somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লোকজন তো কেউ আসে না: বিনয় মজুমদার

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




লেখা ও সাক্ষাতকারঃ নাসির আলি মামুন


শিমুলপুর। বাংলাদেশ সীমান্ত ও কলকাতার মইধ্যে একটা ছোট স্টেশন। যারা আমাদের দেশ থেইকা কলকাতায় যাতায়াত করেন সীমান্ত পার হইয়া তারা এই স্টেশন ভেদ কইরা মহানগরীর দিকে ধাবমান। অন্যান্য মফস্বলী ট্রেনযাত্রার মতো এইটার চেহারা রীতিমত মন্থর। কেউ তাকাইয়াও দেখে না। কিন্তু হঠাৎ-সঠাৎ এইখানে বসন্ত নামে। লোকজন ভিড় কইরা দেখে। স্টেশেনও না, ট্রেনরেও দেখে না। কবিরে দেখে, প্রাগৈতিহাসিক আদলে।একজন স্বাবলম্বী স্বাস্থ্যের নির্জন মানুষ স্টেশনে দাঁড়ায় রইছে। কাউরে কিছু কয় না। কেউর দিকে তাকায় না। কিন্তু বালক হইতে নাবালক, বুড়া হইতে বুড়ি সকলে তারে দেইখা বেশ মজা লইতেছে। তিনি নীরব। নাঙ্গা অবস্থায় ট্রেন দেখে, মনে হয় আকাশ গিল্লা খাইতেছে। উপস্থিত সকলে নিচের দিকে মাপমত দেইখা লয় উপযুক্ত চোখ দিয়া। জোয়ান মহিলারা একবার দেইখা প্রায় দৌড়াইয়া স্থানত্যাগ করে। আর সকলে দেখে যেভাবে আমি পশ্চিমবঙ্গের যাদুঘরে আলো-আধারের পোর্ট্রেট দেখি নিষ্ঠুরভাবে। যারে চব্বিশ পরগণার শিমুলপুর স্টেশনে লোকেরা প্রায়ই দেখে বরং যে যার কাজে চইলা যায়। তারে এই গতরে দেইখা সকলের নিয়মিত কাম-কাইজ বন্ধ। মাঝে মইধ্যে উনি এই ভাইল ধরেন, আমারে জানাইল তাঁর এক শিষ্য, যে কবিরাজি করে! তার বাসায় তিন দিন কাটাইছি আমি। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জন্মদিন টার্গেট কইরা অনিকেত শামীমের সঙ্গে সেই কবির বাড়িতে গেছিলাম আমি। স্টেশনের পিছনে পুরান একতলা পাকা দালান ট্রেনের আসা-যাওয়ায় নইড়া-চইড়া যায়। ভিতরে অন্ধকারের ভিতর দিয়া হারিকেন জ্বালাইয়া দরজা খুইলা দিলেন কবি।
অন্ধকার পাশ কাটাইয়া হারিকেনের চিমটি আলো তেল চিকচিকের আদলে বিনয় মজুমদারের গালে ঠাস কইরা বইসা যায়। বাংলাদেশের একাই শুরু–একাই শেষ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কাহিনী যেন মনেরে চমকাইয়া দিল। কবির ওই মূহূর্তের হাতে হারিকেন, মাথায় অনাথ চুলগুলি আর মুখের কিলীন ক্যানভাসে মোটা প্লাস্টিকের চশমা–আমি শাটারে ক্লিক মারি। শিমুলপুর গ্রামের সেই অন্ধকার কুঠঠীর দেয়ালে আলো আছড়াইয়া পড়লে গরীব দেয়াল মূর্তজা বশীরের পেইন্টিং-এর মত মালুম হয়। হঠাৎ দেয়াল আলো নিক্ষেপ করায় বিনয় মজুমদারের বিনয়ী চোখ বেয়াদব হয়ে যায়। আমার আরাধ্য মানুষটির অবাধ্য চোখ রঙ্গিন পাথরের মত ফটোগ্রাফারের দিকে ছুইটা আসে। আহা পথিক, কুটিকালে রঙ্গিন পাথরের সন্ধানে রাজধানী ঢাকার বড় সড়কগুলfর নির্মাণ কাজের কাছাকাছি ঘুরঘুর করতাম আর সংগ্রহ করতাম সেগুলি মূল্যবান কিছুর সমান মনে কইরা। কবির চোখ সেইরকম। আমার ক্যামেরার ফোকাস গিয়া ঠেকলো তাঁর চোখে। পাথরের মতন চোখে।
