somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের নৃসংশতম যোদ্বারা ( এ পর্ব চেঙ্গিস খান)

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মঙ্গোলরা ঘোড়ায় চড়া শুরু করত তাদের শৈশব থেকে, আর জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটে যেত ঘোড়ার পিঠে। শিশুকাল থেকে ঘোড়ায় চড়ার কারনে তাদের পা ধনুকের মত বেকে যেত। এমনও হত কোন মঙ্গোলকে ১০০ পা এর বেশী যেতে হবে তারা লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠে পড়ত।

মঙ্গোলরা তাদের অভি্যান পরিচালিত করত উষ্ণ মৌসুমে, এ সময় তাদের চলার পথে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকত। যেহেতু ঘাসের ওপর ভিত্তি করে মঙ্গোল অভিযান পরিচালিত হত আর ঘাস জন্মানোর জন্য সুর্য অলো দরকার তাই তাদের সাম্রাজ্য ছিল সৌরশক্তি চালিত যেমন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল পালতোলা জাহাজ বা বায়ুশক্তি চালিত।

একজন ইতিহাসবিদের মতে যুদ্বে মঙ্গোলরা তাদের খর্বাকৃত দেহ কাঠামো, কদর্যতা, আর দূর্গন্ধ থেকে উদ্ভূত ত্রাস পুরোপুরি কাজে লাগাত। দৈহিক আকৃতির দিক দিয়ে মঙ্গোলরা ছিল খর্বাকৃতি, পাতলা কোমর, ছোট পা এবং বড় মাথা বিশিষ্ট। মাথার পেছনে আর ওপরে চুল ছেটে রাখত কিন্তু কানের পাশ দিয়ে লম্বা চুল থাকত।

প্রথা অনুযায়ী তাদের কাপড় ধোয়া নিষেধ ছিল। তাদের গায়ের দূর্গন্ধের অন্যতম কারন ছিল তাদের খাদ্য অভ্যাস।বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় তারা শুধু ঘোড়ার দুধ পান করত। যখন যুদ্বযাত্রায় থাকত তখন দুধ দোয়াবার সময়ের অভাবে চলন্ত অবস্থায় ঘোড়ার গলার রগ কেটে মুখ লাগিয়ে রক্তপান করত। রক্ত ঝরা অব্যাহত থাকলে তা তারা থলিতে জমিয়ে রাখত।

মার্কোপোলোর বর্ননা থেকে আমরা জানতে পারি “Marco Polo alleged that the Mongol warriors could travel ten days without stopping to make a fire or heat food, that they drank horses’ blood, and that each man carried with him ten pounds of dried milk paste, putting one pound of it in the leather flask of water each day to make his meal. The warrior carried strips of dried meat and dried curd with him that he could chew while riding; and when he had fresh meat, but no time to cook it, he put the raw flesh under his saddle so it would soon be softened and edible.”

দীর্ঘ যাত্রাপথে ঘোড়ার জিনের নীচে তারা গোস্ত রেখে চলত যাতে তা চাপে নরম হয়ে যেত। পরে ধীরে ধীরে আয়েস করে খেত। টক দুধে ভেজানো রান্না করা ছুচো জাতীয় প্রানী খুব পছন্দ ছিল সেনাদের। ইদুর, বেড়াল, কুকুর, সাপ কোন কিছুই মঙ্গোল সেনাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ যেত না।মঙ্গোলরা ঘোটকীর দুধ ফেনিয়ে কুমিস তৈরী করত, এই কুমিস তাদের খুব প্রিয় ছিল সাধারনত তারা যুদ্ব বন্দীদের পিঠে তক্তা বেধে তার ওপর বসে কুমিস পান করতে খুব পছন্দ করত। অতিরিক্ত কুমিস অনেক সময় তাদের মৃত্যুর কারন হত।

