somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশুক, শুশুক, শুশু বা গাঙ্গেজ ডলফিন

২১ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ৩:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রায় ১৫-২০ বছর আগের কথা। আমি তখন ক্লাস ১/২এ পড়ি। ছোট চাচার পরিবারের সাথে চাচাতো, ফুফাতো অনেক গুলো ভাইবোন মিলে আমরা সবাই মিলে গেলাম একটা পারিবারিক পিকনিকে, তিস্তা নদীর পারে। নদী মানেই নৌবিহার। কিন্তু গ্রুপ নিয়ে ওঠার মত নৌকা পাওয়া যাচ্ছিলো না। ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকা পেয়ে প্রায় পনেরোজন লাফিয়ে উঠলাম। চাচা প্রথমে একটু গাই গুই করছিলো, সদ্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়েছেন, মাঝিকে একটা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ডুববে নাতো?
কি কন ছার, আমি ডুবমু নৌকা ডুববার দিমু না।
নৌকা মাঝ নদীতে গিয়ে আনএক্সপেক্টেড ঝামেলায় পড়ে গেলাম। এক পাল শুশুক নৌকার পাশে এসে নাচানাচি শুরু করে দিল। আমার ৫/৭ বছরের জীবনে এই বিচিত্র চেহারার প্রানীটা এই প্রথমবার দেখছি। টিভিতে দেখা ডলফিনের মতই, এটাও পানির উপরে ভুস ভুস করে লাফিয়ে উঠে, মজার তো। শিশুক গুলো শিশুদের মত খেলতে ভালোবাসে মনে হয়। খেলাচ্ছলে কয়েকবার নৌকায় ঢু মারলো। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় পনেরজন ওঠায় আগে থেকেই নৌকা ডুবু ডুবু ছিল। এবারে ত্রাহি অবস্থা। জানের ভয়ে সবাই গলা ফাটিয়ে চিল্লা চিল্লি। শুশুকরা স্তন্যপায়ী প্রানী, মাছ নয়। সেজন্যে ফুলকা জিনিসটাও নেই। শ্বাস নিতে একটু পরে পরে ভেসে ওঠে। আর এক দঙ্গল শুশুকের ডুবা ডুবিতে নৌকাও ডুবি ডুবি।

অল্প পানিতে শুশুক।

তখন অবাক করা একটা ঘটনা ঘটলো মনে হলো শুশুকেরা দিক পালটে শুধু একদিকে ঢেউ তুলছে যাতে আমরা নদীর পারের দিকে যেতে পারি। নিঃসন্দেহে প্রানীগুলো বুদ্ধিমান। আমাদের চিল্লা চিল্লিতে বড় কয়েকটা নৌকা এসে আমাদের তুলে নিল। সবাই মিলে ডিঙ্গি নৌকার মাঝিকে গালি গালাজ করছিলো। কয়েকজন মাঝি বললো নৌকাডুবে গেলে নাকি ডুবন্ত লোকজনদের মাঝে মাঝে সাঁতরাতে সাহায্য করে শুশুকেরা। তবে এগুলো শুধুই গল্প।