আমারে পরিচয় করাইয়া দিল যুবক ডাক্তারবাবু ( তার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়তেছে না); বারান্দায় বাইর হইলেন। লুঙ্গি গেঞ্জির ভেতরের মানুষটা আমার দিকে আগাইয়া আসতে পিছাইলাম আমি। যদি থাপ্পর মারে! মেজাজটা সেইরকম। বাংলাদেশের মেহমান দেইখাও কোনো কথা কইলেন না। ঘরে আবার ঢুকলেন, এইবার হাতে তার মাটির বদনা। আরেক হাতে হারিকেন। একটু পিছাইয়া গিয়া দৃশ্যটা দেখতাছি কী করে। হারিকেনের আলোটা হেইলা দুইলা অন্ধকারে ডুব দিল। দরজা খোলা এবং বন্ধের ভিতর হারাইল হারিকেন।বেশ অনেকক্ষণ, কুচ-কাচ আওয়াজে কার্যকরণ বুইঝা নিলাম। অন্ধকারে উঠানে ক্যামেরা তাক কইরা দাঁড়াইছি উঠানে কখন কবি আসবেন। আমার কাজটা তো করতে হবে। ডাক্তারবাবু মতলব বুইঝা আমারে বারণ করে। কবি যদি ক্ষেইপা যায় ছবি আর তোলা যাবে না। এমন সময় প্রায় চল্লিশ ফুট দূরত্বে হারিকেন হাঁইটা আসতেছে। ফ্ল্যাশ লাগানো অবস্থায় শাটারে চাপ দিলাম। তাজ্জব! কবি এদিক-ওদিক খুঁজতেছেন আমারে পাইতেছেন না। আমি যে আউলা শিকারী এইটা উনি জানবেন কীভাবে। তিনি তাঁর প্রাচীন একাকী কুঠরীতে প্রবেশ করলে দেখি দেয়ালে। ডাক্তার উতলা হইয়া আমারে নিয়া গেলেন তার বাড়িতে। পরদিন কবি বিনয় মজুমদারের জন্মদিন।
কলকাতা থেইকা আসছেন অনেক মেহমান, কবিও আসছেন। বাড়ির উঠান পরিষ্কার করা হইছে আগেই। বাড়িতে লাল নীল হলুদ সবুজ রঙ্গের আগা চোখা পাতলা কাগজগুলো আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। কবির বারান্দায় সুতায় লটকানো অনেক বেলুন। কবিকে শুভকামনা জানাইতে ভিড় করতেছে তার সাথীরা, গ্রামের গণ্যমান্যরা, বন্ধুরা। সবার হাতে ফুল বা বই, অন্য কোনো সামান্য উপহার। কবির হাতে উপহার অর্পন করতে চায় সকলেই। কাজেই অপেক্ষা লম্বা বারান্দা। আমার ভিডিও ক্যামেরাটা সচল রাখি। সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি কবির ঘনিষ্ঠ মানুষদের। কবির সঙ্গে মিলাইয়া নিজেদের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে ভুলেন না কেউ। লম্বা কাহিনী। কেউ ছোট করতে চান না। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। ভিডিও ক্যাসেট পর্যাপ্ত নাই, যদি এইভাবে ভিডিও রেকর্ডিং করতে থাকি তাইলে বিপদে পড়তে পারি। তাই কিছুক্ষণ পর বন্ধ রাখলাম ক্যামেরাটা । আমার দিকে তাকায়, আপত্তি করে–বলে টিভি ক্যামেরাটা চালু করুন না দাদা। চালু করি।
