somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকার বাঈজী কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব)

১৩ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ঢাকার বাঈজী কাহিনী (প্রথম পর্ব)


মোস্তারী বাঈ শুধু সুরের জাদুতে বশ করতেন শ্রোতাদের। ১৮৭০ সালে ঢাকার নবাব আব্দুল গনির আমন্ত্রনে শাহবাগের বাগান বাড়িতে এসে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সে কালের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক আবদুল গাফফার নাসকান কে। কলকাতায় তার গান শুনে আত্মহারা হয়েছিলেন রাঁইচাদ বড়াল, কৃষ্ণচন্দ্র আর কবি নজরুল ইসলাম। রেডিওতে মোস্তারী বাঈয়ের গান শুনে তখন ফোন করছিলেন রেডিও অফিসে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জিজ্ঞাস করেছিলেন, ‘এই দেবীকে কোন গন্ধর্বলোক থেকে নিয়ে এলে’?

লাল চাদ বড়ালের গুরু বিশ্বনাথ রাওয়ের ছাত্রী মানদা। ল্যান্স ডাউন রোডে নাটোর হাউসে বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁ র সাথে এক সাথে সংগীত পরিবেষন করেছিলেন যা ১৯২৭ সালে যা এর আগে কল্পনাই করা যেত না। এভাবেই সমাজের কাছে নিস্প্রভ করে দিয়েছিলেন গনিকার আত্মজা হওয়ার কষ্ট। মানদার ৫০ টির মত বেকর্ড আছে তার মধ্যে ৩ টি রবীন্দ্র স্ংগীত। উপমহাদেশে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে নারী শিল্পীদের চলা এই সময় থেকেই মূলত শুরু।

ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাঈজী বা বারাঙ্গনা পাড়া ছিল।সে সময় বাঈজী পাড়া হিসাবে গঙ্গাজলি ও সাচিবন্দর ছিল। ঢাকার ইসলাম পুর ও পাটুয়াটুলীর মোড় থেকে যে পথটি ওয়াইজঘাট নামে বুড়ি গঙ্গার দিকে চলে গেছে তার নাম ছিল গঙ্গাজলি। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে তবলার বোল, সেতারের ঝঙ্কার আর নুপুরের নিক্কর গঙ্গাজলির পরিবিশ মুখরিত হয়ে উঠত। বাবু আর সাহেবদের আলবোলার গুড়্গড় শব্দ পরিবেশের সাথে ছিল সঙ্গতি পূর্ন।

নাট্যকার সাঈদ আহমেদ তার একটি লেখায় বলেছেন, কাছেই ছিল মহেশ ভট্টাচার্যির বিশাল হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান, গঙ্গাজলির উল্টা দিকে ছিল কালীমন্দির। গঙ্গাজলি ছিল দোতালা প্রসস্ত বাড়ী। নীচতলায় বাঈজীদের কাজের লোকেরা থাকত। বাঈজীরা থাকতেন দোতালায়। বাকওয়ালা সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হত। বারান্দায় পাতা থাকত ইজি চেয়ার। বাঈজীদের খাস কামরা সাজানো থাকত শান শওকতে। ফরাশ বিছানো ঘর।

গঙ্গাজলির অধিকাংশ বাঈজী বিষ্ণু উপাসনা করত। প্রতিদিন সকালে গঙ্গাজলি থেকে স্নানের জন্য দল বেধে বুড়ি গঙ্গায় যেতেন। গোসল সেরে বুকে গামছা জড়িয়ে কোমড়ে পিতলের কলসি নিয়ে সিক্ত ভূষনে বাঈজীরা লাইন দিয়ে ফিরে আসতেন। এ দৃশ্য উপভোগ করতে কৈশরে বন্ধুদের নিয়ে ওয়াইজ ঘাট এলাকায় যেতেন নাট্যকার সাঈদ আহমেদ।

শিল্পী পরিতোষ সেন ও কিন্তু ভূলে যাননি সিক্ত বসনে বাঈজীদের ঘরে ফেরার দৃশ্যর বর্ননা দিতেঃ

‘আমাদের পাড়ায় বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে স্নান করতে বুড়ীগঙ্গা যায়। তাদের স্নানে যাবার পথটি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে। ফেরার পথে ভেজা কাপড়ে কালী মন্দিরে প্রনাম করে আমাদের গলির মূখে আবার দেখা হয়। সকাল বেলার এই মনোরম দৃশযটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দিত। তাদের মন মেঝাজ খোশ রাখে। দিনটি ভাল কাটে।

