দেখা যাক কি হয় ....
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:২২