একজন ফ্রান্সিসকান ধর্মজাযক ১২৪৫ সালে প্রবল প্রতাপশালী খানের সাথে দেখা করেন তাকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেবার বাসনায়। তার বর্ননা থেকে জানা যায় চীন দখলের সময় মঙ্গোলরা ভীষন খাদ্যাভাবে পরে তখন পর্যপ্ত বন্দী সাথে না থাকায় প্রতি দশ জনে একজন সৈন্য তারা হত্যা করে খাদ্য হিসাবে। ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মঙ্গোলদের সন্মন্ধ্যে ধারনা ছিল মঙ্গোলরা হল কুকুরের মত মস্তক বিশিষ্ট এক ধরনের প্রানী।

মঙ্গোল যোদ্বাদের বর্ম ছিল লোহার পাতে তৈরী। পাতগুলো মোটা পশুর চামড়ায় পরিধেয়তে সুতা দিয়ে সেলাই করা হত। তাদের শিরোনাস্ত্র ছিল সুচালো। তাদের তলোয়ার ছিল সূচালো আর বাকানো। তাদের তীরের গোড়ার খাজ ছিল খুবই সরু। এর ফলে প্রচলিত ধনুক দিয়ে এগুলো ছোড়া যেতনা এর মানে হল তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট তীর তাদের দিকে শত্রুরা ফিরে পাঠাতে পারত না। তাদের ধনুকে ছিলা পড়াবার জন্য অন্তত দুজন মানুষ লাগত। মঙ্গোলদের অভিধানে ‘ডান’ বা বাম কথাটি ছিলনা তারা ডান বাম বুজাতে পূর্ব পশ্চিম সমার্থক শব্দ ব্যাবহার করত।

মঙ্গোল জাতির জনক ছিল চেঙ্গিস খান। য়েসুকাই ছিলেন কিয়াদ গোত্রের প্রধান স্ত্রীর নাম হেলুন এদের প্রথম সন্তানের নাম তেমুজিন। ১১৬২ সালে ওনান নদীর তীরে একটি ছোট গ্রামে তেমুজিন জন্ম গ্রহন করে। এই তেমুজিন হল ইতিহাস প্রসিদ্ব চেঙ্গিস খান। কিংবদন্তি রয়েছে চেঙ্গিস খান মুঠিতে রক্ত নিয়ে জন্মেছিলেন, যা মোঙ্গলিয়ার ঐতিহ্য অনুসারে ভবিষ্যত নেতা হবার লক্ষন।

শাসকের মতোই ছিল চেঙ্গিসের শৈশব। প্রথা অনুসারে মাত্র ৯ বছর বয়সে কুরতাইয়ের সঙ্গে বিয়েতে আবদ্ধ হন বাবার ইচ্ছায়। তাতার এবং মোঙ্গলিদের অন্তর্দ্বন্দ্বে চেঙ্গিসের পিতাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় গোত্রের প্রধান হিসেবে বাবার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বাসনা পোষণ করেন তিনি। কিন্তু অপরিণত বয়সের দোহাই দিয়ে তার গোত্র তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা চেঙ্গিস এবং তার মা ও ভাইবোনদের অরক্ষিত ফেলে রাখে। চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি এই পরিবারটি জীবনের সঙ্গে যুঝতে থাকে। এ সময় তিনি সত্ ভাইকে হত্যা করেন এবং জেলেও যান। মুক্ত হয়ে চেঙ্গিস দেখতে পান রাজনৈতিক অনৈক্যে মোঙ্গল গোত্রগুলো লিপ্ত। চৌর্যবৃত্তি ও সন্ত্রাস এ সময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এ সময় তিনি মায়ের কাছ থেকে ঐক্যের শিক্ষা লাভ করেন। যার ফসল আজকের মোঙ্গলজাতি। তেমুজিনের প্রথম স্ত্রী বরটে মার্কিত গোত্র দ্বারা অপহরণ হয়।তেমুজিন তার বাবার বন্ধু তাঘ্রুল খানের সহায়তায় মার্কিতদের পরাজিত করে স্ত্রী কে উদ্ধার করেন।এইটা ছিলো ইতিহাসে তার প্রথম বিজয়।

১২০৬ সালে এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে তিনি ‘চেঙ্গিস খান' (মহান) উপাধি গ্রহণ করেন। তার প্রচেষ্টার ফলে মোঙ্গল জাতি তৎকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে এবং ইতিহাসেও এক বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করে।