ধোপদুরস্ত কিলীন শেভ করা খদ্দের পাঞ্জাবির ভেতর কবি আইসা দাঁড়াইলেন বারান্দায় রঙিন বেলুনের সামনে। তাঁকে আমার স্থির ক্যামেরার ফিল্মে গাঁইথা রাখি। যেন আমার একান্ত বাধ-সাধ এমন সাড়া পাই মুখাবয়বে।দাদা জন্মদিনে হাসেন। অবাধ্য মানুষটির বেয়াদবি মুখ থেইকা জটিল হাসি উপড়াইয়া পড়ে। কাল রাতে প্রথম যেই মুখটা দেখছিলাম, একটু শংকাও করছিলাম আইজকা রিভার্স! ভদ্র নম্র ক্লান্ত এক অনুরাগী যেন বারান্দায় ভক্তদের সঙ্গে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় মিলিত হইলেন। হাসির মইধ্যে তাঁরে আলাদা করা যায় না। অথচ আলাদা হইয়া থাকেন তিনি হামেশা। কৌতূহল হয়, গতরাতের কবি কি এত ভদ্র বিনয় উপহার দিতাছেন সবাইরে! শিষ্যগণ স্মৃতিচারণ করে ভিডিও ক্যামেরা দেইখা। কিন্তু বিনয় দুই-একটা অসমাপ্ত বাক্য ছাড়েন। কোনো কিছু সম্পূর্ন করেন না। তাঁর হাসি মাপতে পারি না। হাসি ছোটগল্পের মত প্রস্থান করে। অন্ধকার, রহস্য। অসম্পূর্ণ বাক্যে সবার সাথে কথা বলেন তিনি। আমার মনে হতে লাগল তাঁর কথাকে কীভাবে ক্যামেরাবন্দি করি। লাইন ধইরা গুরুত্ব দিয়া বসানো হইতেছে। বাড়ির উঠানের মাইকটা আওয়াজ দিয়া যাইতেছে। কেউ কবিতা আবৃত্তি করতেছে, কেউ বিনয় দাদার প্রশংসা করতেছেন ভারি কণ্ঠে। বেশ বড় ভদ্র একটা কেক নিয়া আইছে এ-গ্রুপ অফ ভক্ত। সেইটা নিয়া কবিরে ঘেরাও করছে সকলে।আমার ফোকাস কবির চেহারায় যায় না। হাতের চাকুটায় কেক কাটতে পারতেছে না। ধারালো চাকুসহ হাত কাঁপে, খামাখাই কাঁপে। মনে হইতে লাগল ছুরিটা কাউরে ফিক্কা না মারে! নিরাপদ দূরত্বে থাকি আমি।
চামে একটা কাজ সাইরা রাখছি আগেই। জন্মদিনের সকালে ভিডিওতে সাক্ষাৎকার নিয়া রাখছি। সংক্ষিপ্ত ভক্তরা ভক্তিতে এত গদ গদ যে কোনকিছু করতে চাইলে বাগড়া দেয়, বলে দাদা ক্ষেপে যাবেন। কাউকে না জানিয়ে লোকজন সমবেত ঘরে অনুপ্রবেশ করছিলাম। চৌকিতে বইসা রইছে অসুখী মানুষটা । কিন্তু খ্যাপাটে খোমাটা দেখলাম না। ক্যাল ক্যাল কইরা তাকায় রইলেন আমার আনাড়ি ভিডিও ক্যামেরার চোখে। ভিউ ফাইন্ডারে ক্যামেরার চৌকস যান্ত্রিক চোখ দিয়া পরীক্ষা করি কবির মুখ নাক চোখ চুল দাঁত। তারপর প্যান করি, ঘর দেখি। যত্নহীন চুল-দাড়ি না কাটা আহারে দেয়াল, তারে কেউ আদর করে না। আমি তারে কদর দিয়া ভিডিওচিত্র ধারণ করি। বাদ দেই না কবিরে। দেয়ালে বিছানায় অপ্রচলিত ভাঙা ফার্নিচারে ছিড়া চাদর কোথাকারও আমার ছবিতে চইলা আসে অনায়াসে। যেসব কিছু সমস্বরে বলে, কবিরে তোমাদের চাইতে বেশি ভালবাসি আমরা।
পূর্ব বাংলার লোক বইলা কথা–দুই চাইরটা বাইক্য বললেন আমার সঙ্গে বিনয় মজুমদার। জড়ায় যায় তার কথা। কণ্ঠ বেশ দরাজ। এক সময় নিজের কবিতা ভাল আবৃত্তি শোনা কোনো ঘটনার মত যা উল্লেখ করতে পারলে পুলকিত হই। বাড়ির উঠানে জন্মদিনের দুপুরে মাটিতে বইসা সবাই একসাথে খাইদ্য গ্রহণ বেশ মনে পড়ে। দ্রুত খাইয়া আমি বিনয় মজুমদারের খাওয়া দেখতে যাই। তিনি একা প্রায় অন্ধকার এক কুঠরিতে খাইতে আরম্ভ করলেন।