somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

:::: ৪০০ বছরের রাজধানীঃ নারিন্দা আর্মেনীয়ান গোরস্তান ::::

১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৪০০বছরের রাজধানীবাসীর হয়তো খুব অল্প কয়েকজন পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান গোরস্তান দেখেনি। হয়তো অনেকেই নাম শুনে চিনতে পারে না। কিন্তু বলধা গার্ডেনের সামনে খ্রিস্টান কবরস্থান বললে সবাই চিনতে পারবেন।যারা দেখেছেন তাদের একটা বিশাল অংশই ভিতরে ঢুকে দেখেননি কি আছে। অবশ্য ঢোকার দরজা বেশীরভাগ সময়ই বন্ধ হয়ে থাকে, এবং ব্যাপটিস্ট চার্চের পার্মিশান লাগে ঢুকতে এটা একটা বড় কারন। যারা ভেতরটা দেখেননি আসুন তাদেরকে ভিতরটা দেখিয়ে আনি।


আমি ইতিহাসের ছাত্র না, ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম জানি। কিন্তু এই গোরস্তান সম্পর্কে অল্প যা জানি সেটাই হালকা চালে বলি। ভারতবর্ষে উপনেবিশিক ইউরোপিয়ান শক্তি অনেক গুলোই ছিল, কিন্তু অভিবাসী বোধহয় শুধু আর্মেনিয়ানরা।তারা বঙ্গভুমীকে পদানত করে শোষন করতে নয়, এখানে থাকতে আসে। তাই বিয়ে এবং আরো অন্যান্য ভাবে স্থানীয়দের সাথে সম্পুর্ন ভাবে মিশে যায়। ঢাকার আরমানীটোলা কিংবা এই অংশতেই তাদের বেশিরভাগ বাড়ি করে স্থায়ী হয়। আর্মেনিয়ানরা খ্রিশ্চান ছিল কিন্তু নবাবী আমলে স্থানীয় মুসলমানদের অনেক সংস্কৃতিকে তারা নিজের মত করে নেয়। সম্ভবত তারা মুসলীম ধারার খুব কাছাকাছি উপায়ে কবর দিত। মুলত ঢাকার আর্মেনিয়ান এবং অন্যান্য খ্রিশ্চানরা শেষঠিকানা হিসাবে ব্যাবহার করতো এটা। পলাশির যুদ্ধেরও আগে থেকে। ১৭৫৭ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর বেনীয়ারা নবাব সীরাজউদ্দৌল্লাহর কাছ থেকে বাংলা ছিনিয়ে নেবার পরেও এরা স্থানীয়দের মতই বাস করতে থাকে, ততদিনে স্থানীয়দের সাথে আর ভালোভাবে মিশে গেছে।

(নবাবী আমলে কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর যুগে সম্ভ্রান্তদের কবর গুলো মন্দির কিংবা এরকম প্রাচ্য স্টাইলের হত)

ইংরেজ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ সবাই আর্মেনিয়ান গ্রেভ ইয়ার্ড ব্যাবহার করতে থাকে। আমি ওখানে মনোযোগ দিয়ে এপিটাফ গুলো পড়তে গিয়ে একটা দোতালা কবরের এপিটাফে দেখলাম ভদ্রলোক ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানীর ঢাকার প্রথম গভর্নর ছিলেন। পলাশির যুদ্ধের প্রায় ২ বছর আগে ঢাকায় মারা যান। এছাড়া অসংখ্য কবর আছে যেগুলোর এপিটাফ পড়ে বয়স উদ্ধার করা অসম্ভব। এক ব্রিটিশ লেফট্যান্টের কবর পেলাম। ২২ বছরের এই তরুন সীপাহী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিজের ইউনিটের নেটিভ সৈনিকদের হাতে মারা যান। ঢাকার প্রথম সিভিল সার্জেনের কবর। এছাড়া কিছু কবরের এপিটাফ অচেনা কোন ভাষায় লেখা। কিছু কিছু গ্রীক বলে চিনতে পারলাম (ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গ্রিক বনিকদের স্মরনে একটা স্তম্ভ আছে)। আর কিছু আছে চাইনিজ। আমার পরিচিত একজন খুব নামকরা ট্রেকার হান রেগী। ওর দাদা চায়না থেকে এসে এদেশে বসতী করে। ওরা ৩ পুরুষের বাঙ্গালী। ওর কাছে শূনেছিলাম তার দাদার কবরও নাকি এখানে।

ইংরেজ শাষনামলে কবরে ভাষ্কর্য রাখা মনে হয় জনপ্রিয় ছিল)