নতুন উপাধি ধারণ এবং কারাকোরামে রাজধানী স্থাপনের পর (১২০৬ সালে) চেঙ্গিস খান সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহী হন। দৃঢ় প্রত্যয় ও অসামান্য সাহসের অধিকারী চেঙ্গিস খান সমগ্র বিশ্বকে স্বীয় আধিপত্যে আনার স্বপ্নে উৎসাহিত হয়েছিলেন। এই সময় চীনদেশে কীন ও সাঙ নামে দু'টো পৃথক রাজবংশ রাজত্ব করতো। কীন রাজবংশের প্রতি চেঙ্গিসের দৃষ্টি সর্বপ্রথম নিপতিত হয়। এই রাজবংশের বিরুদ্ধে অভিযান চালনা করে তিনি পিকিংসহ অধিকাংশ স্থান স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি সাঙ বংশকেও ধ্বংস করে সেখানে মোঙ্গল আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।

মুহম্মদ শাহ ছিলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের একজন শক্তিশালী সুলতান। প্রথমদিকে চেঙ্গিস খানের সাথে তার বন্ধুত্ব থাকলেও পরবর্তীকালে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে উভয়ের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ দেখা দেয়। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সীমান্ত বিরোধ ছাড়াও আরও দু'টো কারণ চেঙ্গিস খানকে মুহম্মদ শাহের রাজ্য আক্রমণে প্ররোচিত করেছিল। প্রথমত, চেঙ্গিস খানের প্রেরীত উপঢৌকনসহ তার দূত মুহম্মদ শাহের দরবারে আগমন করলে মুহম্মদ শাহ এর রাজনৈতিক অর্থ অনুধাবন করে দূতকে প্রত্যাখ্যান করেন। দ্বিতীয়ত, ওতবা নামক স্থানে মুহম্মদ শাহের নির্দেশে কিছুসংখ্যক মোঙ্গল বনিক নিহত হলে চেঙ্গিস খান এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন এবং ওতবার গবর্নরকে তার কাছে আত্মসমর্পনের আদেশ দেন। মুহাম্মদ শাহ এতে অসম্মত হলে চেঙ্গিস খান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন (১২১৯ সালে)। যুদ্ধে মুহম্মদ শাহ পরাজিত হলে ওতবা এবং বোখারা, হিরাত, বলখ, খোজান্দ, তাসখন্দ, সমরকন্দ প্রভৃতি মোঙ্গল শাসনাধীনে আসলো। এসব অঞ্চলের মোঙ্গলদের নির্মল ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে ঐতিহাসিক গীবন মন্তব্য করেন, ‘এই চার বছরের মধ্যে যে ধ্বংসসাধিত হয়, তা পাঁচশ' বছরেও পুনর্গঠন করা সম্ভব হয় নাই।'

১২২০ সালে মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল উদ্দিন শাহ পিতৃসাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। মোঙ্গল জাতিকে কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়ে ভারতবর্ষে পলায়ন করেন।

চেঙ্গিস খান ১২২২ সালে আফগানিস্তানের হেরাতে শুধু তীর, মুগুর আর খাটো তলোয়ার দিয়ে ১৬ লাখ মানুষ হত্যা করে। নগর আর কৃষি ভূমির জন্য সে সময় মঙ্গোলরা ছিল প্রাকৃতিক দূর্যোগ। মঙ্গোলদের আদি নিবাস মধ্য এশিয়ার ঘেষো স্তেপ ভূমি। তাদের আগে হুন আর স্কিথীয় হানাদারদের উদ্ভব এই অঞ্চল থেকে। ভূপ্রকৃতির কারনে এ অঞ্চলে উন্নত ঘোড়া পাওয়া যেত, আর বিরূপ পরিবেশ তাদের করেছে দূর্ধর্ষ। সব মিলিয়ে চৌকষ যোদ্বা আর নৃশংষ খুনী।

এর পরের পর্ব হালাকু খান কে নিয়ে
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৫৪
৪৫টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×