ভিডিও ক্যামেরা সচল থাইকা দেখে কবি খুব দ্রুত খাওয়া সারতেছে। মুখে ভাত-তরকারি ভরতেছেন চটপট। এমন মনে হইতেছিল না চাবাইয়া খাইদ্য গিলা ফালাইতেছেন। কোনো বোনপ্লেট ব্যবহার করতেছেন না। যা কিছু খাইতে চান না সেগুলি মুখ দিয়া ফুরুৎ ফুরুৎ কইরা ডাইনে-বামে ফালাইতেছেন। দৃশ্যটা বেশ দাগ কাটল আমার ফুরুৎ ফুরুৎ আশে পাশে কেউ নাই এমনভাবে নির্বিকার বিনয় মজুমদার। অথচ ক্যামেরায় ছবি তোলা হইতেছে।
সৌজন্যবোধের বালাই নাই। ধার ধারেন না কোনো কিছুতেই। এমন মানুষটার সামনে আমি দাঁড়ানো। বসতে বলেন না, ব্যাপক শনিগ্রস্ত হওয়ার আগেই কবির খাইদ্য গ্রহণের দৃশ্য থেইকা বিরতি নেই। তারপর কবি আসেন জন্মদিনের মাইকের সামনে। কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু আবৃত্তি করছিলেন একটি কবিতা। আবৃত্তি মনে থাকবে অনেকদিন। পারকিনসন্স রোগীদের মত, আসলে এই শরীর কাঁপাইয়া আবৃত্তি করছিলেন। কণ্ঠস্বরও কাঁপানো, অথচ মুগ্ধ সবাই। শিল্পের শিখরে আবৃত্তি যেন ধ্বনিত হইতে থাকে। আরও আবৃত্তি শুনতে চাইছিল সকলে, কিন্তু তিনি নারাজ। মাইকের সামনে থিকা উইঠা চইলা আসলেন। অতৃপ্ত আত্মা। পাগল-দশা চেহারা। শুরুতেই শনাক্ত করা যায় তাঁকে, যিনি ব্যাপক বিনয় মজুমদার।
ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২


***** **** ***

বিনয় মজুমদার, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭
নাসির আলী মামুন: বিনয়দা, আজকে তো আপনার জন্মদিন। তো অন্যান্য বছরের দিনের মতো, বছরের অন্যান্য প্রাত্যহিক দিনের মতো আজকের দিনটা কি খুব আলাদা মনে হয় আপনার কাছে?
বিনয় মজুমদার: খুবই আলাদা।
মামুন: কেন?
বিনয়: লোকজন তো কেউ আসে না আমার এখানে কেউ! আজকে সব লোকজন আসবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে। আমার এক পুরনো বন্ধু আসবে, সেও অবিবাহিত। আমিও অবিবাহিত।
মামুন: পুরনো বন্ধুর নাম কী?
বিনয়: অমিয় দেব। বুড়ো। আমার বয়সী। সে রিটায়ার করেছে সে অবস্থায় মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার পদ থেকে রিটায়ার করেছে। বুড়ো হয়ে গেছে। পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়স। আমার তো আগামীকাল থেকে সাতষট্টি– আমি জন্মেছি রাত বারোটা আটচল্লিশ মিনিটের সময়।
মামুন: আপনার জন্ম তো বার্মায়, তাই না!
বিনয়: বর্মায়, হ্যাঁ।
মামুন: বার্মার কোথায়?
বিনয়: তেডো বলে একটি শহর আছে। ছোট রেলস্টেশন। ছোট রেলস্টেশন–নাম তেডো । মান্ডেলে বলে কী মান্দালয় নাম শুনেছ?
মামুন: না শুনিনি দাদা।
বিনয়: মান্দালয় নামটা আছে মহাভারতে। মান্দালয় শহরের দু’মাইল দক্ষিণে।
মামুন: আপনি সে শহর সম্পর্কে একটু বলবেন, মানে সেই শহরটা কেমন
আপনার স্মৃতিতে আছে এখনও?
বিনয়: হ্যাঁ, স্মৃতিতে আছে তো।
মামুন: কেমন?