শুশুক হচ্ছে একধরনের মিঠা পানির ডলফিন। পৃথিবীতে আমাজন ডলফিন ছাড়া আর সব মিঠা পানির ডলফিন (রিভার ডলফিন) ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করে। উপমহাদেশে ২ প্রকার রিভার ডলফিন পাওয়া যায়। ১ গাঙ্গেজ ডলফিন আর ২। ইরাবতি ডলফিন। ১৯৭০সাল পর্যন্ত এদের দুই প্রকারকেই ১টা স্পিসিস হিসাবে দেখা হত। পরে আলাদা করা হয়। ইরাবতি ডলফিনের মুখের সামনের অংশ লম্বাটে হয়, এরা পাকিস্তান এবং ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে সাধারনত সাগরের কাছা কাছি থাকে। ইরাবতী ডলফিন পুরোপুরি মিঠাপানির ডলফিন না। এরা সাগরে এবং সাগর নিকটবর্তি নদীতে (মুলত ব্রিড করতে) থাকে। গাঙ্গেজ ডলফিন তথা শুশুক/শিশু/শিশুক (Platanista gangetica ) থাকে মুলত গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ঘোলা পানির নদীতে। জন্মান্ধ এই প্রানীটাকে বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালের কিছু নদী ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। ৭০এর দশকের পর থেকে ব্যাপক জনসঙ্খ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দুষন এবং অতিমাত্রায় মাছ শিকারের ফলে আশঙ্কাজনক ভাবে এই প্রানীটার সংখ্যা কমে গেছে।
শুশুকের মুখের সামনের জ সামনের দিকে বাড়ানো থাকে এবং তাতে প্রচুর দাঁত থাকে। শুশুক ঘোলা পানিতে থাকে এবং এরা জন্মান্ধ, শিকার এবং পথ চলার জন্যে শুশুক একধরনের হাইপারসনিক শব্দ করে। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে বাদুরের মত পদ্ধতিতে চলে। আরেকদল বিজ্ঞানীর ধারনা পানিতে কট কট জাতিয় শব্দ করে এরা পানির মধ্যেই একধরনের কম্পন করে। ১জোরা ফিন থাকে এবং এরা একধরনের গন্ধ জাতীয় তেল নিঃস্বরন করে মাছদের আকর্ষন করে এবং শিকার করে। বাংলাদেশের অনেক জায়গার লোকেরা এই মাছ শিকারের লোভে শুশুক হত্যা করে এই তেল সংগ্রহ করে। স্ত্রী শুশুক আকৃতিতে বড় (এভারেজে 2.4-2.6m) এবং পুরুষ শুশুক 2-2.2m হয়ে থাকে। শুশুক সারাবছর ব্রিড করে এবং স্ত্রী শুশুক ১১ মাস গর্ভ ধারন করে (আজকে ন্যাশনাল ডিসকভারীতে দেখা প্রোগ্রাম অনুযায়ী)


আমাদের ঢাকার আশে পাশে বছর খানেক আগেও প্রচুর শুশুক দেখা যেত। গত বছর আগে পল্লবীর পিছে বেড়ি বাধে প্রতিদিন অসংখ্য শুশুক দেখেছিলাম, এখন কি অবস্থা জানিনা। দু বছর আগে রায়ের বাজার বধ্যভুমীর পিছে বছিলার সামনের নদীতে অনেক শুশুক দেখেছিলাম। এবছর এ নদীটারই অস্তীত্ব নেই। সরকার একটা বিশাল রাস্তা বানিয়েছে বছিলা পর্যন্ত নদীর মাঝ বরাবর, তাই স্রোত না থাকায় নদীটাই মরে গেছে। জায়গাটুকু কয়েকটা হাউজিং সোসাইটি ভাগা ভাগি করে নিয়েছে সাথে সাথে। বছিলা নদীটার অবস্থাও করুন। একটা বিশাল সেতুর কাজ চলছে। গত সপ্তাহে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়েছিলাম। কেরানীগঞ্জ থেকে নৌকায় সোয়ারীঘাট আসার পথে কয়েকটা শুশুক দেখলাম। নদীর অবস্থা করুন। তেল, ময়লা ভাসছে, পানির রঙ পিচ্ছিল কালো। শুশুক দম নেয় বাতাস থেকে পানিতে নয় তাই বেঁচে আছে, কিন্তু এখানে মাছ থাকে না, খাবে কি? এছাড়া বাংলাদেশে জেলেদের একটা বিশাল অংশ অজ্ঞাত কারনে জালে শুশুক আটকালে সেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। দক্ষিন বঙ্গের অনেক জেলেরাই শুশুক মেরে শুশুকের তেল দিয়ে মাছ ধরে। কিন্তু বিশাল অংশ কুসংস্কার থেকে শুশুক পিটিয়ে মেরে ফেলে। অথচ IUCN এর রেড লিস্টেড থ্রেটেন স্পিসিজের তালিকায় শুশুক আছে। এছাড়া গঙ্গা অববাহিকার নদীগুলোর ক্রমশ সঙ্কোচন তো আছেই।
দেয় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি দেয় ডুব টুপ টুপ দেয় পান কৌড়ী। পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, বলাকা আমাদের বাংলা কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করলেও চমতকার এই ডলফিনটার অবস্থান বাংলা সাহিত্যে গল্প কবিতায় খুব কম। শুধুমাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা আটকে পড়া শুশুক আর এক গ্রাম্য বালিকার বন্ধুত্ব নিয়ে চমতকার একটা বই লিখেছিলেন। বকুলাপ্পু।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১৪
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×