--------------------------------------------
‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম,বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম’ গানগুলোও যেন তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে। একসময় বাবার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের চিঠির যে আবেদন ছিলো, তা এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। পুত্রের কাছে মায়ের একটা চিঠি কিংবা মায়ের কাছে পুত্রের একটা চিঠির কী আবেদন তা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা একটি ছেলে বা মেয়ের অনুভূতিতে কখনোই স্পর্শ করবে না।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা যখন অভ্যস্ত ছিলাম না তখন চিঠিই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এই চিঠিই কখনও বিনোদনের খোরাক যোগাত, কখনও ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্না ঝরাতো, কখনও উৎফুল্ল করত, কখনও করত আবেগে আপ্লুত। কী যে সেই অদ্ভুত টান কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে। কিছু কিছু চিঠি বারবার খুলে পড়ে আবার ভাঁজ করে রাখতে রাখতে ভাঁজের অংশগুলোই ছিঁড়ে যেত। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি, চিঠি পাওয়ার আকুলতা কিংবা চিঠি পড়ার আনন্দ সব কিছুই যেন আজ ম্লান।আজ পকেটে পকেটে মোবাইলফোন। নিমিষেই প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কথা। কাগজে চিঠি লিখে আবার তার জবাবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা সেই সময়টুকুও আজ হারিয়ে গেছে।একটা সময় ছিল একটি কাগজে চিঠি লিখে তার জবাব পাবার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রিয় মানুষকে। চাতক পাখির মত পথের পানে চেয়ে থাকতে হয়েছে। কখন আসবে সেই চিঠি! কখন ডাক পিয়ন জোরে দরাজ কণ্ঠে বলবে চিঠি এসেছে চিঠি, বাড়িতে কে আছেন? প্রিয় মানুষের কাগজে লেখা খামে ভর্তি চিঠি হাতে পেয়ে খুশিতে একেবারে আটখানা। একসময় মার্জিন টানা কাগজে বলপেন কিংবা রেডলিপ কলম দিয়ে কাগজে লেখা একটি চিঠির আনন্দই ছিলো অন্যরকম।হাতে কলম আর সাদা কাগজে চিঠি লেখার শুরুতে ভাষা হতো এমন-এলাহী ভরসা। পাকজনাবেষু ভাইজান, আমার শত কোটি সালাম গ্রহণ করিবেন। সকলকেই আমার সালাম ও ভালবাসা পৌঁছাইয়া দিবেন। পর সমাচার এই যে... ফিরতি ডাকে পত্রের উত্তর দিবেন। সাধু ভাষায় লিখিত এই কাগজের চিঠি প্রবীণদের কাছে আজ শুধুই স্মৃতি। প্রজন্মের কাছে অনেকটাই বিস্ময়। সেদিনের চিঠির ভাষায় শ্রদ্ধেয়দের ‘আমার কদমবুচি গ্রহণ করিবেন’ বাক্যে কদমবুচি শব্দের অর্থ (পায়ে ছুঁয়ে সালাম করা) অনেকেই জানে না।
মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম এই চিঠি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরত। কাগজে চিঠি লেখার বাক্য চয়ন, ভাষার প্রায়োগিক ব্যবহার, চিঠির কথা সব মিলিয়ে চিঠির নান্দনিকতায় স্নেহ ভালবাসার পূর্ণতায় এক অপার মমত্ত্ব উঠে আসত।হাতের লেখা একটি চিঠি হৃদয়ের শত সহস্র কথাই শুধু কইত না, আবেগ আকুলতা ও ব্যাকুলতা সবই প্রকাশ পেত। মা-বাবা যখন সন্তনের হাতের লেখা চিঠি পড়তেন তখন লেখার মধ্যে হৃদয় দিয়ে সন্তানের মুখ দেখতে পেতেন। অবচেতনে চিঠি বুকে জড়িয়ে আদর দিতেন। প্রণয়ের চিঠি তো ছিল একেকটি প্রেমের ইতিহাস। প্রেমিক-প্রেমিকা হৃদয়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রতীক্ষার প্রহরের খুঁটিনাটি ভাষার মাধুর্যে এমনভাবে লিখত যা পড়ে মনে হতো শত ফুল দিয়ে গাঁথা একটি গল্প বা উপন্যাস।প্রণয়ের চিঠি কাগজে লিখতে কত পাতা যে ভরে যেত তার কোন সীমারেখা থাকত না। বেশি পাতার চিঠি হলে খামের ওপর বাড়তি টিকিট লাগাতে হতো। বাড়তি মাশুল না দিলে প্রাপককে তা পরিশোধ করতে হতো। খামের ওপর অর্ধচন্দ্রের সিলমোহর আঁটা এই চিঠিকে বলা হতো বেয়ারিং।ভালবাসার চিঠি তো ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের আবেগের এক মধুময় পাঠশালা। যেখানে লেখার সঙ্গে মিশে থাকত সৃষ্টিশীল ভাবনার প্রকাশ। ভাষা ও জ্ঞানের কত শৈলি দিয়ে একে অপরের (প্রেমিক প্রেমিকা) হৃদয়ের কত গভীরে পৌঁছা যায় তার প্রতিযোগিতা শুরু দেখা। চিঠি পাঠানোর সময় কখনও কাগজের ভাঁজে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়া, কখনও পারফিউমের দুই এক ফোঁটা ফেলে সুগন্ধী করা ছিল বাড়তি অনুভূতির বিষয়।আবার প্রেমের ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়েছে। পরিবারের চিঠিই হোক আর প্রেমের চিঠি হোক, যে চিঠি যত নান্দনিকতার সৃষ্টিতে লেখা তা কতবার যে পড়া হতো! কোন চিঠি পড়ে হৃদয় জুড়িয়ে যেত। কোন চিঠি পড়ে আনন্দে মুখ হাসি ফুটত। আবার কোন চিঠি পড়ে চোখের জলও গড়িয়ে পড়ত।আগের দিনে কোন চিঠি ফেলে দেয়া হয়নি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সাইকেলের স্পোকের মাথায় বড়শির মতো করে তার মধ্যে গেঁথে রাখা হতো। অনেক চিঠি ছিল নীরব স্বাক্ষী।
ডাকঘরের এই চিঠির দিন আজ ফুরিয়ে গেছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় চিঠির বদলে এসেছে কম্পিউটারে ই-মেইল, সেল ফোনের ক্ষুদে বার্তা (শর্ট মেসেজ), সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস হোয়াটস অন ইউর মাইন্ড বক্সে লিখা। বর্তমানে কুরিয়ার সার্ভিসে যে চিঠি আদান প্রদান হয় তার বেশিরভাগই প্রাতিষ্ঠানিক ও অফিসিয়াল। সেদিনের ও আজকের চিঠি সবই চিঠি। তবে কোন চিঠিতে প্রাণের আকুলতা কতটুকু তাই প্রশ্ন! বর্তমানে যার কাছে আমরা চিঠি লিখতে চাই তাকে স্কাইপি বা ভাইবারের মাধ্যমে কম্পিউটারের মনিটরে দেখে কথা বলা যায়। সেল ফোনে সরাসরি কথা বলা যায়। ক্ষুদে বার্তায় অতি সংক্ষেপে জানান দেয়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৩