বিনয়: সে শহরটার আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেটির চারদিকে মরুভূমি আসলে সে জায়গাটা।মরুভূমি। টেডো শহরটা। মরুভূমি।
মামুন: আচ্ছা, আচ্ছা।
বিনয়: বালিতে ভর্তি। কোন ঘাস-ফাস গজায় না। খালি গজায় কী–ফণিমনসার গাছ। অত মোটা মোটা– ঐগুলো গজায়। ফণিমনসার গাছ ভর্তি। আর তোমার মাঝে মাঝে দুই একটা নিম গাছ ছিল। সেইখানে তেডো রেল স্টেশন তো, রেল স্টেশন থেকে হেঁটে পশ্চিম দিকে গেলে দু’মাইল দূরে উন্ডুন বলে একটি শহর আছে। উন্ডুন শহরটা একটু বড় শহর।
মামুন: আপনি কত সময় পর্যন্ত ছিলেন ঐ এলাকায় যেখানে আপনার জন্ম হয়েছিলো?
বিনয়: উনিশ’শ বিয়াল্লিশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
মামুন: তো মানে তখন তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইয়ে। আপনার বাবা কী করতেন ঐ সময়?
বিনয়: পি ডব্লিউডির ওভারশিয়ার ছিলেন। এলসিই পাস। ঢাকা মিড [?] সাহেবের স্কুল থেকে লাইসেন্সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিলেন। সে ১৯২৫ সালে। লাইসেন্সে অ্যাট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্মাতে গিয়ে… বর্মা তখন ভারতের ভিতরে ছিল… বর্মা তখন ভারতের ভিতরে ছিল… বর্মাতে গিয়ে ওভারশিয়ারের চাকরি পেয়ে যায়। সেইখানে সে শেষ জীবন পর্যন্ত ঐখানেই চাকরি করেছে।
মামুন: তার শেষ জীবন পর্যন্ত?
বিনয়: হা।
মামুন: তো আপনি ফিরে এলেন তারপরে কোথায়?
বিনয়: ফিরে এলাম সে ফরিদপুরে।
মামুন: গোপালগঞ্জে?
বিনয়: হা। ভোলাকান্দি গ্রামটা নামজাদা…
মামুন: বিয়াল্লিশ সালে ফিরে এলেন গোপালগঞ্জে?
বিনয়: হা।
মামুন: সে সময়ের কথা একটু বলেন কীভাবে ফিরে আসলেন?
বিনয়: ফিরে আসতে হয়েছে নানান পদ্ধতিতে। সেই পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উপর দিয়ে।
মামুন: মানে পায়ে হাঁটার পথেই গোপালগঞ্জে আসলেন? নাকি নদীপথও ব্যবহার করলেন?
বিনয়: পায়ে হেঁটে হেঁটে ইম্ফল পর্যন্ত।
মামুন: আরে বাবা!
বিনয়: ইম্ফল থেকে মিলিটারির ট্রাকে করে ডিমাপুর পর্যন্ত। ডিমাপুরের থেকে রেলগাড়িতে চড়ে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জে এসে স্টিমারে চড়ে বৈলতলিতে। বৈলতলি থেকে পায়ে হেঁটে আমার মামার বাড়ি। বেটোরিয়া গ্রামে। আচ্ছা। এইভাবে আসছি।
মামুন: সেখানে কে কে উঠলেন? আপনি, আপনার মা…?
বিনয়: বাবা…
মামুন: বাবা…?
বিনয়: বোন।
মামুন: আর ভাই?
বিনয়: না ভাইয়েরা সব থাকতো এইখানেই। বর্মায় তো বাংলা স্কুলই নেই।
মামুন: আচ্ছা।
বিনয়: সেজন্য ওরা স্কুলে পড়তে হলে মামার বাড়িতে থেকে পড়তো। বেটোরিয়া গ্রামে থেকে পড়তো। স্কুলে পড়তো। ওদের বয়স একটু বেশি তো! স্কুলে পড়তো মামার বাড়িতে থেকে। আর আমরা তখন বর্মাতে। পরে মামার বাড়ি যাওয়ার পর বর্মা থেকে পায়ে হেঁটে হেঁটে ঐ বিভিন্ন রকমের নৌকা করে, স্টিমারে করে, রেলগাড়িতে করে, মিলিটারির ট্রাকে করে ঘুরপাক খেতে খেতে শেষে এই বেটোরিয়া গ্রামে হাজির মামারবাড়িতে।
২.
মামুন: বিনয়দা, গোপালগঞ্জের কথা বলতে ছিলেন। আপনি ওখানে এসে স্কুলে তো ভর্তি হলেন?
