সময়টা মনে হয় ১৯৯৪ সালের শেষ দিকে। জাকিরের এক লেফটেন্যান্ট আমার রুমে একজন ছোট খাট মানুষ নিয়ে আসল অত্যন্ত তাজিমের সহিত। বলল শের এই ভাইকে রুমে রাখ। খুব সাবধান ভাইর যেন কোন সমস্যা না হয়। আমি ভূলেও কল্পনা করতে পারিনি ওই ছোট খাট মানুষটি কে? শুধু দেখতাম এক মাত্র ওই লেফটেন্যান্ট ছাড়া আর কেউ ওনাকে চেনে না আর শুধু জাকির চিনে। আমরা যারা রুমে ছিলাম ওনাকে একটা বিছানা ছেড়ে দিলাম। খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ আমাদের নতুন অতিথি।
ওই লেফটেন্যান্ট আমার বন্ধু ক্যাডার ছিল। তাকে একদিন একা পেয়ে জিজ্ঞাস করলাম উনি কে? যা শুনলাম আমার কলজে শুকিয়ে গেল। উনার নাম জহির কামাল বাচ্চু। এই ব্লগে যারা যশোরের ওদিকে বাড়ী তারা “যশোরের চানপাড়ার বাচ্চু” র নাম শুনতে পারেন। উনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের যশোর এলাকার সর্বহারার সভাপতি। যশোরের মায়েরা নাকি ওই সময়ে ওনার নাম করে বাচ্চাদের ঘুম পড়াত। ওই সময় উনি ১০০ র উপর মার্ডারের আসামী। তার মধ্যে জোড়া খুন ছিল নাকি ৮টি।
জোড়া খুন বুজেন? জোড়া খুন হল এক গামছায় দু জনের গলা পেচিয়ে খুন করা। উনি নাকি যখন যশোর থাকতেন তখন নাকি তৎকালীন বি এন পি মন্ত্রী তরিকুল যশোর যেতেন না ওনার ভয়ে। বৃহত্তর যশোর জেলার তৎকালীন মূর্তিমান আতংক আমার রুমে। খুব স্বভাবিক ভাবেই খুব প্রয়োজন না হলে রুমের দিকে পা বাড়াতাম না।একটু খোজ নিয়ে দেখলাম যা শুনছি সবই সত্যি এবং অনেক কম শুনছি। ওনাকে খুলনার মানুষ দীপু ভাই নামে চিনত। শোনা যায় কাশেম সাহেব হত্যার সাথে উনি নাকি জড়িত।
ওনাকে ধরার জন্য ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে আলাদা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ওই সময় কি এক ঝামেলায় পরে এসে নাকি হলে উঠছে। এই সব বলে আমার সেই বন্ধু সাবধান করে দিল কাউকে উনার পরিচয় যেন না জানাই। আরে উনার পরিচয় কি জানাবো আমার নিজের পরিচয় আমি তখন ভূলে যাবার উপক্রম। আমাকে উনি দেখলে একটু হাসি দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করত। রুমের বাইরে আর হল গেটে ওনার ৪/৫ জ ন দেহরক্ষী সবসময় পাহারায় থাকত। যদিও ছাত্র ক্যাডাররা ওনাদের পরিচয় জানত না।
শুনুন এক দিনের ঘটনা। ওনার এক বডিগার্ড একখানা .৩৮ রিভলবার এনে বলল ভাই এইডা নিটেল পাডাইছে। উনি বললেন যা ছাদে যেয়ে দেখ গুলি ফুটে কিনা। ওই বডিগার্ড আবার আমার সম বয়সী আর খুব হাসি খুশী খুব অল্প দিনেই আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। নাম মনে করতে পারছি না। যাই হোক সে ছাদে উঠে রিভলবার দিয়ে গুলি করতে যেয়ে দেখে গুলি ফুটেনা। নীচে নেমে এসে বাচ্চু ভাইকে এটা জানালে বাচ্চু ভাই ঠান্ডা গলায় বলল, চল আমার সাথে।
আমার কপাল খারাপ আমি তখন রুমে। ওই বডিগার্ড জিজ্ঞাস করল ভাই শেরকে সাথে নেই? নে বাচ্চু ভাই র উত্তর। এই বার চলেন দেখি নিটেল কে? র্যাবের প্রথম দিকের ক্রস ফায়ারে আগারগাওয়ের যে টপ টেরর মারা গেছিল সেই হল এই নিটেল। আগারগাও কলোনীতে একটা ক্লাব আছে ওই সময় ওখানে নিটেল প্রকাশ বিকাস এরা বসত। যতদুর মনে আছে বিকাস র্যাবের খরচের খাতায় অনেক আগেই। প্রাকাশ ও মনে হয়।