সদ্য স্নাত তরুনীদের প্রথম সারির মাঝখানে ১৬-১৭ বছরের একটি মেয়ের আকর্ষনীয় বর্ননা দিয়েছিলেন পরিতোষ সেন। সেই সরস বর্ননা আমি শামীম আমিনুর রহমানের একটি লেখায় কিছুটা পেয়েছিলাম তার কিছুটা তুলে দিলামঃ

মুখটি অবিকল লিচুর মত গোল। থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষন, ঠোট দুটি যেন রসালো দুটি কমলার কোয়া। তার নাকের ছোট্ট পাটা দুটি প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে ফুলে উঠছিলো। গোটা শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন আর চকচকে তার ত্বক। পাকা পাতি লেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপী রঙের পোচে যে রঙের মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই তার গায়ের রঙটি। তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে।

শাস্ত্রে বলা আছে বিহঙ্গের সৌন্দর্যের প্রতি আনুরাগ আছে বলিয়াই তো বিহঙ্গটি সুন্দর হয়েছে। ময়ুর ও সেই সৌন্দর্য্যের প্রতি অনুরাগী বলিয়াই তো ময়ুর সুন্দর হয়েছে। চম্পক আঙ্গুলী ও খঞ্জন নয়নের প্রতি পুরুষের আকর্ষন আছে বলিয়াই তো নারী জাতি চম্পক আঙ্গুলী ও খঞ্জন নয়নের অধিকারিনী হয়েছে’।

পরিতোষ সেন আরো বর্ননা দিয়েছেনঃ

‘ভেজা কাপড়টি মেয়েটির গায়ে লেপ্টে থাকার কারনে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একটি ফুলের বিভিন্ন পাপড়ির মত আলাদা সত্ত্বা নিয়ে সরল বৃন্তটির ওপর দাড়িয়ে আছে। এক একটি পাপড়ি যেন একেকটি ফুল। বাকী মেয়েকটির মত তার কাধেও পেতলের কলসি ভরা বুড়িগঙ্গার জল। এই কলসি আর নিতম্ব দুইই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুইই টলোমলো। এমনই সুন্দর সাবলীল আর বেপরোয়া।

তার চলার ভঙ্গি মনে হয় কোন নিঃশব্দ সংগীতের সঙ্গে তাল রেখে পা ফেলছে বা এই পা ফেলের ঢং যে কোন ওস্তাদ নর্তক বা নর্তকীর ঈর্ষার বস্তু হতে পারে, তাতে আর সন্দেহ কি? এই চালে তার সোনার বাটির মত বক্ষ যুগল নেচে ঊঠছে, আর একটু নাচলেই হয়ত করতালের মত বেজে ঊঠবে।

যে মেয়ের উদ্ভাসিত রূপ পৃথিবীর তাবৎ পুরুষদের সমস্ত সূর্যকিরনকে সজীব করে তোলে তার কোথা থেকেই বা শেষ করি কোথা থেকেই বা শুরু করি? একই দেহে একই সঙ্গে এত রূপ দেখার পক্ষে বিধাতা পুরুষদের দুটি মাত্র চোখ দিয়ে যেন বিশেষ অবিচার করেছেন, কারন একদিক দিয়ে দেখতে গিয়ে আর একদিক যেন বাদ পরে যায়।

তাই এক কথায় বলি এ যুগের রাধা। তার মা নাকি তাকে সত্যি সত্যি হরিদাসী বলে ডাকত। জমিদার পুত্র, বিশ্ববিখ্যাত সাতারু, আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিশেষ অবদান রয়েছে এমন লেখক আর কবিদের হরিদাসীর দাস হতে দেখেছি’।

সত্যেন সেন তার রচনায় ঢাকার জানকী বাঈয়ের কথা বলেছেন। এলাহাবাদের মেয়ে ছিলেন। থাকতেন ঢাকায়। সে সময় তিনিই ঢাকায় সবচেয়ে বেশী পারিশ্রমিক প্রাপ্ত ছিলেন একদিনের মুজরোতে তাকে দেড় হাজার টাকা দিতে হত ততকালীন সময়ে। জানকী ছিলেন এক নবাবের রক্ষিতা। নবাব তাতে এতই মুগ্ধ ছিলেন কেউ যেন তার কাছ থেকে জানকীকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই জন্য কিছুটা কুৎসিত করার নিমিত্তে জানকীকে ৫৬ টি ছুরির আঘাত করেছিলেন। সে কারনে জানকী ছাপান্ন ছুড়ি নামে পরিচিত ছিল।

কৃতজ্ঞতাঃ হেকিম হাবিবুর রহমান, ডঃ মুনতাসির মামুন, শামীম আমিনুর রহমান, ইন্টারনেট।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৭
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×