বিনয়: স্কুলে ভর্তি হবো কী স্কুল তখন… পাঠশালায় পড়ি তো। ক্লাস টু’তে এসে ভর্তি হলাম। পাঠশালাটি আমাদের বাড়িতেই পাঠশালা। বাবা আমাদের বাড়ির … একটি পাঠশালা খুলে সুরেন পাণ্ডে বলে একজন গুরুমশায় ছিলেন আমাদের… সুরেন পাণ্ডে… তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে–যুদ্ধে গিয়েছিলেন–সৈনিক ছিলেন। বসরা, মক্কা, মদিনা এসব জায়গায় ঘুরে আসা লোক। সৈন্যবাহিনী থেকে রিটায়ার করে স্কুলশিক্ষক হলেন। আমাদের বাড়িতেই পাঠশালাটি–সেখানে ক্লাস টু থেকে ভর্তি হলাম। ক্লাস টু থেকে ভর্তি হয়ে দুই-আড়াই বছর পরে… তখন আবার ক্লাস ফোরে একটা পরীক্ষা হতো। অল বেঙ্গল পরীক্ষা। গভরমেন্ট অফ… ব্রিটিশ গভরমেন্টের পরীক্ষা। এখন যেমন স্কুল ফাইনাল হয়, হ্যাঁ, ম্যাট্রিক হয় তখন সেইরকম ক্লাস ফোরেই একটা পরীক্ষা হতো। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়লে একটা পরীক্ষা হতো। অল বেঙ্গল পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা দিতে আমাদের সেন্টার ছিল জলির পাড়। জলির পাড়ে চলে গেলাম নৌকায় করে।
মামুন: বর্ষাকাল?
বিনয়: বর্ষাকাল। সেই সময় জলির পাড়ে গিয়ে নৌকা করে আমি আর আমার আরেক বোন-তার নাম স্নেহলতা,আমরা দুজনেই ক্লাস ফোর পরীক্ষা দিলাম একসঙ্গে। তারপরে ক্লাস ফোরে পাস করে ক্লাস ফাইভে উঠলাম। ফাইভে উঠে সিক্সে উঠলাম। এই করতে করতে ফরটি এইটে… ফরটি সেভেনে দেশ ভাগ হয়ে গেল। তখনই সঙ্গে সঙ্গে বাবা মা চলে এল এই বঙ্গে।
মামুন: আপনারা কি দেশ ভাগের পরে আসলেন? অনেক পরে আসলেন তো, কয়েক মাস পরে, না?
বিনয়: দেশ ভাগের প্রায় এক মাসের মধ্যে।
মামুন: উঠলেন কোথায়?
বিনয়: কলকাতায়।
মামুন: এখন যে বাড়িতে এই যে আমি আপনার সাথে-এই বাড়িতে আপনার কত বছর যাবত বসবাস?
বিনয়: উনিশ’শ আটচল্লিশ সালে ছিল… উনচল্লিশ… উনিশ’শ উনপঞ্চাশ সাল থেকে এই- এই গ্রামে। উনিশ’শ উনপঞ্চাশ সাল থেকে এই গ্রামে। ঠাকুরনগর স্টেশন তখন ছিল না। ঠাকুরনগর নামও ছিল না।
মামুন: এইটা একটু বলেন। এ এলাকার কথা,তখনকার লোকসংখ্যা…
বিনয়: লোকসংখ্যা- এ গ্রামে তখন সমস্ত মুসলমান ছিলেন। আমাদের এই যে জমি-টমি ইত্যাদি রওশন আলী নামে এক ? মুসলমান ভদ্রলোকের জমি। রওশন আলী। আচ্ছা, এই রওশন আলীর কাছ থেকে কিনে নেয় বাবা। বাবা কিনে নিয়ে, একশ পঁয়ত্রিশ বিঘে জমি ছিল বাবার। রওশন আলীর কাছ থেকে কেনা। লোকজন বেশি ছিল না গ্রামে কিন্তু।
মামুন: আচ্ছা আচ্ছা।
বিনয়: সব মিলিয়ে ধরো–রওশন আলী যখন চলে গেল তোমার পূর্ববঙ্গে, হ্যাঁ, ইস্ট পাকিস্তানে…
মামুন: আটচল্লিশ সালে?
বিনয়: হ্যাঁ, আটচল্লিশ সালে। তারপরেও তোমার এই সারা গ্রামে শ’খানেক লোক থাকতাম আমরা। এখন লোকসংখ্যা হচ্ছে দশ হাজার। গ্রামটা বিরাট। এটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সবচাইতে বড় গ্রাম।
মামুন: আচ্ছা আচ্ছা, তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কী কলকাতার সাথে এই গ্রামের?