আমি বাচ্চু ভাই আর সেই বডিগার্ড পাচ তলা থেকে নীচে নেমে একটা স্কুটারে (CNG র পুরানো ভার্সন, তেল এ চলত)রওনা দিলাম। বাচ্চু ভাই কিন্তু লুঙ্গি পরেই রওনা দিছিল। আগারগাও ওই ক্লাবের সামনে এসে স্কুটার থামল। প্রথমেই সেই বডিগার্ড লাফ দিয়ে নামল তারপর বাচ্চু ভাই। হনহন ক রে ক্লাবে যেয়ে একজনকে বলল নিটেলকে খবর দিতে আর যেন বলে বাচ্চু ভাই এসেছে। ভাই বিশ্বাস করেন ৫ মিনিটের মধ্যে নিটেল এসে হাজির। সালাম দিয়ে বাচ্চু ভাইর সামনে দু হাত পিছনে দিয়ে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে আছে। ভূলে যাবেন না নিটেল কিন্তু তখন ঢাকার ৫ গুন্ডার এক গুন্ডা আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি নিটেলের আস্তানায়। বাচ্চু ভাই আস্তে করে মাজা থেকে রিভলবারটা বের করে নিটেল কে দিয়ে বলল “নিটেল এটায় গুলি ফোটেনা কি পাঠাইছস। আমাকে এই পর্যন্ত আসতে হল কেন? শোন তুই ঢাকা শহরের গুন্ডা আর আমি বাংলাদেশের গুন্ডা, এরপর আমাকে আসতে হলে তোকে মেরে ফেলব”।
নিজ চোখে দেখলাম নিটোল দরদর করে ঘামছে, অত্যন্ত তাজিমের সাথে মাফ চাইল আর বলল এই ভূল আর হবেনা ও নিজে যেয়ে হলে এসে অস্ত্র পৌছে দেবে। বাচ্চুভাই আর কোন কথা না বলে আমাকে আর সেই বডিগার্ড কে সাথে নিয়ে হলে চলে আসল। নিটেল পিছনে পিছনে স্কুটার পর্যন্ত আসল, বাচ্চু ভাই একবার ও ওর দিকে তাকাল না। পুরা পথ আমি আল্লাহর নাম নিতে নিতে আসছি। ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে নিটেল এক খানা শট গান নিয়ে হাজির ছাদে উঠে গুলি ফুটিয়ে বাচ্চু ভাইর বডিগার্ডের হাতে ওটা দিয়ে নিশ্চুপে বিদায় নিল, হল থেকে নিচে নামার সময় আমার সাথে নিটেলের দেখা আমাকে খুব করে অনুরোধ করল ভাই যেন ওর ওপর না রাগ করে সেটা তাকে বুজাতে। নিটেল ধরে নিছিল আমি বিরাট মাপের কিলার। না হলে বাচ্চু ভাইর সাথে আমি কেন?
ওই বডিগার্ডের মুখ থেকে শুনছিলাম বাচ্চু ভাই নাকি ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত ভাল মানুষ ছিল কিন্তু তার ১৬/১৭ বছর বয়সে তার বাবা ভাই কে নাকি সর্বহারার অন্য গ্রুপ মেরে ফেলে তার চোখের সামনে, প্রতিশোধ নেবার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। যারা তার বাবা কে মারছিলো তাদের নাকি ভোতা চাকু দিয়ে কুপিয়ে আস্তে আস্তে বাচ্চু খুন করেছিল। তারপর তাদের মাথা কেটে ওই বাড়ির উঠানে রেখে এসেছিল।
আমার রুমে উনি ছিলেন প্রায় ১৫ দিন এর মধ্যে আমার বেডের চাদর ছিড়ে গিয়েছিল দেখে চমৎকার একটা চাদর কিনে দিয়েছিল। আমাকে এক দিন নিরবে নিয়ে খাইয়েছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম উনি নাকি খুলনা যাবেন। খুলনা ওনার বউ বাচ্চারা থাকত। বাচ্চাদের উনি খুব ভালবাসতেন। উনি যখন খুলনা গেলেন পুলিশের গোয়েন্দা মারফত সে খবর স্পেশাল ফোর্সের কাছে চলে গেল। উনার বউর সাথে দেখা হবে খুলনা নিউ মার্কেটে। পুলিশ সিভিলে পুরা নিউ মার্কেট ঘিরে ফেলে। নির্দিষ্ট সময় যখন বাচ্চু ভাইর বউ উনার সাথে দেখা করতে আসে। শুরু হল খুলনা নিউ মার্কেটে বন্ধুক যুদ্ধ পুলিশের সাথে। ধরা পরলেন বাচ্চু ভাই। উনাকে এরপর বিভিন্ন জেলে কড়া পাহারায় রাখা হয়। হাফ ছেড়ে বাচে বৃহত যশোরের মানূষ। ১৯৯৬ সালে জেল বিদ্রোহের সময় জেলের মধ্যে বাচ্চুকে গুলি করে মারা হয়। ওই সময় অনেক আসামীই পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
শোনা কথা এগুলো সব। ওই বিদ্রোহে নাকি বাচ্চুর হাত ছিল না উনি নাকি অংশ গ্রহনও করেনি উনার তৎকালীন প্রতিপক্ষ হাসান নাকি পুলিশকে টাকা দিয়ে ওনাকে মেরে ফেলে। উনার মারা যাবার পর তৎকালীন বিচিত্রায় উনাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন বের হয়েছিল। উনার সন্মন্ধ্যে যা যা শুনছিলাম উনি আসলে তার থেকেও ভয়ংকর ছিলেন। আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর খুনী ছিলেন উনি। (চলবে)
শেষের পর্ব
আমার দেখা ঢাকা ভার্সিটির অস্ত্রবাজরা -শেষ পর্ব