গ্রেভ ইয়ার্ডের মুল গেট দিয়ে ঢুকে কেয়ারটেকারের রুমের পাশ দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে। একটূ এগুলো সাদা বিশাল তোড়ন। হয়তো একসময় এটাই মুল দরজা ছিল। শুরুর দিকের কবর গুলো অনেক অনেক প্রাচীন। নিঃসন্দেহে। খুব কম এপিটাফ পড়া যায়। এখানেই অনেক গুলো কবর আছে যেগুলো তখনকার যখন ইউরোপিয়ানরা বাংলা দখল করতে পারে নি। বাম দিকে বাউন্ডারী ওয়াল বরাবর আরো কিছু কবর আছে। এগুলো মোটামুটি ১৮৩০-১৯৩০ এর মধ্যে। এই কবর গুলোর মধ্যে খ্রিশ্চিয়ান ঐতিহ্য অনুসারে উচুমানের কিছু কারুকায করা স্তম্ভ বা মুর্তি আছে। যেমন এলিজাবেথ নামের এক মহিলার কবরে মা মেরীর ক্রন্দন রত মুর্তীটা সবার চোখে পড়বে। কিংবা মাঝামাঝি যায়গায় ৩ হলি সৌলের হাটূ গেড়ে থাকা মুর্তি। ৩ দিক থেকেই একই রকম লাগে। পুরাতন কবর গুলোতে একটা আকর্ষনীয় বৈশিষ্ট আছে। তারা কবর গুলো প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে বানাতো। অনেকটা মন্দির কিংবা নবাবী স্টাইলের। পরিষ্কার বোঝা যায়, পলাশির যুদ্ধের আগে এবং পরে থেকে সীপাহী বিদ্রোহের আগের একটা দির্ঘ সময় পর্যন্ত ইওরোপিয়ান ঢাকাবাসীরা তাদের শেষ আবাসটা স্থানীয় ডিজাইনে বানাতো।




(এটা ঢাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম গভর্নরের কবর, কবরটা বহুওতলা, পলাশীর যুদ্ধের আগের তারিখ এপিটাফে)

কবর স্থানের শেষ দিকটা (বলধা গার্ডেনের দিকে) আধুনিক। সদ্য জন্মানো শিশুর কবর থেকে স্থানীয় বৃদ্ধ সবার কবর। পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত অনেক কবর আছে। এগুলো মুলত আধুনিক সেমিটারীর মত সাদা ক্রস দিয়ে বানানো। একটা মজার ব্যাপার কবরস্থানের ওয়ালের ওপাশে একটা বড় ক্লিনিক। রোগীদের আবাসটা কবরস্থান লাগোয়া। রোগীদের মানসীক ভাবে দুর্বল করতে নিশ্চই নয়।






+++ভ্যান ট্যাসেলের কবরঃ প্রফেসর মুনতাসীর মামুনের বইয়ে ভ্যান টেসেলের নামটা প্রথম পাই। পরে নেটে খুজতেই তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে পারি। মুনতাসীর মামুনের বইটা হাতের কাছে নাই। নবাবী আমলে একজন যুবরাজের ডায়েরীতেও তার কথা আছে। জেনেট ভ্যান ট্যাসেল ছিলেন একজন অসীম সাহসী এবং বিশ্বখ্যাত মার্কিন মহিলা আস্ট্রোনট। নিউ মেক্সীকোতে জন্মান তিনি বেলুনে করে আকাশে নানা রকম খেলা দেখাতেন। এবং এভাবে অনেক সুনাম করার পর ব্রিটিশ শাষিত ভারত বর্ষে খেলা দেখাতে আসেন। পরবর্তিতে ঢাকার নবাব বাড়িতে খেলা দেখাতে এসে এক্সিডেন্টের ফলে বেলুন থেকে পড়ে নিহত হন ১৮৯২ সালের ১৬ই মার্চ। ঢাকার নবাবের নির্দেশে তাঁকে নারিন্দা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। দি ইন্ডিপেন্ডেন্স পত্রিকা প্রথম তাঁকে নিয়ে স্টোরি করে। কিন্তু নারিন্দা কবরস্থানে কবর চিহ্নিত করার জন্যে একেক শতাব্দীতে একেক রীতি অনুসরন করা হয়, তাই তাঁর কবরটা নিশ্চিত ভাবে খুজে পাওয়া যায়নি। আমি কবরস্থানের কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলেছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কয়েকজন দেশি বিদেশী সাংবাদিক এবং ইতিহাসবীদ ভ্যান ট্যাসেলের সাথে দেখা করতে আসেন। কিন্তু আমরা সবাই জানি উনি নারিন্দায় আর্মেনিয়ান গ্রেভ ইয়ার্ডে আছেন, কিন্তু ঠিক কোনটা তার কবর আজও অনিশ্চিত।

লিঙ্কঃ
Click This Link

ভ্যান ট্যাসেল সম্পর্কেঃ Click This Link
Click This Link

ভ্যানট্যাসেল পরিবারের অনেকেই হয়তো আকাশচারি ছিলেন, তাই নেটে লু ভ্যান ট্যাসেল, পার্ক ভ্যান ট্যাসেল এনাদের নাম আসে। কিন্তু ঢাকায় নিহত জন একজন মহিলা ছিলেন (নবাবের জনৈক পুত্রের ডায়েরীর কপি ৪০০ বছর উপলক্ষে এক মেলায় পড়ার সুযোগ হয়েছিল, অনেকটা আধুনিক ব্লগার দের স্টাইলে মহানগরীর বিশেষ বিশেষ ঘটনা লিখে রাখতেন)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:০৮
২৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×