বিনয়: এখান থেকে যেতে হতো চাঁদপাড়া মাইল হেঁটে,হেঁটে হেঁটে চাঁদপাড়া গিয়ে চাঁদপাড়া থেকে রেলগাড়িতে চড়ে যেতে হত অন্যান্য জায়গায়। পরে এইখানে যে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর বলে এক এমপি ছিলেন- মেম্বার অব পার্লিয়ামেন্ট। তিনি চাপ দিলেন যে আমাদের একটা রেলস্টেশন শিগগিরই বানিয়ে দাও। আমাদের ওখানে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তখন একটা রেলস্টেশন বানিয়ে দিল গভরমেন্ট অফ ইন্ডিয়া। তা একটা পোস্ট অফিস খুলল,একটা স্কুল– স্কুল তো- স্কুল না হলে চলে না। ছেলেমেয়েরা যদি বাড়িতে পড়াশোনা না করে তাহলে তো ভুলে যাবে সব। ছয় মাস যদি স্কুলে না যায় তাহলে তো ভুলে যাবে সব। সুতরাং প্রথমেই একটা স্কুল খুললেন ঐ প্রমথরঞ্জন ঠাকুরমশাই। প্রমথরঞ্জন ঠাকুর মানে যার কারণে ঐ বারুণী মেলা হয় উনিই, উনিই ঐ প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। স্কুল খুলে সেই স্কুলের মধ্যে ছেলেমেয়েদের পড়াতে দিলেন।
মামুন: আপনি তখন কী করতেন?
বিনয়: আমি তখন কলকাতায় পড়তাম। ঐ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশান… বউবাজার ব্রাঞ্চ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুল। সেই স্কুলে পড়তাম।
মামুন: আসা যাওয়া করতেন এইখান থেকে না থাকতেন কলকাতায়?
বিনয়: কলকাতাতেই থাকতাম। ঘর ভাড়া করে।
মামুন: তারপর লেখালেখি শুরু করলেন কীভাবে?
বিনয়: লেখালেখি শুরু করছি… লেখালেখি শুরু আমার… প্রথম লিখি গিয়ে আমি তের বছর বয়সে। তখন ঐ বৌলতলী স্কুলে পড়তাম। ঐ গোপালগঞ্জের… গোপালগঞ্জের যে স্টিমার স্টেশন তার আগের স্টেশনের নাম হরিদাসপুর, তার আগের স্টেশনের নাম উলুপুর। তার পরের স্টেশনের নাম বৌলতলী। অর্থাৎ গোপালগঞ্জ থেকে বেশি দূরে না। খুব কাছেই বৌলতলী স্কুলে পড়তাম। ঐ বৌলতলী স্কুলের ম্যাগাজিনে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়।উনিশ’শ সাতচল্লিশ খ্রীষ্টাব্দে।আমার বয়স তখন তের বছর।তারপরে এই বঙ্গে এসে… এইবার শেষ করে দাও ভাই।
মামুন: হ্যাঁ, এই তো পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
পশ্চিমবাংলা, ইন্ডিয়া ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭


:: নাসির আলী মামুন
জন্ম, ঢাকা, জুলাই ১, ১৯৫৩। বাবা মজিবর রহমান খান। মা রিজিয়া খানম।
১৯৭২ সালে ধার করা লুপিটাল ক্যামেরা দিয়ে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। নাসির আলী মামুনের ব্যক্তিগত আর্কাইভের নাম ‘PHOTOSEUM’; ফটোজিয়ামে ছবি ছাড়াও খ্যাতনামাদের স্মারক জিনিসপত্র থাকবে। তিনি ২৬টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৯৮৮ থেকে’ ৯৭ পর্যন্ত মার্কিন দেশে প্রবাস জীবন কাটান। বিখ্যাত ও সাধারণ মিলিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার তিনি নিযেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে ৫০টি। শেষ প্রদর্শনী ২০০৬ সালে, সুলতানের ছবি নিয়ে। নাম ছিল ‘গুরু’।
নাসির আলী মামুন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা করেন।
ঢাকার সাভারে জোড়পুলে থাকেন। ছেলে অন্যতম। স্ত্রী নাজমা


* সাক্ষাতকারটি http://www.sakkhatkar.com থেকে নেওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×